দাদা জল মুছে ফেলে বলেন — না, না, কানতাম ক্যান! কান্দি না। এমনি।
দাদা আসলে কাঁদছিলেন। দাদা কি শীলার জন্য কাঁদছিলেন!
ঘটনাটি আমি মনে মনে রাখি। মনে মনে রাখি দাদার একটি গোপন কষ্ট আছে। দাদা নিরালায় বসে খুব আপন কারও জন্য, মুছে যাওয়া কোনও দিনের জন্য কাঁদেন।
দাদার পাশে জানালায় এসে বসি। বাগানে লিলি ফুল ফুটে চমৎকার গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাইরে দুলাল যাচ্ছে মাউথ অর্গান বাজিয়ে। এত দ্রুত হাঁটে সে, দেখে মনে হয় দৌড়োচ্ছে, সকাল, দুপুর, বিকেল, মধ্যরাত, মাউথ অর্গানের শব্দ শুনে যে কেউ বলে দিতে পারে, এ দুলাল। ও কারও সঙ্গে কথা বলে না, কারও জন্য পথে দাঁড়ায় না। ও কেবল দৌড়ে যেতে থাকে, যেন কোথাও ওর খুব জরুরি কোনও কাজ। আসলে ওর কোনও কাজ নেই। লোকে বলে, দুলাল পাগল।
দুলাল কি আসলেই পাগল? দাদাকে জিজ্ঞেস করি।
দাদা বলেন — আমার মনে হয় না।
হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদা উঠে দাঁড়ান, মেঘ কেটে সূর্য ওঠার মত হাসি দাদার মুখে, বলেন — যা, দাবার গুটি সাজা। দেখি আইজকা কেডা জিতে।
আমার মন ভাল হয়ে যায় দেখে যে দাদা হাসছেন। গুটি সাজিয়ে বসে যাই। দাদার কাছ থেকে খেলা শিখে অবদি দাদাকেই হারাচ্ছি খেলায়। আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি দেদার গুটি চুরি করেন। খেলতে গিয়ে বলে নিই, চুরি করা চলবে না।
অথচ চুরি করতে যেয়ে দু’বার ধরা পড়েন দাদা। ঘন্টা খানেকের মধ্যে তাঁর রাজাকে কিস্তি দিলে ব্যস, দাবার ছক উল্টে ফেলেন ইচ্ছে করে, আমি গলা ছেড়ে চেঁচাতে থাকি, তুমি হারছ, তুমি হারছ।
দাদা একেবারে যেন কিছুই জানেন না, অবোধ শিশুর মত বলেন, কী আমি হারছি। কই! দেখা কই হারছি! তুই না হারলি!
মুখখানা দিব্যি নিষ্পাপ বানিয়ে তিনি অস্বীকার করেন তাঁর পরাজয়ের কাহিনী। আমি ভুল চাল দিয়েছিলাম বলে তিনি সহ্য করতে পারেননি, তাই ছক উল্টেছেন এই তাঁর বক্তব্য। আমি জিতেছি, আমি ভাল খেলি, তিনি কোনওদিন মানেন না।
ইস্কুলে ভাল ছাত্রী হিশেবে আমার নাম হয়। প্রথম তিনজনের মধ্যে আমি আছিই। বাবা তবু স্বীকার করেন না আমি ভাল ছাত্রী। তাঁর বদ্ধ ধারণা, আমি ফাঁকি দিচ্ছি লেখাপড়ায়, তা না হলে আমি প্রথম হই না কেন। মেজাজ খিঁচড়ে থাকে।
মা দেখি দাদার মনতুষ্টিতে বিষম ব্যস্ত। দাদা গরুর শুটকির ঝুরঝুরি খেতে চান, মা রাঁধেন। দাদা ঝাল পিঠা খেতে চান, মা আয়োজন করেন। আকাশ মেঘ করলেই বা দুফোঁটা বৃষ্টি ঝরলেই দাদা বলেন — মা ভুনা খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজেন।
মা দিব্যি রেগে যান চাল ডাল মেশাতে।
মা’র পীরবাড়ি যাওয়া বাদ পড়তে থাকে।
টাকা পয়সা অলা দাদা হয়ে উঠতে থাকেন বাড়ির গণ্যমান্য একজন। তিনি চিত্ররূপা স্টুডিওতে আমাদের নিয়ে গিয়ে গ্রুপছবি তুলে আনেন। নিজে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলে এলবামে সাঁটতে থাকেন। কিছু ছবি বড় করে কাঠের ফ্রেমে বাঁধাতে বাঁধাতে বলেন — কী, দেখলি কেরম নায়কের মত লাগে আমারে!
