কিন্তু আমার নিজের মত এই যে আমার মত গরীব গৃহস্থের সন্তানের জন্য রাজনীতির ভিতরের চেয়ে বাহিরের জীবনই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতির ভিতরের চেয়ে বাইরেই করিবার মত কাজ ও বলিবার মত কথা আমার অনেক বেশি ছিল ও আছে। আমার অতৃপ্তি আজও বলে আমার করার কাজ ও বলার কথা আজও শেষ হয় নাই। অবশ্য সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীর মতই রাজনীতির ক্ষেত্রে আমারও নেতা, পথপ্রদর্শক ও সহকর্মী ছিলেন। সেখানে ছিলাম আমি পার্টি মেম্বর, অনেকের একজন। কিন্তু রাজনীতির বাইরে ছিলাম আমি একা ও একক। চিন্তায় ও কাজে আমার নিজের পথ সেখানে আমাকেই নির্দেশ করিতে হইয়াছে। আমার চিন্তার বিষয়বস্তু আমাকেই ঠিক করিতে হইয়াছে। এক কথায়, আমি নিজেই এখানে আমার নেতা ও পথপ্রদর্শক। আমার দায়িত্বও এখানে একক। সে দায়িত্বও কাজেই কঠিন। আমার সে দায়িত্ব পালনে আমার সাফল্য-অসাফল্য দুইটাই পাঠকদের জন্য শিক্ষণীয়। রাজনীতির বাইরের আমার জীবন কাজেই যেমন বিস্তৃত, তেমনি গভীর। আজকার এই আত্মকথায় আমার সেই জীবনই বর্ণিত হইয়াছে। এইটি লেখার পর অতিবাহিত হইয়াছে পাক্কা দশ বছর। কাজেই দক্ষতা, ক্ষমতা, জ্ঞান, মতবাদ ও ধ্যান-ধারণার অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছে আমার এই দীর্ঘ মুদ্দতে। কিন্তু যখন যা লিখিয়াছি, অবিকল তা-ই রাখিয়াছি। পরবর্তী জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বা মতবাদের আলোকে আগের লেখার পরিবর্তন বা সংশোধন করিবার চেষ্টা করি নাই। অথচ করিবার যথেষ্ট অবসর ছিল ও আছে। বর্তমানে আমি বিষয়ী অর্থে সম্পূর্ণ নিষ্কর্মা। হাঁটু-ভাঙা আর্থরাইটিস রোগে উকালতি ছাড়িয়াছি। রাজনীতি ছাড়িয়া আমি এডার স্টেটসম্যান, চেম্বার পলিটিশিয়ান বা রাজনৈতিক হরি-ঠাকুর হইয়াছি। সাংবাদিকতা ছাড়িয়া এখন কলামিস্ট বা কমলাকান্ত হইয়াছি। হার্ট স্পেশিয়ালিস্ট ডাক্তারদের নির্দেশে তারও মাত্রা কমাইয়াছি। পলিটিক্যাল হরি-ঠাকুর হওয়ার ব্যাপারে আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছরে অনেক কথা লিখিয়াছি। সাংবাদিকতায় কমলাকান্ত হওয়া সম্পর্কেও এই পুস্তকের সাংবাদিক জীবন-খণ্ডে বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছি। এখানে শুধু এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, এই বই লেখা শেষ করিয়া যখন এই ভূমিকা লেখায় হাত দিয়াছি, তখন আমি স্ত্রী পুত্র-নাতি-নাতনি লইয়া পরম সুখ-শান্তিতে ও যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে প্রচুর অবসরে এমন একটি জীবন যাপন করিতেছি, যখন পদমর্যাদার লোভ লালসা, নিন্দা-প্রশংসা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার ঊর্ধ্বে উঠিয়া সকল ব্যাপারে সচেতন নিরপেক্ষতার ও সকলের প্রতি সদয় ইনসাফের মনোভাব লইয়াই ওপারে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আছি।
আবুল মনসুর আহমদ
ধানমন্ডি, ঢাকা
১০ আগস্ট ১৯৭৩
.
