- বইয়ের নামঃ আমার মেয়েবেলা
- লেখকের নামঃ তসলিমা নাসরিন
- বিভাগসমূহঃআত্মজীবনী
০১. যুদ্ধের বছর
ক.
যুদ্ধ বাঁধছে। এ পাড়ায় গুঞ্জন, ও পাড়ায় গুঞ্জন। লোক জট পাকাচ্ছে উঠোনে, মাঠে, গলির মোড়ে। কারও চোখ কপালে, কারও নাকের তলায়, হাঁ করা মুখের ভেতর, কারও গালে, কানে, মাথায়। চোখ সবার খোলা। চোখের সামনে দৌড়োচ্ছে লোক, দৌড়োচ্ছে আলোয়, অন্ধকারে। কাচ্চা বাচ্চা বোঁচকা বুচকি কাঁখে নিয়ে, ঘাড়ে নিয়ে, দৌড়োচ্ছে। পালাচ্ছে। পালাচ্ছে শহর থেকে গ্রামে। ময়মনসিংহ শহর ছেড়ে ফুলপুর, ধোবাউড়া, নান্দাইল। দালানকোঠা, দোকানপাট, ইস্কুলঘর, অমরাবতী নাট্যমন্দির ছেড়ে নদীর ওপারে, ধানক্ষেতে, ধুধু মাঠে, অরণ্যে। ঘর থেকে যারা দু’পা নড়তে চায় না, হৈ হৈ পড়ে গেল তাদের মধ্যেও, বোঁচকা বাঁধ। শকুনেরা ঠোঁটে করে গন্ধ আনছে মরা মাংসের। গুলির শব্দ ভেসে আসছে কবুতরের অস্থির ডানায় করে। মানুষ পালাচ্ছে পায়ে হেঁটে, রেলগাড়িতে, নৌকোয়। ঘরের মত পড়ে থাকে ঘর, উঠোনে গাছগাছালি, জলচৌকি, দা বটি, কালো বেড়াল।
দুটো তিন চাকার মেশিন চালানো গাড়ি এসে থামে আমাদের বাড়ির দরজায়, সন্ধেয়। ওতে চড়ে আমরাও রওনা দিই পাঁচরুখি বাজারের দক্ষিণে মাদারিনগর গ্রামে। শহর ছেড়ে যেই না ফেরি করে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে শম্ভুগঞ্জে পৌঁছই, কোমরে গামছা বাঁধা, ঝোপ থেকে ঝাঁপিয়ে রাস্তায় নেমে ছ’জন যুবক আমাদের নাকের সামনে দাঁড়ায়। দু’হাতে মা’কে আঁকড়ে বিস্ফারিত চোখে দেখি ছ’টি বন্দুক, ছ’টি কাঁধে। অনুমান করি এরই নাম যুদ্ধ, আচমকা পথ আটকে মানুষ মেরে ফেলা। ছ’জনের একজন, নাকের নিচে চিকন কালো মোচ, বলে, গলা ঢুকিয়ে তিন চাকার খোলা দরজায়, শহর খালি কইরা যান কই! সব চইলা গেলে আমরা কারে লইয়া যুদ্ধ করুম! বাড়ি ফিইরা যান। মা বোরখার ঘোমটা তুলে, এক ছটাক রোষের ওপর দু’ছটাক আকুতি মিশিয়ে বলেন, এ কি কন! সামনের গাড়ি তো চইলা গেল। আমার ছেলেরা ওই গাড়িতে। আমাদের যাইতে দেন।
মন গলে না মোচঅলার। কাঁধের বন্দুক মাটিতে ঠুকে চেঁচায়, এক ইঞ্চিও সামনে নড়ব না চাক্কা। পিছাও।
গাড়িকে পিছিয়ে ফেরিতে উঠিয়ে বিড়ি ধরিয়ে গন্ধ ছড়িয়ে কাঁচাপাকা চালক বলে, এরা বাঙালি, আমগোরই লোক, এরা তো আর পাঞ্জাবি না, ডরের কিছু নাই। বুক ধুকপুক করে যেন ছ’টি বন্দুক থেকে ছ’জোড়া গুলি এসে রেগেছে বুকে। দু’পাশে ঠেসে বসা কালো বোরখায় ঢাকা দু’জনের সুরা পড়ার বিড়বিড় আর তিন চাকার ঘড়ঘড় শব্দ শুনতে শুনতে পার হতে থাকি জুবলি ঘাট, গোলপুকুর পাড়। আর কোনও শব্দ নেই, কেবল আমাদের ধুকপুক, বিড়বিড়, ঘড়ঘড়। রাতের কম্বল মুড়ে আলো নিবিয়ে ঘুমিয়ে গেছে পুরো শহর।
সে রাতেই তিন চাকার গাড়িকে বাবা আবার পাঠিয়ে দিলেন পুবের বদলে পশ্চিমে, মাদারিনগরের বদলে বেগুনবাড়ি। গাড়ির ভেতর ঘুমিয়ে পড়ে ইয়াসমিন, ছটকু। মা ঝিমোন, জেগে থাকেন আমার সঙ্গে নানি আর নানির হাতে শক্ত করে ধরা নীল প্লাস্টিকের ঝুড়ি।
ঝুড়ির ভিতরে কি গো নানি?
