অপেক্ষায় অস্থির হতে থাকি। দাদা দিন পেছোতে থাকেন, এ মাসে না পরের মাসে করে করে। আমি তবু আশায় আশায় বাঁচি, একদিন খুব ভোরবেলা কারও জাগার আগে, পাহাড় দেখতে যাব, দূরে –অনেক দূরে, নির্জনতার পিঠে মাথা রেখে টিপটিপ টিপটিপ শিশিরের ঝরে পড়া দেখব।
দাদার ফিরে আসার ক’মাস পর বাবা ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে বদলি হন। বদলির খবর এলেই বাবার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে। তিনি দাদার ওপর বাড়িঘর দেখাশোনার ভার দিয়ে চলে যান মিটফোর্ডে। দু’দিন পর পর গভীর রাতে ট্রেনে করে ঢাকা থেকে চলে আসেন, রাতটুকু কাটিয়ে আবার খুব ভোরবেলা রওনা হয়ে যান ঢাকায়। মিটফোর্ডে তিনি জুরিসপ্রুডেন্স বিভাগে অধ্যাপকের পদ পেয়েছেন। ছাত্র পড়ান। মর্গের লাশ কাটেন। বাবার বদলি হওয়ায় বাড়িতে সবচেয়ে বেশি যে খুশি হয়, সে আমি। আমার তখন পাখনা মেলার বয়স।
এক বিকেলে বড় শখ হয় ব্রহ্মপুত্রের তীরে পা ভিজিয়ে হাঁটতে। বাড়ি থেকে এত কাছে ব্রহ্মপুত্র অথচ এটি দেখতে যাওয়ার অনুমতি জোটে না। যখন ছোট ছিলাম, বলা হত, এত ছোট আমি, আমার একা একা দূরে যাওয়া ঠিক না, ছেলেধরারা বস্তায় ভরে আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে। ফটিং টিং দাঁড়িয়ে আছে নদীর পাড়ে, পায়ে কথা কয়, হাউমাউখাউ বলে খাবে আমাকে। আর যেই না বড় হয়েছি, শুনতে হচ্ছে, বড় মেয়েদের রাস্তায় বেরোনো ঠিক না। চুপচুপ করে বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ি বাইরে, সঙ্গে ইয়াসমিনকে নিই। মা ঘুমোচ্ছেন, দাদা বাইরে, বাবা ঢাকায়, আর আমাদের পায় কে। আমার ফটিং টিঙের ভয় নেই। যাব না কেন? যাব। সেই কত কাল থেকে বিন্দু বিন্দু করে জমিয়ে পুরো এক নদীর সমান দীর্ঘ করেছি স্বপ্ন, আমার মত করে ব্রহ্মপুত্রের তীরে হাঁটার, তার জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকার স্বপ্ন।
ব্রহ্মপুত্রের তীরে হাঁটছি, আমার চুল উড়ছে, জামার ঝুল উড়ছে, কানে সাঁ সাঁ শব্দ পাচ্ছি বাতাসের। বিকেলের মিঠে রোদে বালু চিকচিক করছে। এমন সময়, এমন সময়ই, আমার প্রচন্ড আনন্দের বুকে বিষের তীর বেঁধাল এক যুবক। উল্টো দিক থেকে আসছিল, আমি দোষ করিনি কিছু, বাড়া ভাতে ছাই দিই নি তার, আমার দু’স্তনে আর পাছায় আমি কিছু বুঝে ওঠার আগে বিষম জোরে টিপে দিয়ে চলে গেল হাসতে হাসতে, যুবকের সঙ্গী আরও কিছু যুবক হাততালি দিয়ে হাসতে লাগল দূরে দাঁড়িয়ে। আমার শরীর, যেন এ আমার নয়, ওদের মজা করার জিনিস। ব্রহ্মপুত্র সবার নদী, আমারও। আমার অধিকার আছে এ নদীর পাড়ে আসার। কিন্তু কি অধিকারে আমাকে ওরা অপমান করে! দু’হাত আমি মুঠোবন্দি করি। ইচ্ছে হয় সবকটিকে চাবকাই। চাবকে পিঠের ছাল তুলে ফেলি। পারি না। এগোতে পারি না দু’কদম।
ইয়াসমিন কাঁপা গলায় বলে, বুবু চল বাসাত যাইগা। আমার ডর করতাছে।
ব্রহ্মপুত্রের তীর থেকে প্রচন্ড ক্রোধ নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখি মা’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বসে কথা বলছেন আমান কাকা।
— কি খবর কেমন আছো মা? আমান কাকা জিজ্ঞেস করেন।
আমি শ্যেন দৃষ্টি ফেলে লোকটির দিকে, একটি শব্দ উচ্চারণ না করে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করি। প্রাণ খুলে কাঁদি আমি, আমার সকল অক্ষমতার জন্য কাঁদি। কাউকে বুঝতে দিই না যে আমি কাঁদছি। কাউকে বুঝতে দিই না যে যন্ত্রণার গভীর গহন জল আমাকে পাকে ফেলে নিয়ে যাচ্ছে আরও অতলে।
মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম — আমান কাকা কেন আইছিল?
