তাছাড়া প্রকৃত আত্মজীবনী শুধু একটি ব্যক্তির জীবনকথা নয়। আমার মত নগণ্য ব্যক্তির ত নয়ই। আত্মজীবনী-লেখক যে শ্রেণীর লোকই হউন না কেন, তার জীবনকথা মানেই তার শৈশবের পরিবেশের কথা। বংশ ও পরিবারের পরিবেশটাই ব্যক্তি-জীবনে সবচেয়ে গুরুতর প্রভাবশালী পরিবেশ। এ বিষয়ে আমি এই পুস্তকের ভূমিকায় আরো বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছি। এখানে এইটুকুর উল্লেখই যথেষ্ট যে, ভূমিকায় যে ব্যক্তিত্ব, শখছিয়াত বা পার্সনালিটির কথা বলিয়াছি, তার অর্ধেক বাপ-মা পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার, আর অর্ধেক পরিবেশের দান। কাজেই ব্যক্তিমাত্রেই পিতৃ-পুরুষ ও পরিবেশের নিকট সমভাবে ঋণী–সে ঋণের আনুপাতিক হার যা-ই হোক না কেন। কাজেই আত্মজীবনী বুঝিতে হইলে যার জীবনী সে ব্যক্তিটিকে বুঝিতে হইবে। ব্যক্তিটিকে বুঝিতে হইলে ঐ দুইটিও বুঝা দরকার। তাই সবাই এ কাজটা করেন। আমিও করিলাম।
ময়মনসিংহ জিলা। ত্রিশাল থানা। ধানীখোলা গ্রাম। এই গ্রামই আমার জন্মভূমি। বর্তমানে এটা বিশাল গ্রাম, একই গ্রামেই একটা ইউনিয়ন। ধানীখোলার উত্তরে গোপাল নগর, দক্ষিণে ত্রিশাল, পূর্বে বৈলর ও পশ্চিমে রাধাকানাই। এই চারটা গ্রামও এক-একটি ইউনিয়ন। এই চৌহদ্দির মধ্যে ধানীখোলা ইউনিয়নের আয়তন কমবেশি পঁচিশ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা প্রায় বিশ হাজার। দুইটি নদী। একটির নাম সুতোয়া। অপরটির নাম নাগুয়া। সুতোয়াই বড়। বেগুনবাড়ি রেলস্টেশনের নিকট ব্ৰহ্মপুত্র হইতে বাহির হইয়াছে। ধানীখোলার পূর্ব সীমার আগাগোড়াই এই নদী। দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হইয়া অন্য নদীর সহিত মিশিয়া অবশেষে শীতলক্ষ্যাতে পড়িয়াছে। এই দৈর্ঘ্যে ইহার উভয় তীরে বহু বাজার-বন্দর আছে। কিন্তু শুধু সুতোয়া নামেই ইহার দৈর্ঘ্য বিশ মাইলের বেশি। আমাদের ছেলেবেলা এই নদীতে বছরের বার মাস বড় বড় নৌকা চলিত। তার মধ্যে পাঁচ শ মণ হইতে হাজার মণের পালওয়ালা নৌকাও অনেক থাকিত। এখন এই নদীর উপর চারটা পাকা ব্রিজ হইয়া যাওয়াতে আগের মত বড় নৌকার আর যাতায়াত নাই।
অপর পক্ষে নাগুয়া খুব ছোট নদী। উত্তর দিকে ধলি বিল নামক একটি বিল হইতে বাহির হইয়া ধানীখোলাকে উত্তর-দক্ষিণে সমান দুই ভাগে ভাগ করিয়া ক্ষীরো নদীতে পড়িয়াছে। ইহার দৈর্ঘ্য দশ মাইলের বেশি হইবে না। আমাদের ছেলেবেলায় এই নদীতেও বার মাস পানি থাকিত। মালবাহী নৌকাও চলাচল করিত। এখন অনেক জায়গাতেই তীরবর্তী সব গাছপালা কাটিয়া ফেলায় এবং নদীর ঢালুতে ফসলাদি আবাদ শুরু হওয়ায় নদীটি অতিশয় ক্ষীণ হইয়া পড়িয়াছে।
ধানীখোলা গ্রামে মৌযার সংখ্যা বাইশটি। একই গ্রামে দুইটা হাই স্কুল, দুইটা মাইনর স্কুল ও ছয়টি প্রাইমারি স্কুল আছে। এছাড়া একটি ডাক্তারখানা, সরকারি কৃষি ফার্ম, কমিউনিটি সেন্টার, মিলন সমাজ, পাবলিক পাঠাগার, তাঁতের স্কুল, তহসিল কাছারি, বাজার ও পোস্টাফিস আছে।
