এইখানেই পাঠক আত্মজীবনীকারের অরিজিন জানিতে চান। লেখক ত বলিতে বাধ্য। আত্মজীবনী-লেখক শিল্পী-সাহিত্যিকই হউন, আর রাষ্ট্রনায়কই হউন, তাঁর সম্বন্ধে জানার কৌতূহল মানুষের স্বাভাবিক। এ কৌতূহল শুধু তাঁর সৃষ্ট শিল্পকর্ম বা তাঁর রাজনৈতিক সাফল্য-অসাফল্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পরিবেশিক বিচরণ-আচরণ, বিবর্তন-উদ্বর্তনের ব্যাপারেও প্রসারিত। এই কৌতূহল নিবৃত্ত করা জীবনী-লেখকের কর্তব্য। না করিলে তাঁর কাজ অসম্পূর্ণ থাকিবে। কাজেই কর্তব্যও পালিত হইবে না। এখানেই আত্মজীবনী-লেখকের বংশপরিচয়, সে-বংশের সামাজিক স্তর ও পরিবেশ, তাদের জীবিকা ও জীবনধারণ-প্রণালি, তাদের ধর্মীয় ও কালচারের আচার-আচরণ ইত্যাদি সম্বন্ধে উল্লেখ করা নিতান্ত প্রাসঙ্গিক হইয়া পড়ে। এই প্রাসঙ্গিকতা পাঠকের জন্য যেমন আবশ্যক, লেখকের জন্যও ঠিক তেমনি আবশ্যক। শুধু আবশ্যক নয়, অপরিহার্য। কোনো ব্যক্তির জীবনী সম্যক জানিতে হইলে ব্যক্তিটিকে আগে জানিতে হইবে। ব্যক্তিটির সঠিক পরিচয় পাইতে হইলে তাঁর বংশ-পরিবার, সামাজিক ও আর্থিক পরিবেশ জানিতে হইবে। মানুষের দেহ-মনের ক্রমবিকাশের উপর তার পরিবার ও পরিবেশের প্রভাব সর্বাধুনিক গবেষকেরাও স্বীকার করিয়াছেন। বংশ-পরিবার ও সমাজ পরিবেশ এই দুই-এর মধ্যে ব্যক্তিজীবনে কোনটার প্রভাব বেশি, এ বিষয়ে গবেষক-বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ থাকিতে পারে ও আছে। কিন্তু এ দুই এর সমন্বয় যে ব্যক্তি-জীবনকে মূলত সংগঠিত করিয়া থাকে, এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নাই। এই কারণেও ব্যক্তির পরিবার ও পরিবেশের খবর। জানিতে হয়। আর যেহেতু জীবনী বা আত্মজীবনী লেখা একটা বাস্তবভিত্তিক সৃষ্টিকর্ম, মানে ইতিবৃত্তমূলক শিল্পকর্ম, সেই হেতু বংশ-পরিচয়হীন জীবনকথা বা আত্মজীবনী হয় ত্রুটিপূর্ণ বিকলাঙ্গ শিল্প। আত্মজীবনী-লেখক যদি অভিজাত বংশের লোক হন, তবে বাপ-মার ও বংশের পরিচয় দেওয়া যেমন সহজ, তেমনি আনন্দদায়ক। কিন্তু আত্মজীবনী-লেখক যদি তা না হন, তিনি যদি গরীব, নিরক্ষর, চাষি-মজুরের সন্তান হন, তবে কী হয়। নিজের অনভিজাত বংশের কথা, বাপ-মার নিরক্ষরতা বা দারিদ্র্যের কথা, বলা তত সহজ নয়, আনন্দদায়ক ত নয়ই। কাজেই এ ক্ষেত্রে কাজটা কঠিন। কঠিন বলিয়াই এ শ্রেণীর আত্মজীবনী-লেখকের ব্যক্তিত্ব আরো সবল, আত্মমর্যাদাবোধ আরো তীক্ষ্ণ, সত্যপ্রিয়তা আরো ধারালো হওয়া দরকার। উদ্ববর্তন প্রকৃতির নিয়ম। অতীত হইতে যেমন বর্তমান এবং বর্তমান হইতে যেমন ভবিষ্যতের জন্ম, দাদা হইতে বাপ এবং বাপ হইতে তেমনি বেটার জন্ম। একটা ছাড়া অপরটা হয় না। একটার ইতিহাস ছাড়া অপরটারও ইতিহাস হয় না। কোনো লোকের জীবনী শুধু তাঁর ব্যক্তিজীবনের ঘটনার বর্ণনা, তার ধ্যান-ধারণার বিকলন ও তাঁর কাজ-কর্মের বিবরণ নয়। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে তার আচরণ, এই সব ব্যাপারে তার দেহ-মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও তার বা তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য উল্লেখযোগ্য বিষয়। এই কারণে উক্ত ব্যক্তির জীবনী বা আত্মজীবনী খোলা ময়দানে তাঁর ফটোগ্রাফের সমতুল্য। খোলা ময়দানে কোনো লোকের ফটো নিলে যেমন উপর-নিচের ডাইন-বায়ের ও পেছনের ল্যান্ডস্কেপটা আপনি ফটোতে আসিয়া পড়ে, তেমনি একটি ব্যক্তি-জীবনীর আলেখ্যে তার পিছনের ঐতিহ্যের ছবি ও ডাইনে-বাঁয়ের পরিবেশের রূপ ধরা পড়িতেই হইবে।