মা মধুর হেসে বলেছেন — ও আল্লাহর পথে আইব। ওরে নছিহত করতাছি।
আমি বলি — বেশি নছিহত করতে যাইও না। নছিহত করতে গিয়া মুবাশ্বেরা মরল, দেখলা না!
আমার স্বর এত ক্ষীণ ছিল, মা শুনতে পাননি। অথবা মা বুঁদ ছিলেন কিছুতে যে শোনার চেষ্টা করেননি।
আমান কাকা প্রতিদিন সন্ধেয় বাড়ি এসে মা’র ঘরে ঢুকে ফিসফিস কথা বলেন। মা দরজা ভেজিয়ে রাখেন সে সময়। একদিন ভেজানো দরজা ঢেলে ঢুকেছি, আমান কাকা লাফিয়ে বিছানা থেকে নামলেন, মশারির নিচে মা।
— মা এই অন্ধকারে বইসা কি কর! আমি জিজ্ঞেস করি।
মা বলেন — না, আমানের ত ওর বউএর সাথে গন্ডগোল হইছে। ওর মনডা খারাপ। তাই আমার কাছে আইসা দুঃখের কথা কইয়া একটু শান্তি পায়। ওরে বুঝাইতাছি, আল্লাহর পথে আইতে।
— আমার ক্ষিদা লাগছে। ভাত দেও।
খামোকাই বলি। ক্ষিধে পেলে মণিই আমাকে ভাত দিয়ে যায়।
মা বলেন, বিরক্ত হয়ে — আমার মাথা বেদনা করতাছে। একটু শুইছি। তগোর জ্বালায় কি একটু শুইয়াও শান্তি পাইতাম না!
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসি। বারান্দার বাতাসে এসে শ্বাস নিই ফুসফুস ভরে। আমার শ্বাস কষ্ট হয়, আমান কাকার সঙ্গে মা’কে গা রেগে বসে থাকতে দেখে। যে লোক সাত বছর বয়সী আমাকে ন্যাংটো করেছিল, সে লোক অন্ধকারে মা’কেও ন্যাংটো করছে বলে আমার আশংকা হয়।
দাদারও চোখ এড়ায় না আমান কাকার অসময়ে বাড়ি ঢোকা, কেমন কেমন চোখে ইতিউতি তাকানো।
১৮. উইপোকার ঘরবাড়ি
মা’র কাঠের আলমারির এক তাকে কেবল বই, বাকি তাকগুলোয় কাপড় চোপড়, ভাঁজহীন, ঠাসা। বইয়ের তাকটিতে হাদিসের বই, মকসুদুল মোমেনিন, নেয়ামুল কোরআন, পীর আমিরুল্লাহর লেখা কবিতার বই মিনার, তাজকেরাতুল আওলিয়া, আর হু এম আই বলে একটি ইংরেজি বইও। আমিরুল্লাহ আবার ইংরেজিও জানেন। মা অনেকদিন আমাকে বলেছেন হুজুর খুব জ্ঞানী, ফটফট কইরা ইংরেজি কন। যখন বলেন মা, চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।