কিন্তু এক শ বছর আগে ধানীখোলা এর চেয়েও উন্নত ছিল। এর মর্যাদা আরো উঁচা ছিল। তখন ধানীখোলা ছিল ময়মনসিংহ জিলার পাঁচটি উল্লেখযোগ্য শহরের একটি। এ সম্পর্কে তৎকালীন সরকার প্রকাশিত প্রামাণ্য পুস্তক স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্টস-অব-বেঙ্গলএর উল্লেখ করা যায়। পুস্তকের লেখক বিখ্যাত স্ট্যাটিসটিশিয়ান ও ঐতিহাসিক ডবলিও ডবলিও হান্টার। বইখানা প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ ইংরেজি সনে। তার আগের বছর মানে ১৮৭৪ সালের বিবরণ এতে আছে। এই পুস্তকের ৪১৪ পৃষ্ঠায় ময়মনসিংহ জিলার পাঁচটি বৃহত্তম শহর’ এই শিরোনামার যে তালিকা দেওয়া হইয়াছে তাতে যথাক্রমে নাসিরাবাদ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও ধানীখোলার নাম আছে। দেখা যায় অধিবাসী-সংখ্যার ভিত্তিতেই শহরগুলির মান নির্ণীত হইয়াছিল। এই পাঁচটি শহরের মধ্যে নাসিরাবাদ শহর সারা জিলার ও সদর মহকুমার, জামালপুর শহর জামালপুর মহকুমার, কিশোরগঞ্জ শহর কিশোরগঞ্জ মহকুমার হেডকোয়ার্টার ছিল। কেবল শেরপুর ও ধানীখোলাই ছিল বেসরকারি শহর। সরকারি শাসনক্ষেত্রে শহর গড়িয়া উঠা খুবই স্বাভাবিক নিশ্চিত ব্যাপার। কিন্তু বেসরকারি জায়গায় শহর গড়িয়া উঠা কম কথা নয়। হান্টার সাহেবের হিসাবমত দেখা যায়, ঐ সময়ে ধানীখোলা শহরে মোট বাসেন্দা ছিল ছয় হাজার সাত শ ত্রিশ। তার মধ্যে মুসলমান ছিল চার হাজার ছয় শ পঁয়ত্রিশ, হিন্দু ছিল দুই হাজার পঁচানব্বই, খৃষ্টান বা অন্য কোনো ধর্ম সম্প্রদায়ের লোক ধানীখোলায় ছিল না। অধিবাসী সংখ্যা সামান্য নয়। কারণ জিলার হেডকোয়ার্টার নাসিরাবাদ শহরের লোকসংখ্যা ছিল তখন দশ হাজার আটষট্টি জন মাত্র।
এই সময় ময়মনসিংহ জিলার মাত্র চারটি মহকুমা ছিল–সদর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ ও আটিয়া। বর্তমানের নেত্রকোনা মহকুমা তৎকালে সদর মহকুমার এলাকাভুক্ত ছিল। আটিয়া মহকুমাই পরে টাঙ্গাইল মহকুমা ও আরো পরে টাঙ্গাইল জিলা হয়। আটিয়া শহরই আটিয়া মহকুমার প্রধান নগর ছিল। কিন্তু একটি মহকুমার হেডকোয়ার্টার হইয়াও আটিয়া উল্লেখযোগ্য শহরের তালিকাভুক্ত হইতে পারে নাই। কারণ আটিয়া মহকুমা ও তার হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয় মাত্র ১৮৬৯ সালে। তার আগে পর্যন্ত আটিয়া মহকুমা জামালপুর মহকুমার এলাকাভুক্ত ছিল। জামালপুর মহকুমাই এই জিলার সর্বপ্রথম মহকুমা। এটি স্থাপিত হয় ১৮৪৫ সালে। জামালপুর মহকুমা স্থাপিত হওয়ার আগে পর্যন্ত সারা জিলা নাসিরাবাদ হইতেই শাসিত হইত। নাসিরাবাদ শহরে জিলার হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয় ১৭৬৮ সালে।