তিনি নিশ্চয় দুনিয়াদারির লেখাপড়া করেছেন! এরকম একটি প্রশ্ন আমি করতে চেয়েছি মা’কে। আবার বেয়াদবি হবে বলে পেটের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলেছি আস্ত বাক্য। আল্লাহ রসুল নিয়ে মা আসলে কোনও যুক্তিতে যেতে চান না। পীর আমিরুল্লাহ নিয়েও নয়। যা বলবেন, তা আমি হ্যাঁ হুঁ করে শুনে গেলে মা বেজায় খুশি। মা’র যেহেতু সন্তান আমি, মা’কে খুশি করার দায়িত্ব আমার, এ রকমই জ্ঞান আমাকে দেওয়া হয়েছে। মা’কে খুশি রাখলে চড় চাপড় কিল ঘুসি থেকে বাঁচা যায়, বরং খেতে বসলে মা খাতির করে মাছ মাংসের টুকরো পাতে তুলে দেন। মা’র আদর পাওয়ার লোভের চেয়ে কিল চড় না খাওয়ার ইচ্ছেতেই ঠোঁট সেলাই করে রাখি অদৃশ্য সুতোয়। কোরান হাদিস যারা না মানে, মা স্পষ্ট বলেন, তারা মুসলমান নয়। তারা দোযখের আগুনে পুড়বে। খাতির নেই। ব্যস, সহজ হিশেব। আল্লাহর হিশেব বরাবরই বড় সহজ। নামাজ নেই রোজা নেই, তো দোযখের আগুন। বোরখা পরা নেই, দোযখের আগুন। বেগানা পুরুষের সঙ্গে মেশা, দোযখের আগুন। পেশাব করে পানি না নিলে দোযখের আগুন। জোরে হাসলে দোযখের আগুন। জোরে কাঁদলেও দোযখের আগুন। কেবল আগুন। মা’কে বলতে ইচ্ছে করে আগুনে কেন লোকের এত ভয়! আজকাল আগুন কোনও ব্যাপার হল! শীতের দেশে তো ঘরে ঘরে আগুন জ্বেলে রাখে। আগুন নিয়ে সার্কাসের লোকেরা চমৎকার খেলা খেলে। আগুনে পুড়লে চিকিৎসা আছে, সেরে যায়। আর আল্লাহই বা মানুষকে আগুনের ভয় এত দেখান কেন! আরও কত কত ভয়ংকর পদ্ধতি আছে কষ্ট দেবার, সে পথ আল্লাহ একেবারেই মাড়াননি। বদ লোকেরা শরীরে কষ্ট দিতে ভালবাসে আর চতুর লোকেরা মনে কষ্ট দেয়। শরীরের কষ্টের চেয়ে মনের কষ্টে মানুষ ভোগে বেশি। আল্লাহকে চতুর না মনে হয়ে বরং মনে হয় বড় বদ। গেতুঁর মার স্বামীর মত। সময় সময় বাবার মত, বাবা চান তিনি যা বলেন তাই যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। না পালন করলে শরীরে কষ্ট দেন আচ্ছামত পিটিয়ে। বাবার সঙ্গে আল্লাহর তফাৎ হল বাবা চান দুনিয়াদারির লেখাপড়া করে মানুষ বানাতে, আর আল্লাহর ইচ্ছে হাদিস কোরান পড়ানো। বাবার সঙ্গে আমি যেমন দূরত্ব অনুভব করি, আল্লাহর সঙ্গেও। বাবা এ বাড়িতে অনুপস্থিত থাকলে আমি খুশি হই, আবার আল্লাহর যেহেতু আকার নেই, বেচারা, আমি অপ্রস্তুত হই তাঁর প্রসঙ্গ এলেও। আসলে দু’জনের অনুপস্থিতিই আমার কাম্য। দু’জনই আমাকে দু’রকম দু’টি দিকে এমন ঠেলে দেন যে আমার নিজের কোনও অস্তিত্ব থাকে না, থাকে কেবল দ্বিখন্ডিত মর্গের লাশ। আমার ওপর খুশি হলে বাবা আমার জন্য খাঁচা ভরে মিষ্টি কিনে আনেন, বড় বড় রুই কাতলা কিনে এনে বড় পেটিগুলো খেতে বলেন। আল্লাহও তো যাকে খাওয়াবেন, তাকে নাকি একেবারে ঠেসে। পাখির মাংস, আঙুর, মদ, কত