ফুলবাহারি মানুষের কথায় তেমন আস্থা রাখে না। কালো ঘাড় সে টান টান করে রাখে যখন কথা বলে।
পঞ্চাশের মন্বন্তরে হাশেম মামা জন্মানোর পর নানির দুটো ছেলে পর পর জন্ম নিয়ে জ্বিনের বাতাস লেগে মরেছিল, মা সে কথা স্মরণ করেন ঠান্ডার বাপের বাতাস লাগার পর। ছেলে পাতলা পায়খানা করছে, বুকের দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, কবিরাজ এসে ফুঁ দিয়ে গেল, বলল সাহাবউদ্দিনের বাড়ির জামগাছটিতে যে জিন বসে থাকে, সেই জিনেরই বাতাস লেগেছে ছেলের গায়ে। নানিকে বলা হল চামড়া আর লোহা সঙ্গে রাখতে। চামড়া বা লোহা দেখলে জিন ভেড়ে না। নানি এক টুকরো চামড়া, ভাঙা এক লোহা হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরোন, রান্নাঘরে, পেশাবখানায় যেখানেই যান। জিন যদি আবার নানির কাধেঁ চড়ে ছেলের সামনে হাজির হয়, তাই ঘরের ভেতরে ঢুকেও নানিকে ডিঙোতে হত আগুন, মুড়া ঝারু দিয়ে গা ঝেড়ে নিতেন নিজের, যেন শরীরের আনাচ কানাচে লুকিয়ে থাকা দুষ্ট জিন বিদেয় হয়। এত করেও অবশ্য ছেলেদুটো বাঁচেনি। ছেলে জন্ম দেওয়ার পর মা’র জন্যও একইরকম আয়োজন করেছিলেন নানি, ঘরে আগুন জ্বেলে রাখতেন, মা পেশাব পায়খানা করতে ঘরের বাইরে গেলে মুড়া ঝাড়ু নিয়ে বসে থাকতেন ঘরে, ফিরে এলে মা’কে আগুন টপকে আসতে বলতেন, এলে হাতের ঝাড়ু দিয়ে গা ঝেড়ে দিতেন। একই আয়োজন জ্বিনের বাতাস থেকে সন্তান বাঁচানোর।
আমি জন্ম নিলে মা’র আগুন টপকে ঘরে ঢোকা দেখে বাবা বলেছিলেন এইগুলা আবার কি কর?
করতে হয়, মা বলেন বাচ্চার বাতাস লাগলে দুধ খাওয়া ছাইড়া দিব, আমাশা হইয়া মরব।
মা’র চার ছেলেমেয়ে আমরা দিব্যি বেঁচে আছি। কেউ আমরা দুধ ছাড়িনি, আমাশা হলেও, মরিনি। কারও গায়ে জিনের বাতাস লাগেনি। মা অবশ্য আলহামদু লিল্লাহিল্লাযি খালাকাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা ওয়া জায়ালাজ জুলুমাতে ওয়াননূর, ছুম্মাল্লাযীনা কাফারু বিরাব্বিহিম ইয়াদিলুন বলে বলে তাবৎ রোগ থেকে নিজেকে এবং ছেলেমেয়েদের বাঁচিয়েছেন বলে অনেককে বলেন, বাবাকেও। বাবা শুনেও শোনেননি ভাব করেন। ঠান্ডার বাপের রোগ সারার পর বস্তি থেকে বাতাস লাগার খবর কমে এল, আর মাঝে মাঝে যে সব বাতাস লাগা দু’চারজনকে দেখেন বাবা, সারিয়ে ফেলেন ওষুধে, কারু কারুকে আবার হাসপাতালে পাঠান। সুস্থ হয়ে ফিরে আসে ওরাও।
ফুলবাহারি এ বাড়ির কাজ ছেড়ে দেবার পর জ্বরে ধরল তাকে। এবার আর জিনের বাতাস কেউ বলল না। এতদিনে আল্লায় একটা কামের কাম করছে। লাজ শরম একদম আছিল না বেটির। ধপধপাইয়া হাঁটত। জ্বরে ভুইগা যেন এই বেটি মরে আল্লাহ। মসজিদের ইমাম সেরে যাওয়া ঠান্ডার বাপের বাহুতে তাবিজ লাগিয়ে দিয়ে বলে গেলেন। জ্বর হয়েছে খবর পেয়ে ফুলবাহারিকে দেখতে যাব বললে মা আমাকে কানের লতি টেনে বললেন ঠ্যাং লম্বা হইয়া গেছে, টই টই কইরা খালি ঘুরাঘুরির তাল!
