সকালে খাঁচা ভরে মিষ্টি কিনে আনেন নানা, আশে পাশের বাড়ি থেকে দল বেঁধে লোক আসে রবিউল আওয়াল মাসের বারো তারিখে জন্মানো মেয়ে দেখতে, রাজকন্যা দেখতে।
বড় হয়ে মা’র মুখে গপ্প শুনতে চাইলে মা গপ্প কিচ্ছা না বলে প্রায়ই বলতেন তরে পেডো লইয়া কলপারে পিছলা খাইয়া পইড়া গেছিলাম। ভিতরে লইড়া গেছিলি, উল্টা হইছস। গোল টেবিলটার উপরে তরে শোয়াইয়া রাখছিল, এত বড় যে গোল টেবিল, তার অর্ধেক হইলি তুই। এরম বড় বাচ্চা আর কেউ দেখে নাই। মা কইত বাচ্চারে কাপড় চোপড়ে মুইড়া রাখ, কপালে নজর ফোঁটা দে। মাইনষের চোখ লাগব। দুই দিনের বাচ্চা দেইখা সোহেলির মা চোখ কপালে তুইলা কয়, কয় মাসের বাচ্চা এইটা? মনুর মা তর গুল মাথাডা দেইখ্যা কইল, বেলেরও ত এট্টু এবাডেবা আছে, এর কিচ্ছু নাই।
শুয়ে থাকা মা’র পেটের ওপর থুতনি রেখে বলেছিলাম–বাচ্চা কেমনে হয় মা?
মা শাড়ি সরিয়ে এঁটেল কাদার মত নরম পেট দেখিয়ে বলেছেন–এইখানটায়, তুমার বাবা, ডাকতার তো, ব্লেড দিয়া কাইটা বাচ্চা বার করছে।
তলপেটের শাদা দাগগুলো, একটি একটি করে দেখিয়ে বলেন, এইটা হইল নোমান হওয়ার, এইটা কামালের, এইটা তোমার আর এইটা ইয়াসমিনের।
করুণ চোখে তাকিয়ে থাকি শাদা দাগের দিকে। আলতো আঙুল বুলোই। মা’র জন্য বড় মায়া হয় আমার। বলি–ইস, রক্ত বার হয় নাই?
মা হেসে আমার চিবুকে টোকা দিয়ে বললেন–তা হইছে। পরে সেলাই কইরা দিলে আবার ভালা হইয়া গেছি।
খানিক পর আমাকে টেনে বুকে শুইয়ে মা বললেন–আমি মইরা গেলে তুমি কানবা, মা?
আমি ডানে বাঁয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিলাম–তুমি মরবা না। তুমি মইরা গেলে আমিও মইরা যাব।
মা তাঁর উল্টো-মেয়েকে কোলে নিয়ে আনাজপাতি কোটেন, চুলোয় খড়ি গোঁজেন, ধোঁয়ায় জল জমে চোখে তাঁর। কোলের মধ্যে শুয়ে মেয়ে তাঁর ঘুমোয়, আবার জেগে ওঠে হলুদের, মরিচের, পিঁয়াজের আর তার মা’র ঘামের গন্ধে, কাকের কুকুরের শব্দে। মা কলঘরে গোসলে গেলে উঠোনে হিসির ওপর, ধুলোর ওপর একা বসে মুখে পুরতে থাকে ইটের টুকরো, বালু, কড়ইপাতা। দাদারা ইস্কুল থেকে ফিরে কাঁখে নিয়ে উঠোনে হাঁটেন। ছ’মাসের মেয়েকে কুয়োর ওপর বসিয়ে হাফপ্যান্টের ফিতে বাঁধেন ছোটদা। খানিকটা হেললেই কুয়োর জলে ডুবে টুপ করে মরে যেতে পারে কিন্তু পড়ে না, যে মেয়ে অমন ঝুঁকি নিয়েও জন্মেছে সে কেন কুয়োর জলে মরবে! আদরে, আহলাদে, হেলায় ফেলায় বড় হতে থাকে রাজকন্যা।
হ্যাঁ রাজকন্যা বড় হতে থাকে। বড় হতে হতে বয়স যখন এগারো, মা সেলাই মেশিনে ঘড়ঘড় শব্দ তুলে আমাকে পাজামা বানিয়ে দিলেন দু’জোড়া, বললেন এখন থেকে আমার আর হাফপ্যান্ট পরা চলবে না।, আমি বড় হয়ে গেছি। উতল দুটো চোখ জানালার বাইরে পাঠিয়ে মন খারাপ করা দুপুরে মা আমাকে বলেন–তহন আমার মাথা খারাপ, সারাদিন কান্দি। তর বাপে রাজিয়া বেগমের প্রেমে পড়ছে। তার শার্ট ধুইতে গিয়া প্রায় দিনই বুক পকেটে চিঠি পাই, ওই বেটির লেখা। তুই খাটের ওপর থেইকা ধপাস ধপাস পড়স মাটিতে। মাথা ফাটে। তরে যত্ন করার মন নাই তহন আমার। কুনো কিছুতে মন বসাইতে পারি না। রাত কইরা বাড়ি ফিরে তর বাপ।
রাজিয়া বেগম দেখতে সুন্দরী, সুন্দরী মানে হচ্ছে, মা’র সংজ্ঞায়, গায়ের রং ফর্সা। রাজিয়া বেগমের ফর্সা মুখে গরুর চোখের মত কালো ডাগর চোখ, ঠোঁট কমলার কোয়ার মত ঝুলে থাকে, কোমর অবদি ঘন কালো চুল, খোঁপা করলে মনে হয় মাথায় ডালি নিয়েছেন, স্তনদু’খানা এত বড় যে মনে হয় বইতে কষ্ট হচ্ছে, সিন্ধি গাভিদেরও কষ্ট হয় বড় ওলান নিয়ে হাঁটতে। রাজিয়া বেগমকে কখনও না দেখে কেবল অনুমান করেই আমার মনে হয়েছিল যে দোয়ালে ঠিক দু’বালতি দুধ বের হবে ওর বুক থেকে। শরীর তো নয়, যেন ছোটখাট একটি পাহাড়। হাঁটলে মাটি কাঁপে। মা’র কালো রং, নারকেলের আর্চির মত এতটুকুন মাথায় ফিনফিনে চুল, ছোট ছোট চোখ, ভোঁতা নাক, ফড়িংএর ঠ্যাঙের মত টিঙটিঙে শরীর থেকে, মা ভাবেন, বাবার মন উঠেছে। মা হাতের কাছে যাকে পান তাকেই বলেন, সব্বনাশ হইছে, আমার সব্বনাশ হইছে। নোমানের বাপ তো এহন চাকলাদারের বউরে বিয়া করব। আমি পোলাপান নিয়া কই যাই!