ফিরিস্তি
প্রথম খণ্ড : পটভূমি
অধ্যায় এক : বংশ-পরিচয়
জন্মস্থান, পূর্বপুরুষ, শরা কবুলের আগে, সামাজিক অনাচার, ধুতি বনাম তহবন্দ, গাজী সাহেবের প্রত্যাবর্তন, গাজী সাহেবের তবলিগ, গাজী সাহেবের জনপ্রিয়তা, গাজী সাহেবের বিবাহ ও সন্তানাদি।
অধ্যায় দুই : জন্ম ও শৈশব
জন্ম, স্বাস্থ্য ও ভাগ্য, রোগ ও চিকিৎসা, নিদ্ৰাচর, ঘুমে চিৎকার, আকস্মিক দুর্ঘটনা, শৈশবের কড়াকড়ি, পারিবারিক প্রথা, সমসাময়িক অবস্থা, প্রাচুর্য ও সরলতা, দাদাজীর এন্তেকালের পর, খেলাধুলার স্বাধীনতা, চুরুট-তামাকের কড়াকড়ি।
দ্বিতীয় খণ্ড : শিক্ষাজীবন
অধ্যায় তিন : প্রাইমারি শিক্ষা–বাড়িতে
চাচাজীর নিকট, ইয়াকুব মুনশীর নিকট, পাঠশালায়, স্বদেশি ধুতি, পাঠ্য বিষয়, ধানীখোলা-বৈলর বিরোধ, আলিমুদ্দিন মাস্টার, মাস্টার সাহেবের ছাত্রপ্রীতি, স্বপ্নে মুখরেজ তালাফুয।
অধ্যায় চার : নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা–দরিরামপুর
ত্রিশাল-দরিরামপুর–বনাম ও বেনাম, হেডমাস্টারের নজরে সত্যবাদিতা, হেডমাস্টারের ডাক-হরকরা, হেডমাস্টারের ‘ভুল’, ‘ভুল’ সংশোধন, মহিষ ও মহিষী, পণ্ডিত মশায়ের অভিনব দণ্ড, স্কুলে যাতায়াত, বই-পুস্তকের থলি, থলির সুবিধা, বিপজ্জনক রাস্তা, দুইটি ব্যক্তিত্বের প্রভাব, করোনেশনের পুরস্কার।
অধ্যায় পাঁচ : মাধ্যমিক শিক্ষা–নাসিরাবাদে
মৃত্যুঞ্জয় স্কুল, হিন্দু-মুসলমান পৃথক বেঞ্চি, প্রথম বিরোধ, ঢিলের জবাবে ঢিল, প্রথম মিলাদ শরিফ, বাংলায় মিলাদ, ঢাকা দর্শন, নাম-নামা।
অধ্যায় ছয় : উচ্চশিক্ষা–ঢাকা শহরে
জগন্নাথ কলেজে, যায়গীর-হাকিম সাহেবের বাড়িতে, পথে পাওয়া টাকার সদ্ব্যবহার, কেতাবি সাধুতা বনাম বিষয়ী সাধুতা, হোস্টেল-জীবন বনাম যায়গীর-জীবন, ঢাকার মহল্লা-জীবন, ঢাকা কলেজ–এস এম হোস্টেল, খেলাধুলা, গলা সাধনা, মাধ্যম রকমের ভাল ছাত্র, ল্যাংলি সাহেবের শেষ উপদেশ, সমকালীন শিক্ষা কারিকুলাম, শিক্ষাজীবনের শেষ নাই।
তৃতীয় খণ্ড : ধর্ম-জীবন
অধ্যায় সাত : গোঁড়ামির পরিবেশ
নফলিয়াতের পাবন্দি, শৈশবের বাড়াবাড়ি, টুপি নিষ্ঠা, মযহাবী-বিরোধ, আমার একগুঁয়েমি, প্রথম সংঘর্ষ, মযহাবী বিরোধের তৎকালীন রূপ, করটিয়ার কাহিনী, ময়মনসিংহ শহরে সংঘর্ষ, দাদাজীর উদারতা, গোঁড়ামি ও আদব-লেহায, মযহাবী সংকীর্ণতা মরিয়াও মরে না, আমার জবাব।
অধ্যায় আট : গোঁড়ামির প্রতিক্রিয়া
উদারতার ক্রমপ্রসার, ডা. বিপিন বিহারী সেন, খৃষ্টান, নামাজ রোযার শিথিলতা, কবর-পূজা, পীর-পূজা, ধর্মমত বনাম চরিত্র, সব ধর্ম সত্য, না সব ধর্ম মিথ্যা? খোদা-বিশ্বাস বনাম ধর্মবিশ্বাস, নাস্তিকতা, মি. ল্যাংলির সহনশীলতা, অধ্যাপক ভট্টাচার্য, এ্যাগনস্টিক।