আমার আর দেখতে যাওয়া হয়নি ফুলবাহারির জ্বর। জ্বর সারলে শুনি ফুলবাহারির বিয়ে হয়ে গেছে বস্তিরই এক ফোকলা দাঁতের বুড়ো, বয়স সত্তর মত, ঘরে তিনটে বউ আছে, তার সঙ্গে। ফুলবাহারির বিয়ের জন্য তার মা টাকা চাইতে এল নানির বাড়ি। নানি তাকে, দেখলাম, আঁচলের খুঁট খুলে পাঁচ টাকা বার করে দিলেন। আরও দুটো তিনটে বাড়ি থেকে টাকা যোগাড় করে ফুলবাহারির জন্য একটা লাল শাড়ি কেনা হল। বুড়োকে দেওয়া হল দু’শ টাকা যৌতুক। ফুলবাহারিকে আমার মনে হল, হঠাৎ যেন বড় দূরে সরে গেছে। তাকে আর আমাদের রান্নাঘরের বারান্দায় অলস বিকেলে বিড়ি ফুঁকতে দেখব না, তার সঙ্গে আমার গল্পও আর হবে না আগের মত। ফুলবাহারি এখন আর কারও বাড়িতে বান্দিগিরি করবে না। সে তার স্বামীর জন্য রাঁধবে বাড়বে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে কলসি কাঁখে পুকুরে যাবে পানি আনতে। ফুলবাহারিকে এমন রূপে, আমার মনে হয় না, ঠিক মানায়। ওর ধপধপাইয়া হাঁটাটিই ছিল সুন্দর। রাস্তার ছোকরারা ওর পেছন পেছন নেচে নেচে চুতমারানির বেডি বলেছিল যেদিন, আমার চোখের সামনে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফুলবাহারি চড় কষিয়েছিল এক ছোকরার গালে। আমি মুগ্ধ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, হাতে ধরা গ্যাস বেলুনটি কখন উড়ে গিয়েছিল আকাশে, টের পাইনি।
বেল গাছ তলা ধরে যেতে যেতে গোধূলির ধূলির মত আবছা আঁধারে মিশে যেতে যেতে ফুলবাহারির মা বলে–ফুলবাহারিডারে মাইরা ফেলছে হের জামাই, গলা টিইপা। কান্দি না। কাইন্দা কী লাভ। কানলে কি আমার ফুলবাহারি ফিইরা আইব! আল্লায়ই বিচার করব।
বেদেনির ঝুড়ি থেকে বের হয়ে এক বিশাল অজগর তার বিশাল হাঁ মুখে আমাকে গিলে ফেলে যেন। এক বোবা বিকট কষ্ট আমাকে আমি শতটুকরোয় ছিঁড়তে থাকে, আমার নিজের গুঁড়ো গুঁড়ো কষ্টকে থেতলে ফেলে বুকের পাটায়। ভেতরে শব্দ শুনি ঘসঘসসস ঘসসসস।
১৫. কবিতার অলিগলি
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
বড় মামা বলেছিলেন উঠোন ভরা জ্যোৎস্নার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে। পূর্ণিমার চাঁদকে রুটি বলাতে কানামামু জলচৌকিতে বসা কানামামু সোহরাব রুস্তমের গল্প থামিয়ে বড়মামার কথায় থেমে, হেসে–কে খাইতে চায় রুটি, কার পেটে এত ক্ষিদা! জিজ্ঞেস করেন।
–হাজার হাজার গরিব মরে না খাইয়া।
বড়মামা খড়ম পায়ে খট খট হেঁটে উঠোনে, বলেন।
কেউ যেন শুনতে না পায় বলেছিলাম
–পেড়ে দাও চাঁদরুটি, কিছু খাবো, বাকিটুকু বস্তিতে বিলাবো।