আরেকটা কথা বলিয়াই আমার এই ভূমিকা শেষ করিব। আমি আত্মজীবনী লেখিবার উপযুক্ত ব্যক্তি এবং সে জীবনকথা লোকেরা পড়িবেন বা সে বিশ্বাসে প্রকাশক লোকসানের ঝুঁকি না লইয়া তা ছাপিবেন, এমন ধারণার মধ্যে একটা উপলব্ধি আছে। সেটাকে অহংকারও বলা যাইতে পারে। এমন অহংকার ব্যক্তিত্বেরই লক্ষণ। ব্যক্তিত্বহীন লোকের অহংকার থাকিতে পারে না। কাজেই অহংকারটা দোষের নয়। অহংকার প্রকাশের ধরনটাই দোষের। দায়িত্ববোধের উপলব্ধিটাই অহংকার। এটা আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদাবোধ, আত্মসম্মান-জ্ঞানেরই নামান্তর বা রূপান্তর মাত্র। এর একটাও দোষের নয়। কিন্তু অহংকার যখন দম্ভের আকারে প্রকাশ পায়, তখন সেটা শুধু দোষের হয় না, বোকামিও হয়। আমার অহংকার, আমার আত্মবিশ্বাস ও আমার আত্মমর্যাদাবোধ যতক্ষণ তোমার ঐ-ঐ অনুভূতিকে আহত ও অপমানিত না করে, ততক্ষণ আমার এগুলি গুণ, সুতরাং গর্বের বস্তু। কিন্তু যেই এগুলি দম্ভের আকারে তোমার অনুভূতিতে আঘাত করিল, সেই মুহূর্তে সে-গুণগুলি দোষে পরিণত হইল। কাজেই নিজের অহংকার ও আত্মসম্মানবোধ লইয়া অতি সাবধানে চলিতে হয়। এ যেন রশির উপর দিয়া নাচিয়া যাওয়া, টাইট-রোপ-ড্যাসিং। পা ফসকাইয়া, কি ব্যালেন্স হারাইলা, ত গেলা।
এবার আত্মকথার বিষয়বস্তু ও ঘটনাবলি সম্পর্কে পাঠকদেরে একটু আভাস দিবার চেষ্টা করিব। পুস্তকে বর্ণিত ঘটনাবলির বিবরণী স্পষ্টতই স্মৃতিকথা। ব্যক্তিগত ঘটনার প্রায় সবটুকুই এই শ্রেণীর। কিন্তু যেসব ঘটনার সাথে নেতৃবৃন্দ ও বন্ধুবান্ধবদের সম্পর্ক আছে, সেগুলি যথাসম্ভব পুরাতন কাগজপত্র সংবাদপত্রের কাটিং অথবা পকেট-ডায়েরি বা নোটবই হইতে নেওয়া হইয়াছে। এসবেরও বিস্তারিত খুঁটিনাটি স্মৃতিকথাই। তাও আবার বুড়া মানুষের স্মৃতি। শৈশবের কথা লিখিয়াছি এই বুড়া স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করিয়াই বটে, কিন্তু এটাও সত্য যে মানুষের শৈশবের স্মৃতিই বেশি নির্ভরযোগ্য। এ বই লিখিতে শুরু করি ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আইউব শাহির জেলখানায় বসিয়া। অবসরমত আস্তে আস্তে লিখিয়া শেষ করি ১৯৬৮ সালে। পাবলিশারদের ইচ্ছাতে আমার এই জীবনকথার রাজনৈতিক দিকটা আলাদা করিয়া ঐ সালেই আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর নামে প্রকাশিত হইয়াছিল। এই পাঁচ বছরে সে বই-এর তিন-তিনটা সংস্করণ হইয়া গিয়াছে। ক্রমে আকারও তার বড় হইয়াছে। পরাধীন বা ঔপনিবেশিক দেশের মানুষের জীবনের অনেকখানি জুড়িয়া থাকে সক্রিয় রাজনীতি অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই। আমার বেলাও আমার জীবনে রাজনীতি ঢুকিয়াছিল, বরঞ্চ আমিই রাজনীতিতে ঢুকিয়াছিলাম, আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা সক্ষমতা অক্ষমতা উপেক্ষা করিয়াই। এই কারণে আমার রাজনীতির কথা আকারে বড় হইয়াছে তার মূল্য কমই হউক আর বেশিই হউক।