মা’র সেই সব্বনাশের কালে, হেলা ফেলায় আমার মাথার গোল গেল ডেবে, বাসি দুধে, সাগুতে বার্লিতে, দাদার কণে আঙুল চুষে চুষে আমি যখন এগারো মাসে পড়ি, বাবা বদলি হলেন। যেন জাহান্নামের আগুনে পুড়ছিলেন, ফেরেসতা এসে জানালেন মা’কে জান্নাতুল ফেরদাউসে পাঠানো হবে, বদলির খবর শুনে মা’র তাই মনে হয়, ফূর্তিতে নাচেন মা। আলাদা একটি সংসারের স্বপ্ন মা’র বহুদিনের। দুর্মুখের মুখে ঝাঁটা মেরে, বাবার ঘরজামাই দুর্নাম ঘুচিয়ে, এঁদো গলির ভেতর খলসে মাছে ভরা পুকুর পাড়ের ছোট্ট ঘুপসি ঘর ফেলে, রাজিয়া বেগম নামের এক দুঃস্বপ্ন নর্দমায় ছুঁড়ে দূরের একটি শহরের দিকে রওনা হলেন মা।
জেলখানার ভেতর একটি চমৎকার বাড়ি জুটেছিল মা’র। কয়েদিরা জেলের ডাক্তারের বাড়িতে ফুট ফরমাশ খাটে সকাল বিকেল, মেয়ে কোলে নিয়ে বাগানে বেড়াতে বেরোয়, চোর ডাকাতের কোলে চড়েও মেয়ের গলার সোনার মালা গলাতেই থাকে। অবসরে মা চুল বাঁধেন, চোখে কাজল পরেন, মুখে পাউডার মাখেন, কুঁচি কেটে রঙিন শাড়ি পরেন। পাবনায় রাজিয়া বেগম নেই, বাবার রাতে রাতে বাড়ি ফেরা নেই, শার্টের পকেট থেকে টুপ করে কোনও প্রেমের চিঠি পড়া নেই। পড়শিদের সঙ্গে খাতির জমে ওঠে মা’র, বাড়ি বাড়ি নেমন্তন্ন খেয়ে বেড়ান। সুখের চৌবাচ্চায় ডুবে থাকেন ডাক্তারের বউ। সুখ বেঁধে রাখেন চাবির সঙ্গে আঁচলের গিঁটে। তবুও বুকের খুব ভেতরে মা’র অসুখ জমে। সম্মোহের নিচে সংশয়, হর্ষের বাগানে হতাশা। স্বামী তাঁর অসম্ভব সুদর্শন পুরুষ, লাখে একজন, তায় ডাক্তার, আর নিজে তিনি সাত ক্লাস অবদি পড়া কালো কুচ্ছিত মেয়ে। তের বছর বয়সে ইস্কুল বন্ধ করে তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। বড় ছেলে যখন ইস্কুলে যায়, বায়না ধরলেন তিনিও যাবেন। বাবা তাঁকে হারকিউলাস সাইকেলে বসিয়ে ইস্কুলে দিয়ে আসতেন। আপত্তি তুললেন নানা, সাফ সাফ বলে দিলেন, ঘরে বইসা পুলপান মানুষ কর। স্বামীর যত্ন নেও। মাইয়া মানষের অত নেকাপড়া করার দরকার নাই। ব্যস, ইস্কুল বন্ধ করতে হল আবার। বাবা সাই সাই করে ওপরে ওঠেন, মা যে তিমিরে, সে তিমিরেই, সাত ক্লাসের জ্ঞানে, বুদ্ধিতে। বাবার মোটা মোটা ডাক্তারি বই মা খুলে খুলে দেখেন, ঝেড়ে মুছে গুছিয়ে রাখেন, বোঝেন স্বামীর তুলনায় অতি নগণ্য, অতি তুচ্ছ এক মানুষ তিনি। তাঁর আশংকা হয় বাবা তাঁকে হঠাৎ একদিন ছেড়ে কোথাও চলে যাবেন। আশংকার নীল মুখে মা শাদা পাউডার মাখেন, ছোট চোখজোড়া কাজলে কালো করে রাখেন যেন ডাগর লাগে দেখতে, যেন নিতান্ত কদাকার বলে কিছু না মনে হয় তাঁকে।