কিছু। সুন্দরী গোলাপী শরীরের মেয়েরা পুরুষের পাত্রে মদ ঢেলে দেবে। নানা বিষম খুশি যে বেহেসতের খাবার খেয়ে সুগন্ধি ঢেকুর উঠবে। আমার আবার কারও ঢেকুর তোলা দেখতে বিচ্ছিজ্ঞর লাগে। সে সুগন্ধি হোক কি দুর্গন্ধি হোক। এরকম কি হবে যে কোনও ঢেকুর তোলা লোকের সামনে নাক পেতে রইল আরেকজন ঢেকুরের সুগন্ধ নিতে। ধরা যাক সুগন্ধ ঢেকুর শোঁকা চরিত্রে গেঁতুর বাবা আর ঢেকুর ছাড়া চরিত্রে নানা। হাদিসের বইটি ডানে নিয়ে আমি চরিত্রদুটোকে আমার বাঁ পাশে বসাই। তারা ঢেকুর ছাড়ে আর ঢেকুর শোঁকে। আমি উইপোকায়, অক্ষরে, ঢেকুর ছাড়া-শোঁকায়। আমি আছি, অথচ নেই। ঢেকুর ছাড়া-শোঁকা নেই, অথচ আছে। উইপোকা আর অক্ষর থেকে যায় আমার সঙ্গেও, ঢেকুরের সঙ্গেও। তাদের বিলীন করতে মনে মনেও, আমার ইচ্ছে নেই। হাদিসের বইটির ভেতর উইপোকা বাসা বেঁধেছে। বাড়িটি স্যাঁতসেঁতে, কিছুদিন বইয়ের পাতা না ওল্টালেই উই ধরে। উইএর পেট মোটা শরীর দেখে গা রি রি করে আমার। বইটির ওপর বাবার একটি পুরোনো জুতো ঠেসে কিছু উই থেতলে ফেলি। এক চোখ উইএর থেতলে যাওয়া শরীরে, আরেক চোখ বইয়ের অক্ষরে। অক্ষর গুলো থরে থরে সাজানো আছে এরকম– দুনিয়ায় সবকিছু ভোগের সামগ্রী আর দুনিয়ার সর্বোত্তম সামগ্রী হচ্ছে নেক চরিত্রের স্ত্রী।
মেঝেয় আধ শোয়া হয়ে আমার এক হাতে জুতো, আরেক হাতে হাদিসের বই, উইএর পাছার তলে পবিত্র হাদিসের বাণী — যদি আমি কাহাকেও সেজদা করিতে হুকুম করিতাম, তবে নিশ্চয় সকল নারীকে হুকুম করিতাম তাহারা যেন তাহাদের স্বামীকে সেজদা করে।
যখন কোনও স্ত্রী তাহার স্বামীকে বলিবে যে তোমার কোনও কার্যই আমার পছন্দ হইতেছে না, তখনই তাহার সত্তর বছরের এবাদত বরবাদ হইয়া যাইবে। যদিও সে দিবসে রোজা রাখিয়া, ও রাত্রে নামাজ পড়িয়া সত্তর বছরের পুণ্য কামাই করিয়া ছিল। স্বামী স্ত্রীকে চারটি কারণে প্রহার করিতে পারে, স্ত্রীকে সাজসজ্জা করিয়া তাহার নিকট আসিতে বলার পর স্ত্রী তাহা অমান্য করিলে, সঙ্গমের উদ্দেশ্যে স্বামীর আহবান পাওয়ার পর প্রত্যাখ্যান করিলে, স্ত্রী ফরজ গোসল ও নামাজ পরিত্যাগ করিলে, স্বামীর বিনা অনুমতিতে কাহারো বাড়ি বেড়াইতে গেলে।
যে সমস্ত স্ত্রীলোক স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহে হিংসা না করিয়া ছবর করিয়া থাকে, তাহাদিগকে আল্লাহ শহীদের তুল্য সওয়াব দান করিবেন।
পোকাগুলো বই ছেড়ে আমার গায়ের দিকে হাঁটতে থাকে। আমাকেই বুঝি এখন খেতে চায় এরা! বাড়িটি ভরে গেল ঘুণপোকায়! উইপোকায়। রাতে কুট কুট করে ঘুণপোকা কাঠ খায়, আর নিঃশব্দে উই খায় বইয়ের পাতা। মহানবী হযরত মহাম্মদের বাণীগুলোও দিব্যি খেয়ে ফেলতে থাকে। উই কি মুসলমান! উইএর নিশ্চয় ধর্ম থাকে না। এরা শরদিন্দু অমনিবাসও খায়, হাদিস কোরানও খায়।