আমি স্বীকার করি দাদাকে দেখতে ছবির নায়কের মত লাগে। দাদা আসলেই খেয়াল করে দেখেছি, সুন্দর।
আমার আঁকা দুটো ছবিও, রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের, বাঁধিয়ে ঝুলেয়ে রাখেন ঘরে, যে ই আসে বাড়িতে, ছবি দুটো দেখিয়ে বলেন — আমার বোনের আঁকা।
ছবি আঁকার রং তুলি কিনে দিয়ে দাদা আমাকে বলেন আরও ছবি আঁকতে। আঁকতে আঁকতে ভাবি বড় হয়ে আমি ছবি আঁকার ইস্কুলে ভর্তি হব। পিটিআই ইস্কুলে গান গাওয়া মাস্টার বলেছিলেন, আমি খুব বড় শিল্পী হব। যে ছবিই আঁকি না কেন, দেখে মুগ্ধ দাদা বলেন — ছুটোবেলায় তরে ছবি আঁকা শিখাইছিলাম বইলা! নাইলে কি আর এত ভাল আঁকতে পারতি!
দাদাকে গোপন ইচ্ছের কথা বলি যে একদিন ছবি আঁকার ইস্কুলে লেখাপড়া করে আমি আরও ভাল ছবি আঁকব।
দাদা ঠোঁট উল্টে বলেন — বাবা শুনলে তরে মাইরাই ফালব। কিছুতেই তরে শিল্পী হইতে দিব না। কইব শিল্পীগোর ভাত নাই।
দাদা কেবল মা’কেই নয়, আমাদেরও জামা জুতো কিনে দেন, সিনেমা দেখাতে নেন। সিনেমার নেশায় পায় আমাকে। আবদার করে করে অতিষ্ঠ করে ফেলি তাঁকে। মাঝে মাঝে বলেন — ঠিক আছে, দরখাস্ত লেখ আমার কাছে। ভাইবা দেখতে হইব মঞ্জুর করা যায় কি না।
দরখাস্ত লিখি, ডিয়ার স্যার সম্বোধন করে। ইতিতে লিখি ইয়োর ওবেডিয়েন্ট সারভেন্ট। বই দেখে টুকি আসলে। টাকা চাহিয়া ম্যানেজারের কাছে ইংরেজিতে একটি দরখাস্ত লেখ যে পৃষ্ঠায় আছে, সেটি বার করে, টাকা চাইএর বদলে সিনেমা দেখতে চাই বসিয়ে।
দরখাস্ত পাওয়ার পরও দাদা কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোন না। আমি অস্থির হতে থাকি বিষম। তিনি বলেন — ধৈর্যশক্তি নাই তর। ধৈর্যশক্তি না থাকা আমার একদম পছন্দ না। একবার আমার এক বন্ধুরে লইয়া সিনেমা দেখতে গেছি। ইকবাল নাম। আমরা ডাকতাম শাদা হাত্তি কইয়া। ইয়া শাদা আর ইয়া মুডা আছিল। হলে গিয়া দেখি সিনেমার টিকিট নাই। হে কয় দেখবামই ছবি যেমনেই হোক। ব্ল্যাকে টিকিট কাইটাও দেখবাম। ব্ল্যাকে টিকিট তিন ডবল দাম। কইলাম চল কাইলকা দেখি। সে কয় ওইদিনই দেখব সে। ওই ম্যাটিনি শো। আমি ঘুরাইয়া একখান চড় মারলাম। ওই চড় খাওনের পর আমার সামনে সে আর অস্থিরতা দেহায় না কোনও কিছু লইয়া। তুই হইলি ইকবালের মত, তরও ধৈর্যশক্তি নাই।
দাদাকে ভালবাসি, ঈর্ষাও করি। দাদা যেখানে খুশি যেতে পারেন, যা ইচ্ছে করতে পারেন। মোটর সাইকেল কিনে ওতে করে সারা শহর ঘুরে বেড়ান। নানান শহরে যান, টাঙ্গাইল, জামালপুর, নেত্রকোণা। আমার বড় ইচ্ছে করে যেতে। বড় ইচ্ছে করে সীমানার বাইরে পা বাড়াতে। দাদা বলেছেন তরে একদিন জয়রামকুরায় পাহাড় দেখাতে নিয়া যাইয়াম, গারো পাহাড়।