আমি তোমায় খেলায় নেব দিলরুবা,
গোল্লাছুট খেলতে জান?
গোল্লা থেকে এক বিকেলে হঠাৎ করে ছুটে
হারিয়ে যাব দূরে কোথাও, অনেক দূরে।
সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপার যাব, যাবে?
ঠোঙার লেখাটি পড়ে দিলরুবা মিষ্টি হাসে। এমন মিষ্টি হাসি আমি দেখিনি আগে। সম্ভবত রুনির ছিল এমন হাসি, অথবা এমন নয়, খানিকটা অন্যরকম। এমন হাসি যার, তার কথা বলার দরকার হয় না, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ঠিকই লিখেছিলেন। রুনির সামনে আমি ছিলাম লজ্জাবতী লতা। দিলরুবার সামনে নই। দিলরুবাকে নিয়ে আমার অন্যরকম এক জগত তৈরি হয়। শব্দ নিয়ে খেলার জগত। দিলরুবা লেখে ওর কবিতার খাতায়–
যেদিকেই যেতে বল যাব,
নিজেকে হারাব।
কাছে এসো,
একটিই শর্ত শুধু, ভালবেসো।
আমি তো ওই জানি শুধু, ভালবাসতে। আমাদের ভালবাসা গভীর হতে থাকে, গভীর। দু’জন আমরা হারিয়ে যাই যেদিকে দুচোখ যায়, সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারে। সে কেবল মনে মনেই। দিলরুবার বা আমার কারও সত্যিকার হারানো হয় না সমাজ সংসার থেকে। দিলরুবা যে তার কবিতার মত, কবিতা তার শান্ত একটি পুকুরের মত, কোনও এক অরণ্যে একটি নিরালা নিভৃত পুকুর, আকাশের রঙের মত রঙ সে জলের, হঠাৎ হঠাৎ একটি দু’টি পাতা পড়ে টুপ করে সে জলে, যেন ভেলা, দিলরুবার জলে ভাসার ভেলা, একান্ত ওরই। সেই দিলরুবা একদিন আমাকে চমকে দিয়ে বলে, তার বিয়ে হয়ে যাবে শিগরি, তার বাবা বিয়ে ঠিক করেছে।
–না। দিলরুবার ম্লান মুখ আর ধূসর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বলি–তুই না করে দে। বল যে বিয়ে করবি না।
দিলরুবা আবারও ম্লান হাসে। গা পুড়ে যাওয়া জ্বরে পড়লে মানুষ এমন হাসে। পরদিন থেকে দিলরুবা আর আসে না ইস্কুলে। আমি এত একা হয়ে যাই। এত একা, যে, ক্লাসঘরে জানালার কাছে ওর না থাকা জুড়ে বসে থাকি, ছুটির পরও, অনেকক্ষণ। আকাশে তাকিয়ে ওকে খুঁজি। ও কি আকাশে চলে গেল অভিমান করে, কে জানে! এই প্রথম আকাশে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার কান্না আসে।
বিয়ে হয়ে যাওয়ার দু’দিন আগে দিলরুবা এসেছিল অবকাশে। এসেছিল সত্যিকার হারিয়ে যেতে, সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারে কোথাও! কোনও নিভৃত অরণ্যে। স্বপ্নলোকে। এই নিষ্ঠুর জগত সংসার থেকে অনেক দূরে, যেখানে পাখা মেলে দুঃখবতী মেয়েরা উড়ে উড়ে মেঘবালিকাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। কালো ফটক খুলে ও ঢুকেছিল। জানালায় দাঁড়িয়ে ওর নিখুঁত মুখটি আমি অপলক দেখছিলাম, দেখছিলাম স্বপ্নের বাগান ধরে ওর হেঁটে আসা, যেন ও হাঁটছে না, দুলছে। দিলরুবাকে জানালায় দাঁড়িয়েই আমি দেখলাম ফেরত যেতে। আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়নি। দরজা থেকে ওকে তাড়িয়ে দিয়েছেন বাবা। তাড়িয়ে দিয়েছেন কারণ তিনি কোনও যুক্তি খুঁজে পাননি একটি কিশোরীর লেখাপড়া ফেলে বিকেলবেলা কারও বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার। তাই ওর নাম ধাম জিজ্ঞেস করে, বাড়ি কোথায়, কেন এসেছ, কী কারণ ইত্যাদির উত্তর নিয়ে রক্তাভ চোখ আর বা হাতের তর্জনি তুলেছেন কালো ফটকের দিকে।
এক্ষুনি বেরোও, গপ্প মারতে আসছ! বাজে মেয়ে কোথাকার!