নানি ঠাণ্ডা গলায় বলেন, চিঁড়ামুড়ি, গুড়।
বেগুনবাড়ি গ্রামে কলাগাছ ঢাকা যে বাড়িটির কাছে আমাদের বিড়িখোর চালক গাড়ি থামায়, সেটি রুনু খালার শ্বশুর বাড়ি।
পিলপিল করে মানুষ বেরিয়ে উঠোনে কুপি উঁচু করে আমাদের দেখে।
শহর থেইকা ইষ্টি আইছে।
কুয়া থেইকা পানি তুলো।
ভাত রান্দো।
পান সাজো।
বিছনা পাতো।
পাঙ্খা কর।
পাতা বিছানায় আড়াআড়ি করে শুই শহরের ইষ্টিরা। ঘুমে কাদা ছটকুর ঠাং আমার ঠ্যাংএর ওপর, ঠ্যাং সরালে পেটে গুঁতো খাই ইয়াসমিনের হাঁটুর। চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে মিনমিন করি, কোলবালিশ ছাড়া ঘুমাইতে পারি না।
ঘামাচি ওঠা গায়ে পাখার বাতাস করতে করতে মা তাঁর ছিঁদকাঁদুনে মেয়ের ঢং শুনে গলা চেপে ধমকান, কোলবালিশ লাগব না, এমনি ঘুমা।
ধমক খেয়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা চুপ হয়। চৌকির এক কিনারে গুটিসুটি শুয়ে আছেন নানি, কালো পাড় শাড়িতে ঢাকা তাঁর মুখ মাথা, প্লাস্টিকের ঝুড়ি, চিঁড়ামুড়ি গুড়। চৌকাঠে টিমটিম জ্বলে কুপি, কুপির আলোয় টিনের বেড়ায় পাঁচ হাত পাঁচ পা ছড়িয়ে ভূত নাচে আর হুসহুস ডাকে। দেখে দু’হাঁটুর ভেতর মুখ ডুবিয়ে বলি মা ও মা, আমার ডর করে মা।
কোনও সাড়া নেই মা’র, ঘুমিয়ে ছটকুর মত কাদা।
ও নানি, নানি গো।
নানিও রা করেন না।
ভূতের বিদ্যেয় আমার হাতেখড়ি শরাফ মামার কাছে। এক রাতে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ফিরে তিনি বলেছিলেন, পুস্কুনির পাড়ে দেখলাম শাদা কাপড় পরা একটা পেত্নী খাড়োয়া রইছে, আমার দিকে চাইয়া পেত্নী একটা বিজলি দিল, আর আমি লেঙ্গুর ফালাইয়া দৌড়।
শরাফ মামা ঠিরঠির কেঁপে লেপের তলায় ঢুকে যান, আমিও। শামুকের মত শুয়ে থাকি সারারাত।
পরদিনও এরকম ঘটনা নিয়ে ফেরেন মামা। বাঁশঝাড়ের তল দিয়ে হেঁটে আসছেন, কোথাও কেউ নেই, কিন্তু মামদো ভূতের গলা শুনলেন–কিরেঁ শরাঁফ যাঁস কঁই? এঁকটু থাঁম। উর্ধ্বশাসে দৌড়ে এসে ঠাণ্ডা পানিতে সেই কনকনে শীতের রাতে গোসল করেন। বাড়িতে শরাফ মামার খাতির বেড়ে যায়। আমি, ফেলুমামা, টুটুমামা তাঁকে ঘিরে বসে থাকি অর্ধেক রাত অবদি। হাত-পাখায় তাঁকে বাতাস করেন পারুল মামি। নানি গরম ভাতের সঙ্গে শিংমাছের ঝোল বেড়ে আনেন ভূত দেখা ছেলের জন্য, পাতের কিনারে নুন। কানা মামুর বড়শিতে ইয়া বড় বড় মাছ উঠত। আস্তা মাছ লইয়া কুনওদিনও বাড়ি ফিরতে পারে নাই মামু। এক রাইতে দেখে পিছন পিছন এক বিলাই আইতাছে। মামুর কান্ধের উপরে মাছ। মামু হাঁটে বাড়ির পথে, হঠাৎ হালকা হালকা লাগে কান্ধের মাছ। ফিইরা দেখে মাছের অর্ধেকটা নাই, আর বিলাইটাও হাওয়া। আসলে তো বিলাই না, ওইটা ছিল মাউছ্যা ভূত, বিলাইয়ের রূপ ধইরা মাছ খাইতে আইছিল।