মওলানা এনায়েত আলী ও মওলানা চেরাগ আলীর তবলিগে এ অঞ্চলের যাঁরা শরা কবুল করিয়াছিলেন, তাঁদেরও সকলের ফরাযী পদবি নাই। তারা আগের মতই শেখ, খা, সর্দার, মণ্ডল, তরফদার, তালুকদার ইত্যাদি পারিবারিক পদবি লইয়াই থাকিতেন। শুধু আমাদের পরিবারেরই ফরাযী’ পদটি আসিল কোথা হইতে? এ অঞ্চল হইতে একমাত্র আমাদের পরিবার থনেই একজন মোজাহিদ বাহিনীতে ভর্তি হইয়াছিলেন, সে কারণেই কি উক্ত আলেমগণ আমাদের পরিবারকেই ‘ফরাযী’ লকব দিয়াছিলেন? তাও নয়। আমাদের পরিবার ছাড়াও এ অঞ্চলে আরো তিন-চার ঘর ‘ফরাযী আছেন, অথচ তাদের পরিবার হইতে কেউ জেহাদে যান নাই।
প্রচলিত প্রবাদ অনুসারে প্রকৃত ব্যাপার এই যে মওলানা এনায়েত আলী ও মওলানা চেরাগ আলী সাহেবদের হাতে ও মওলানা মাহমুদ আলী সাহেবের সাক্ষাতে এ অঞ্চলের যে চারটি পরিবার সর্বপ্রথম শরা কবুল করিয়াছিলেন, শুধু তাদেরেই ফরাযী লকব দেওয়া হইয়াছিল। এই চারি পরিবারের মধ্যেই পরবর্তীকালে বিবাহ-শাদির সম্পর্ক স্থাপিত হইয়াছিল। আমার দাদার পিতা আছরউদ্দিন সাহেবের সাথে একই সময়ে যে তিনজন শরা গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁদের একজন মহব্বত উল্লা, দ্বিতীয়জন খোদা বখশ, তৃতীয়জন জাবু। শরা কবুল করিয়া এঁরা যথাক্রমে আছরউদ্দিন ফরাযী, মহব্বত উল্লা ফরাযী, খোদা বখশ ও জাবু ফরাযী নামে পরিচিত হন। আছরউদ্দিন ফরাযীর কনিষ্ঠ পুত্র আরমান উল্লা ফরাযীর জ্যেষ্ঠ পুত্র আমার পিতা আবদুর রহিম ফরাযী সাহেব পরবর্তীকালে মহব্বত উল্লা ফরাযীর পুত্র মেহেরুল্লা ফরাযীর কন্যা মীর জাহান খাতুনকে বিবাহ করেন। ইনিই আমার মা। খোদা বখশ ফরাযীর পুত্র জলিল বখশ ফরাযী আমার নানা মেহেরুল্লা ফরাযীর পিতা মহব্বত উল্লা ফরাযীর এক কন্যাকে বিবাহ করেন। জাবু ফরাযীর জ্যেষ্ঠ পুত্র আবদুল গফুর ফরাযীর নিকট বহুকাল প্রায়, ষাট বছর, পরে গাজী আশেক উল্লা সাহেব তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যাসন্তান ফাতেমা খাতুনকে বিবাহ দেন। এইভাবে গোড়ার চার ফরাযী পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হইয়াছিল।
শরা কবুল করিয়া আমার প্রপিতামহ আছরউদ্দিন সাহেব ‘ফরাযী’ হইবার আগে তাদের পারিবারিক পদবি ছিল মাদারী। তাঁর বাবার নাম ছিল ফালু মাদারী। দাদাজীর কথিত মতে তাদের এই পদবি বংশানুক্রমিক। নয় পুরুষের নাম তিনি জানিতেন। গড়গড় করিয়া একদমে নয় পুরুষের নামও বলিতেন। সকলের নাম আজ আমার মনে নাই। কোনো কাগজপত্রেও লেখা নাই। তারা কেউ লেখাপড়া জানিতেন বলিয়া মনে হয় না। দাদাজীর কওয়া এবং তার সমবয়সী বুড়াদের সমর্থিত মাত্র চারটি নাম আমার মনে আছে। তদনুসারে ফালু মাদারীর বাপ ছিলেন কালু মাদারী, তার বাপ ছিলেন ছাবু মাদারী ও তাঁর বাবার নাম লেদু মাদারী। এঁদের ধারাবাহিকতারও গ্যারান্টি আমি দিতে পারিতেছি না। ছেলেবেলার শোনা কথা আশ্চর্য রকম স্মরণ থাকে। এই দাবিতেই নামগুলি বলিতেছি, কিন্তু দাদাজীর কওয়া নয়টি নামের মধ্যে মাত্র চারটির উল্লেখ করিতেছি বলিয়া আমার নিজের মনেও সন্দেহ আছে, পূর্বপুরুষদের পারম্পর্য ঠিকমত উল্লিখিত হইল কি না। তবে তাদের সকলের পদবি যে মাদারী ছিল, তাতে সন্দেহ নাই। মাদারী পদবি ছিল কেন, সে বিষয়ে দাদাজী ও গ্রামের বুড়া মুরুব্বিরা একই কথা বলিতেন। তাই এখানে তার উল্লেখ করিতেছি।
.