বাজে মেয়ে বেরিয়ে গেছে। খানকি মেয়ে বেরিয়ে গেছে। আর কখনও ওর সঙ্গে আমার দেখা হবে না, আমি তখন জানিনি। কোনও এক বেশি বয়সের অচেনা এক লোকের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়ে যাবে। কবিতার খাতা পুড়িয়ে দিয়ে, লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে মশলাবাটার, পিঁয়াজ কাটার, রেঁধে বেড়ে কাউকে খাওয়ানোর আর বছর বছর পোয়াতি হওয়ার জীবনে ওকে ঢুকতে হবে, সত্যিই, আমি তখনও জানিনি।
আর আমি, দিলরুবার হয়ে আকাশ দেখতে থাকব, আমার কান্না আসতে থাকবে, আর আমি কবিতা লিখতে থাকব। ্আমি ঘৃণা করতে থাকব সমাজ সংসার। ঘৃণা করতে থাকব আমার এই অদৃশ্য বন্দিত্ব। আমি অনুভব করতে থাকব আমার হাত পায়ের শেকল। অনুভব করতে থাকব আমার ডানা দুটো কাটা, একটি শক্ত খাঁচার ভেতরে বসে আছি অনন্তকাল ধরে।
অথবা একটি খাঁচা আমার ভেতরে বসে আছে ঘাপটি মেরে, আমাকেই দলামোচা করে পোরে ভেতরে, যখন উড়াল দিতে চাই।
১৬. মুবাশ্বেরা ঠাণ্ডা হয়ে পড়ে ছিল শাদা বিছানায়
মুবাশ্বেরা, বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে, বাড়ির মানুষদের তাজ্জব করে দিয়ে মরে গেল, বৃহষ্পতিবার রাতে। মুবাশ্বেরাকে আমি দেখেছি আমাদের বাড়ি ও বেড়াতে এলে অথবা পীর বাড়িতে আমি গেলে। ওর সঙ্গে মিছিমিছির চুলোপাতিও আমার খেলা হয়েছে আমাদের উঠোনে, ছাদে। আর ওর বাড়িতে চুলোপাতি খেলার নিয়ম যেহেতু নেই, ও খেলেছে কারবালা যুদ্ধ, মুবাশ্বেরা হাসান, মহাম্মদ হোসেন। এয়াজিদ আর মাবিয়াকে ওরা ঘুসি ছুঁড়ত, লাথি মারত, শূন্যে। কারণ কেউই এয়াজিদ বা মাবিয়া হতে চাইত না। আমি ছিলাম ওদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার একমাত্র দর্শক।
ফজলিখালার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমার সখ্য হয়নি কোনওদিন, খুব দূরের মনে হত ওদের। ওরা, আমরা যে স্বরে ও সুরে কথা বলি, বলে না, বলে অবাঙালির মত, উর্দু টানে। ওরা, পাঁচ বছর বয়সেই নামাজ রোজা শুরু করে, ন বা দশে পৌঁছে বোরখা পরে। ওরা ইস্কুলে যায় না, মাঠে দৌড়োয় না, বাড়ির বাইরে বেরোয় না একা, কারণ ওদের মুরব্বিরা বলে দিয়েছ ওসব করলে আল্লাহ নারাজ হবেন।
মুবাশ্বেরার যখন পনেরোর মত বয়স, আবু বকরের ইস্পাতের কারখানাটি তখন পীর বাড়ির সম্পত্তি। আবু বকর আল্লাহকে সাক্ষী রেখে কারখানাটি লিখে দিয়েছেন পীর আমিরুল্লাহর নামে। পিঁপড়ের মত লোক ভিড় করে পীরের মজলিশে, পীর নিজে পছন্দ করে, খাঁটি আল্লাহভক্ত লোক বেছে কারখানার চাকরিতে ঢোকান। টুটু আর শরাফমামা তখন লেখাপড়া আস্তাকুড়ে থুয়ে পীরবাড়িতে ঢুকেছেন। ফজলিখালা নিজের ভাইদের দুনিয়াদারি ছাড়িয়ে আল্লাহর পথে আনতে পেরে খুশিতে আটখানা। প্যান্ট শার্ট ছেড়ে টুটু আর শরাফ মামা পাজামা পাঞ্জাবি পরেন, মাথায় গোল টুপি পরেন, দাড়িমোচ চাছেন না। দুনিয়াদারির ছিঁটেফোঁটা শেকড় যা আছে উপড়ে ফেলতে ছোট ছোট ঘরগুলোয় বসে হুমায়রা, সুফায়রা, মুবাশ্বেরা ওঁদের নছিহত করে। হেদায়েতের মালিক আল্লাহ। হঠাৎ একটি নছিহতের ঘরে ঢুকে আমাকে টুটু মামার ধমক খেয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। টুটু মামা শুয়েছিলেন, আর হুমায়রা পাশে বসে তাঁর বুকে হাত বুলিয়ে নছিহত করছিলেন। নছিহত করতে হয় অমন একলা ঘরে, বুকে হাত বুলিয়ে, ঘর অন্ধকার করে। মা অমনই বলেছিলেন। শরাফ মামাকে নছিহতের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল মুবাশ্বেরা। এ তো আর পর পুরুষকে নছিহত করা নয়, নিজের মামাকে করা। ওই নছিহত করার কালেই মুবাশ্বেরাকে জিনে ধরল। এই জিন আবার অন্যরকম, গাছের তলায় বসে একা একা কাঁদে। কেন কাঁদে, কাউকে বলে না কিছু। খেতে রুচি নেই, বমি বমি লাগে, নামাজ রোজায় রুচি নেই, কেবল গাছের তল খোঁজে। নছিহতে ভাঁটা পড়ে। সেই খলবলে মেয়ে, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা মেয়ে মুবাশ্বেরা বিছানা নিল। জিন তাড়ানোর ব্যবস্থা করার আগেই তার গা পুড়ে যাওয়া জ্বর। পানি পড়া খাওয়ানো হয়, নানা রকম সুরা পড়ে ফুঁ দেওয়া হয় গায়ে, জ্বর তবু সারে না। ফজলিখালা মুবাশ্বেরার মাথা কোলে নিয়ে বসে থাকেন। কপালে জলপট্টি দেন, জলপট্টি থেকে ধোঁয়া বেরোতে থাকে গায়ের আগুনের। মুবাশ্বেরার শ্বাস কষ্ট হতে শুরু হয়।