হান্টার সাহেবের বর্ণনায় দেখা যায়, তৎকালে এই জিলার ফরাযীদের প্রাধান্য ছিল। এ সম্পর্কে স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্টস-অব-বেঙ্গল-এর ৪০৯ পৃষ্ঠায় হান্টার সাহেব লিখিয়াছেন :
In Farazis centre much of the wealth and influence of the district some of its members being large landlords. Many of the poorer of the Farazis were formerly known as sympathisers of the Whabi’s disaffection and a small number went from Mymensingh to the rebel camp beyond our North Western frontiers for the purpose of co-operating with the fanatics of that part of the country.
অর্থাৎ ফরাযীদের হাতেই এখন এ জিলার ধনসম্পদ ও প্রভাবের অনেকখানি কেন্দ্রীভূত। তাদের কয়েকজন বড় বড় জমিদার। ফরাযীদের মধ্যকার অপেক্ষাকৃত গরীব শ্রেণীর অনেকেই ওহাবি বিদ্রোহের সমর্থক ছিল বলিয়া জানা যায়। এদের মধ্যে অল্প কয়েকজন সীমান্তপারের ধর্মান্ধদের সাথে সহযোগিতা করিবার উদ্দেশ্যে ময়মনসিংহ হইতে উত্তর-পশ্চিম পারের বিদ্রোহী শিবিরে যোগ দিয়াছিল।
হান্টার সাহেবের বর্ণিত এই ‘অল্পসংখ্যক লোক আসলে কতজন ছিলেন, তা আজও জানা যায় নাই।
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গবেষকেরা একদিন সে খবর দেশবাসীকে দিতে পারিবেন, তাতে সন্দেহ নাই। ইতিমধ্যে এই অহংকার আমি কিছুতেই গোপন। করিতে পারিতেছ না যে, আমার পূর্বপুরুষের একজন ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি ছিলেন আমার দাদাজীর জ্যেষ্ঠ সহোদর গাজী আশেক উল্লা সাহেব।
.
২. পূর্বপুরুষ
সম্ভবত ১৮২৭-২৮ সালের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে মওলানা সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরেলভীর চার খলিফার অন্যতম মওলানা এনায়েত আলী স্থানীয় খলিফা মওলানা চেরাগ আলীসহ তবলিগ উপলক্ষে ধানীখোলা তশরিফ আনেন। তাদের প্রচারকালে আমার দাদার বাবা আছরউদ্দিন, আমার নানার বাবা মহব্বত উল্লা ও তার বেহাই খোদাবখশ এবং সোনাখালী মৌযার জাবু নামক এক ব্যক্তি, এই চারজন মওলানা সাহেবের হাতে শরা কবুল করেন। এটাকে মুরিদ হওয়া বলা হইত না। কারণ এঁরা পীর-মুরিদির বিরোধী ছিলেন। এই চারজন পূর্বেকার বংশ পদবির স্থলে ফরাযী’ পদবি লাভ করেন। স্বভাবতই সামাজিক ক্রিয়াকলাপে এরা পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ। হইয়া পড়েন। পরবর্তীকালে মহব্বত উল্লা ফরাযীর পুত্র মেহের উল্লা ফরাযীর এক মেয়েকে আমার বাবা আবদুর রহিম ফরাযী বিবাহ করেন। খোদা বখশ ফরাযীর পুত্র জলিল বখশ ফরাযী মেহের উল্লা ফরাযীর এক বোনকে বিবাহ করেন এবং জাবু ফরাযীর পুত্র আবদুল গফুর ফরাযী আমার দাদার বড় ভাই গাজী আশেক উল্লার মেয়েকে বিবাহ করেন।
যা হোক, মওলানা এনায়েত আলী ও মওলানা চেরাগ আলীর হাতে শরা গ্রহণের সময় আছরউদ্দিন ফরাযীর তিন পুত্র ছিলেন : জ্যেষ্ঠ আশেক উল্লা, মধ্যম আরয উল্লা, কনিষ্ঠ আরমান উল্লা। জ্যেষ্ঠ আশেক উল্লার বয়স তখন অনুমান আঠার-উনিশ। সবেমাত্র মুখ ভরিয়া দাড়ি-মোচ উঠিয়াছে। তিনি তখন। স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়িতেন। মওলানাদ্বয়ের প্রেরণায় আশেক উল্লা সাহেব সৈয়দ আহমদ শহীদের মোজাহিদ দলে ভর্তি হন এবং তাঁদের সঙ্গে সরহদ্দে চলিয়া যান। দাদাজী আরমান উল্লার বয়স তখন মাত্র আট-দশ বছর।
