চাকরির প্রথম বেতন দিয়ে দাদা মা’র জন্য শাড়ি কিনে আনলেন চারটে। মা’র জন্য সোনার বালা গড়তে দিলেন।
শাড়ির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে হু হু করে কাঁদলেন মা। শাড়ি পরা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দাদার আনা শাড়ি তিনি পরলেন, ফোঁপাতে ফোঁপাতে কুঁচি কাটলেন শাড়ির। মা’কে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। দাদাকে বুকে জড়িয়ে মা চোখের জলে ভেসে বললেন — আমার লাইগা আর কিছু কিননের দরকার নাই বাবা। আমার কিছু না হইলেই চলব। তুমি টাকা পয়সা জমাও। তুমার ভবিষ্যতে কাজে লাগব।
ন্যূজ্ব, নত মা এখন শিরদাঁড়া টান টান করে হাঁটেন। তাঁর পেটের ছেলে টাকা পয়সা কামাচ্ছে, তাঁর আর কোনও মাগীখোর লোকের কাছে হাত পাতার দরকার নেই। মা’কে এত উচ্ছ্বল, এত প্রাণবান আর কখনও হতে দেখিনি। কাফেরের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখলে পাপ হয়, ফজলিখালা তাই নিজে মা’কে নিয়ে কাচারিতে গিয়েছিলেন বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করাতে। মা তালাকনামার কাগজে সই করেছিলেন কাচারিতে বসে। বাবার হাতে কাগজ এলে তিনি ধুত্তুরি বলে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন সে কাগজ। কাফেরের সঙ্গে এক ছাদের তলে বাস করতে মা’র গা জ্বলে, যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবেন বলে বলেও মা’র কখনও কোথাও চলে যাওয়া হয়নি এ বাড়ি ছেড়ে। মা কোথাও যান নি কখনও, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে, নাকি থেকে গেছেন বাড়িটির জন্য, নিজে হাতে লাগানো গাছপালাগুলোর জন্য, আর বাড়ির মানুষগুলোর জন্য এক অদ্ভুত মায়ায় — সে আমার বোঝা হয়নি।
— ইউনিভার্সিটি থেইকা গ্রাজুয়েট হইয়া ফিরছে আমার পুত্রধন। আমার আনন্দ আর ধরে না।
বাবা দাঁত কটমট করে চলছেন দাদা ঢাকা থেকে ফেরার পর থেকেই। গ্রাজুয়েট ছেলেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন মাস্টার ডিগ্রি হাতে নিয়ে ফিরতে, আর দাদা বুক পকেটে আনন্দমোহনের বি এসসি পাশের কাগজ নিয়েই বছর দুই পর ফিরলেন। বাবা বলেন এর চেয়ে মইরা যাওয়া ভাল।
দাদা মাছের মত চোখ করে বসে থেকে বাবার টিপ্পনি শোনেন।
দাদা বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে গুছিয়ে বসলেন। ছোটদার খাটটি ঘর থেকে সরিয়ে বাইরে বারান্দায় খাড়া করে রাখলেন।
খাটটি সরানোয়, আশ্চর্য, বাবা বিষম রাগ করলেন। তিনি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করলেন, বললেন — এই খাট যেইখানে ছিল, সেইখানে নিয়া রাখ। যার খাট সে ফিইরা আইলে থাকব কই! যেমন বিছানা পাতা ছিল, তেমন কইরা রাখ।
মা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন — কামাল কি আর ফিইরা আইব! শুনছি, শহর ছাইড়া চইলা গেছে। ইসলামপুর না কই যেন থাকে। কি খায় কেমনে থাকে কেডা জানে! বাবা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন শুনে।
— কী খায় না খায় তা জাইনা আমার কী! না খাইয়া মইরা যাক। ভুগুক। আমার কী! তুমি হইলা নষ্টের গোড়া। তুমি কথা কইও না। তুমার আসকারা পাইয়া ছেলেমেয়েগুলা নষ্ট হইছে।
মা শিরদাঁড়া টান টান করে হেঁটে এসে চিবুক উঁচিয়ে বলেন — কথা কইতাম না ক্যা! আমারে আর কতদিন বোবা বানাইয়া রাখবা! আমি কি কারও খাই না পরি! আমার ছেলেই এহন আমারে টাকা পয়সা দেয়, কাপড় চোপড় দেয়, তেল সাবান দেয়। আমার আর ঠেকা নাই কুনো বেডার। ছেড়াডারে কী পাষন্ডের মত মাইরা বাড়ি থেইকা ভাগাইছে। এহন খাট সাজাইয়া রাইখা কি লাভ। লাভ কী!