৩. শরা কবুলের আগে
শরা জারি হইবার আগে আমাদের অঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে পীরপূজা, গোরপূজা ইত্যাদি যেসব বেশরা প্রথা প্রচলিত ছিল তার মধ্যে ‘মাদার পূজা’ ছিল প্রধান। এবং এটা বার্ষিক মচ্ছব। হিন্দুদের মহোৎসবেরই এটা অপভ্রংশ নিশ্চয়। পূজা কথাটাও মুসলমানদের মধ্যে সাধারণভাবে প্রচলিত ছিল। কালু গাজীর মত মাদার গাজীও মুসলমানদের কিংবদন্তির ‘হিরো’ ছিলেন। তবে ‘মাদার পূজা’ বা কোনো পূজাতেই কোনো মূর্তিপূজা হইত না।
প্রতিবছর ধান মাড়াই হইবার পরই, সাধারণত মাঘ মাসে এই ‘মাদার পূজার মচ্ছব’ হইত। খুব লম্বা সোজা একটা আস্ত বাঁশ খাড়া করিয়া গাড়া হইত। বাঁশটির আগাগোড়া নিপিস করিয়া চাছিয়া-ছুলিয়া সুন্দর করা হইত। শুধু আগার দু’ একটা কঞ্চি পাতা-সুদ্ধা রাখিয়া দেওয়া হইত। ঐ কঞ্চির নিচেই একগোছা পাট বাঁধা হইত। এই পাটের গোছাটি কোনো বছর মেজেন্টর লাগাইয়া লাল রং করা হইত। কোনো বছর নীল লাগাইয়া নীল রঙা করা হইত। এই রং বদলানোর কোনো ধর্মীয় কারণ ছিল, না একটার অভাবে আরেকটা লাগানো হইত, দাদাজী তা বলিতে পারিতেন না। যা হোক, বাঁশের আগায় ঐ লাল-নীল রঙের একগোছা পাট ঝুলানো হইত এবং বাঁশটির আগাগোড়া চুন-হলুদ ও গোড়ায় হলুদ ও সিন্দুরের ফোঁটা দেওয়া হইত। বাঁশের গোড়ায় অনেকখানি জায়গা জুড়িয়া উঁচা ভিটি বানানো হইত এবং তা লেপিয়া-পুঁছিয়া ফিটফাট করা হইত। তিন দিন ধরিয়া এই বাঁশটি খাড়া থাকিত। এই তিন দিন ধরিয়াই এই বাশ ঘিরিয়া ঢাল-তলোয়ারসহ নাচিয়া কুঁদিয়া ঢোল-ডগর যোগে মাদারের গান, গাজীর গান ও জারিগান গাওয়া হইত। এই তিন দিনই, বিশেষত প্রথম দিন এই বাঁশের চারদিক মেলা বসিত। মেলায় অনেক জিনিস বিকিকিনি হইত।
‘মাদার পূজার’ পুরোহিতকে মাদারী বলা হইত। তিনি ছিলেন গ্রামের ধর্মীয় গুরু। তিনি ছুঁইয়া না দেওয়া পর্যন্ত বাঁশ খাড়া হইত না। তিনি আবার চুঁইয়া না দেওয়া পর্যন্ত বাঁশ নামানো হইত না। মাদার বাঁশ খাড়া করিবার পর মাদারী সাহেব বাঁশের গোড়ায় ভিটিতে লাল রঙের নয়া গামছা পাতিয়া বসিয়া থাকিতেন। দর্শকেরা সেই গামছায় যার-তার নজর দিত। তৎকালে টাকা আধুলির প্রচলন খুব কমই ছিল। অধিকাংশেই কড়ি, আধলা, পয়সা, ডবল পয়সা ও বড়জোর আনী-দুআনী ব্যবহার করিত। মাদারীর নজরেও কাজেই তা-ই ফেলিত। কিন্তু ঐরূপে যে পয়সা জমা হইত, তাতেই মাদারী সাহেবের সম্বৎসর চলিয়া যাইত।