এই ঘটনার সময়কাল ১৮২৭-২৮ সাল অনুমান করা হয় এই জন্য যে আমাদের পারিবারিক প্রবাদ মোতাবেক আশেক উল্লা সাহেবের মোজাহিদ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পাঁচ বছর পরেই বালাকোটের যুদ্ধ হয়। বালাকোটের যুদ্ধ হয় ১৮৩১ সালের মে মাসে। বড় ছেলে ইসলামের জন্য জান দিয়া শহীদ হইতে অথবা গাজী হইতে গিয়াছে, এই জন্য আছরউদ্দিন ফরাযীর মর্যাদা প্রতিবেশীদের কাছে এবং আলেম-ওলামাদের কাছে বাড়িয়া যায়। তিনি স্থানীয় ফরাযীদের মাতব্বর হন।
হান্টার সাহেবের কথা অন্তত আমাদের বংশ সম্বন্ধে মাত্র অংশত সত্য। প্রথমত আমাদের পারিবারিক পদবি ফরাযী ছিল সত্য; কিন্তু আমার মুরুব্বিরা কেউ হাজী শরিয়ত উল্লা বা তার পুত্র দুদু মিয়া সাহেবের মুরিদ ফরায়েযী’ ছিলেন না। দ্বিতীয়ত, তারা নিজেদের ওহাবি বলিয়াও স্বীকার করিতেন না। আমার দাদা আশেক উল্লা সাহেব যে মোজাহিদ বাহিনীতে যোগ দিয়াছিলেন, সেটাকেও তারা ওহাবি আন্দোলন বলিয়া মানিতেন না। তৃতীয়ত, আমার দাদা গাজী আশেক উল্লার সাথে এ জিলার আরো যারা জেহাদে গিয়াছিলেন, তাদের কয়েকজনের পরিবারের সাথে পরবর্তীকালে আমাদের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হইয়াছে। তাঁরা কেউই হাজী শরিয়ত উল্লার ফরায়েযী জমাতের লোক নন। তবে হান্টার সাহেবের উক্ত-মত আমাদের পূর্বপুরুষেরা সত্যিই গরীব কৃষক শ্রেণীর লোক ছিলেন। বস্তুত, আমার শৈশবে মুরুব্বিদের ফরায়েযী’ ও ‘ফরাযী’ শব্দ দুইটার পার্থক্য সম্বন্ধে অতিশয় সচেতন দেখিয়াছি। কেউ তাদের ফরায়েযী’ বলিলে তারা মুখে আপত্তি করিতেন, মনে কষ্ট পাইতেন এবং অনেক সময় চটিয়াও যাইতেন। এই ভুল আমাদের সমাজের বা আত্মীয়-স্বজনদের কেউ করিতেন না। আমাদের স্কুল-মাদ্রাসায় শিক্ষকতা ও মাঠে-মসজিদে ওয়ায-নসিহত করিতে বরিশাল, নোয়াখালী এবং ঢাকা হইতে অনেক আলেম-ওলামা আসিতেন এবং আমাদের বাড়িতে মেহমান হইতেন। ঢাকা হইতে যেসব আলেম আসিতেন, তাঁদের সবাই আমাদের জমাতি ছিলেন। নোয়াখালী হইতে আগত আলেমরা সবাই ছিলেন হানাফি জমাতের। একমাত্র বরিশাল জিলা হইতে আগত আলেমরা আধাআধি হানাফি এবং আধাআধি মোহাম্মদী, মানে আমাদের জমাতের লোক ছিলেন। মোহাম্মদী আলেমদের কেউই আমাদের ‘ফরায়েযী’ বলিতেন না। ফরাযীই বলিতেন। কোনো হানাফি আলেমও আমাদেরে ‘ফরায়েযী’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন না। হানাফি আলেমদেরেও আমাদের অঞ্চলে খুবই তাজিম ও সম্মান করা হইত। বস্তুত, আমাদের বাড়ির মাদ্রাসায় শিক্ষকদের বেশির ভাগ হানাফি ছিলেন। তারা আমাদেরে উর্দু-কি পহেলি কিতাব পড়াইবার পরই নামাজ-রোযা-হালাল-হারাম শিখাইবার জন্য রাহে-নাজাত ও মিফতাহুল জান্নাত পড়াইতেন। তবে পড়াইবার সময় তারা তাহরিমা বান্ধা, জোরে আমিন কওয়া, রেকাতে-রেকাতে বসা, রুকুতে নিচা ও উঁচা হওয়ার সময় রফাদায়েন করা ইত্যাদি ব্যাপারে হানাফি মোহাম্মদী মতের পার্থক্য বুঝাইয়া দিতেন। এঁদের মধ্যেই কেউ কেউ প্রথম প্রথম আমাদের পরিবারকে যখন ফরায়েযী পরিবার বলিতেন, তখনই আমার মুরুব্বিরা আপত্তি করিতেন। তর্কও হইত। কিন্তু আমি তখন ওসব কিছুই বুঝিতাম না। তার অনেক পরে আমি যখন শহরের ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ি, তখন সিটি স্কুলের আরবি-ফারসি টিচার জনাব মৌ. মাসুম আলী সাহেব আমাদের মেসের সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন। তিনিই প্রথম আমাকে এলমা করিয়া ফরায়েযী’ ও ‘ফরাযী’ শব্দ দুইটির পার্থক্য বুঝাইবার চেষ্টা করেন। কারণ তিনি নিজেও একজন ফরাযী ছিলেন। তাকে কেউ ফরায়েযী বলিলে তিনি কঠোর প্রতিবাদ করিতেন। তিনি আরবি ব্যাকরণের বিভিন্ন সংজ্ঞার উল্লেখ করিয়া আমাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। আমি নিজে তখন ফারসি পড়িতাম বলিয়া তার সব কথা বুঝিও নাই, যাও বুঝিয়াছিলাম তাও মনেও নাই সব। তবে যেটুকু মনে আছে এবং বাড়িতে গিয়া যতটুকুতে চাচাজীর অনুমোদন পাইয়াছিলাম তা এই যে ফরিযা’ শব্দটার বহুবচন ফরায়েয হইতে ফরায়েযী’ শব্দটির উৎপত্তি হইয়াছে। কিন্তু ফরাযী’ শব্দটা আসিয়াছে সোজাসুজি ফরয ইতে। বিশেষত ফরায়েযী’ শব্দটা পদবি হিসাবে ব্যবহারের অসুবিধাও ছিল। মুসলমান উত্তরাধিকার আইন মোতাবেক শরিকদের প্রাপ্য অংশের হিসাবকেও ফরায়েয করা বলা হইত জনগণের স্তরেও। সেজন্য ফরায়েযী শব্দটার একাধিক অর্থবোধক বিভ্রান্তির আশঙ্কা ছিল। তাছাড়া হাজী শরিয়তুল্লা সাহেবের অনুসারী ফরায়েযীরা গ্রামে জুম্মা ও ঈদের জমাত করা নাজায়েয মনে করিতেন। অথচ আমাদের জমাতের লোকেরা গ্রামে জুম্মা ও ঈদের নামাজ পড়া অবশ্যকর্তব্য মনে করিতেন। আমাদের বাড়িতেই জুম্মার মসজিদ ছিল। তাতে সারা গায়ের ছেলে-বুড়া জুম্মার নামাজ পড়িতেন। ছেলেবেলায় দেখিয়াছি আশপাশের তিন-চার গাঁয়ের লোকেরা এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান মাতব্বর ইউসুফ আলী মৃধা সাহেবের বাড়ির সামনের বিশাল মাঠে খুব বড় ঈদের জমাতে শামিল হইত। দাদাজীর মুখে শুনিয়াছি তিনি বাপের আমল হইতেই ঐ ঈদগাতেই ঈদের জমাত করিয়া আসিয়াছেন। আজকাল অবশ্য সে ঈদের মাঠ ভাঙ্গিয়া চার-পাঁচটা মাঠ হইয়াছে। যা হোক আমাদের পরিবারের ‘ফরাযী’ পদটি যে হাজী শরিয়তুল্লা-দুদু মিয়া সাহেবদের অনুসারী ফরায়েযী নয়, আশা করি এতেই তা পরিষ্কার হইল। তবে প্রশ্ন। থাকিয়া যায়, আমাদের পরিবারের ফরাযী’ পদবিটি আসিল কোথা হইতে? এ সম্পর্কে কোনো লিখিত দলিল প্রমাণ নাই। সবই দাদাজী ও তার সমবয়সী লোকজন ও তৎকালীন আলেম-ফাযেলদের মুখে শুনা কথা। তাঁদের কথা হইতে বুঝা যায় যে, সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরেলভীর অন্যতম খলিফা মওলানা এনায়েত আলী, মওলানা চেরাগ আলী ও তাদের স্থানীয় সহকর্মী দেলদুয়ারের মওলানা মাহমুদ আলী তরিকায়ে-মেহাম্মদিয়ায় তবলিগ কাজে এই অঞ্চলে আগমন করেন। তারা অনেক সময় আমাদের বাড়িতেই রাত কাটাইতেন। এঁদের প্রচারের ফলেই এ অঞ্চলের লোকেরা ক্রমে-ক্রমে শরা কবুল করেন। শরা কবুল করা মানে ইসলাম গ্রহণ নয়। কারণ আগে হইতেই এ অঞ্চলের বিশেষত ধানীখোলা গ্রামের বিপুল মেজরিটি মুসলমান ছিলেন। কাজেই উপরিউক্ত আলেমরা এ অঞ্চলে ‘শরা’ জারি করিতে আসিতেন, ইসলাম প্রচারে আসিতেন না। তাঁদের প্রচারকালে ধানীখোলা গ্রামের প্রায় আধাআধি লোক কালক্রমে শরা’ কবুল করেন। এঁরা সকলেই মোহাম্মদী জমাতভুক্ত। পরবর্তীকালে ১৮৩১ সালে সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরেলভী ও তাঁর অনেক সহকর্মী এবং খলিফাঁদের কেউ-কেউ বালাকোটের যুদ্ধে শাহাদতবরণ করিলে আহমদ শহীদের পাঁচ খলিফার অন্যতম মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী সাহেব নিজে এবং তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে প্রধান মওলানা আবদুল আউয়াল সাহেবানের তবলিগের ফলে এতদঞ্চলের অনেক মুসলমান শরা কবুল করেন। তবে এঁরা প্রায় সকলেই হানাফি মযহাবভুক্ত।