লাভ, বাবা বলেন, বাবা বুঝবেন, মা’র বোঝার কোনও প্রয়োজন নেই।
রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই কিনে এনে ভারি গলায় দাদা নিজে পড়ছেন, আমাকে পড়তে বলছেন। কবিতা পড়তে থাকি একটির পর একটি, দাদা উচ্চারণ শুধরে দেন, কোথায় আবেগ কতখানি দরকার, কোথায় জোর, কোথায় না, কোথায় ধীরে, কোথায় দ্রুত বলে দেন। দাদা বলেন — হৃদয় না ঢাইলা পড়তে পারলে কবিতা পড়বি না।
দাদা আবৃত্তি সন্ধ্যার আয়োজন করেন দু’জনের। আমরা দু’জনই শ্রোতা, দু’জনই আবৃত্তিকার। দাদা বিচারক। আমার এক নতুন জীবন শুরু হয় দাদার চৌহদ্দিতে। ওষুধ কোম্পানীর একটি লাল নোটবুক আমাকে দেন, প্রতিদিন দুটো তিনটে করে কবিতা লিখে দাদাকে দেখাতে থাকি। কোনওটিকে ভাল বলেন, কোনওটিকে খুব ভাল, কোনওটি সম্পর্কে বলেন — এইডা গু হইছে, কবিতা হয় নাই।
কবিতার খাতাটি ইস্কুলের মেয়েদের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে। একজনের পড়া শেষ হলে আরেকজন বাড়ি নিয়ে যায়। খাতাটি আমার হাতে ফিরতে ফিরতে মাস শেষ হয়ে যায়। কাড়াকাড়ি পড়ে যায় মেয়েদের মধ্যে। দাদা মুক্ত বিহঙ্গ নামে আমার একটি কবিতা পড়ে বলেন — ইস, পাতা পত্রিকাডা থাকলে, তর এই কবিতাডা আমি ছাপাইতাম।
কেবল কবিতা নয়, গল্পেরও আসর বসান দাদা। দাদা একটি পড়েন, আমি একটি। কোনও কোনও লাইন আহা আহা বলে দু’তিনবার পড়েন, শিখে আমিও তা করি। বাবা বাড়ি ফেরা অবদি আসর রীতিমত গতিময় থাকে।
কখনও গানের আসরও বসে। আমাকে গাইতে বললে হেঁড়ে গলায় দু’লাইন গেয়ে ছেড়ে দিই। দাদা গাইতে বসে সুরহীন গলায় গরুর মত চেঁচান। গানের আসরে ইয়াসমিনকে নেওয়া হয়, তার গলায় বেশ সুর ওঠে বলে। ইয়াসমিনকে, দাদা বলেন একটি হারমোনিয়াম কিনে দেবেন।
গান শোনার একটি যন্ত্র কিনেছেন দাদা। কোনও কোনও বিকেল কেবল গান শুনেই কাটিয়ে দেন। মুছে যাওয়া দিনগুলি আমারে যে পিছু ডাকে, গানটি শুনতে শুনতে, একদিন আবিষ্কার করি দাদা কাঁদছেন, আমাকে লক্ষ করেননি তিনি আমি যে নিঃশব্দে ঢুকেছি ঘরে।
–দাদা, তুমি কানতেছিলা! জিজ্ঞেস করি।