এ বিষয়ে এত কথা বলিবার কারণ এই যে, যে-শিশু যে-পরিবেশে যে ধরনের জীবন গড়ন-যাপনের স্বপ্ন কল্পনাই করুক না কেন, শৈশবে কারো মনে ভবিষ্যতে আত্মজীবনী লিখিবার কল্পনা থাকে না। এ চিন্তা মানুষের মনে। সর্বপ্রথম জাগে তখনই, যখন ব্যক্তিটির জীবন প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। জীবন-নদী প্রায় পার হইয়া আসিয়াছেন। ওপারের ঘাট দেখা যায়-যায়। ঠিক এই মুহূর্তে আত্মজীবনী লেখা মানে জীবন-পথে পিছন ফিরিয়া দেখা। যারা বিনা-ঝড়-তুফানে নিরাপদে স্বাচ্ছন্দ্যের পানসিতে চড়িয়া জীবন-নদী পার হইয়াছেন, তাঁদের পিছন ফিরিয়া দেখিবার কিছু নাই। সুতরাং আত্মজীবনী লিখিবারও কিছু থাকে না। এই দিক হইতে বিচার করিলে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের নিরাপদ জীবন আসলে কোনো জীবনই নয়। অথচ বিপুল অধিকাংশের জীবনই এমনি ধরনের বৈচিত্র্যহীন মামুলি জীবন। কাজেই সমাজের দিক হইতে অর্থহীন জীবন। কিন্তু সংসারের প্যারাডক্স এই যে আমরা অধিকাংশই এমনি জীবন যাপন করিতে চাই। বিষয়ী লোকের বিবেচনায় এটাই আদর্শ জীবন। কাজেই এমন নিরাপদ জীবনই অধিকাংশের কাম্য। যারা এর ব্যতিক্রম, যাদের জীবনসংগ্রাম সংঘাতপূর্ণ, নিরাপদ জীবন। ইচ্ছা সত্ত্বেও যারা যাপন করিতে পারেন নাই, ঝড়-তুফানের সঙ্গে লড়াই করিয়া যাঁদের জীবন কাটিয়াছে, ভব-নদী পার হইতে গিয়া যাদের জীবন তরী ডুবি-ডুবি করিতে-করিতে কিনারা লইয়াছে, তাঁদের মধ্য হইতেই সাধারণত আত্মজীবনী লেখার যোগ্য ও অধিকারী লোকের আবির্ভাব। সে ঝড়ঝঞ্ঝা আদর্শ জীবনযাপনের ইচ্ছাতেই ঘটুক, আর নিছক বিষয়ী জীবনের সাফল্যের সন্ধানেই ঘটুক, উভয় শ্রেণীর লোকেরই আত্মজীবনী লেখার অধিকার জন্মে। উভয়ের জীবনই দুর্বলতা-সরলতা ও ব্যর্থতা-সফলতার মেঘ ও রৌদ্রের জীবন। সংগ্রামের জীবন। সরল ও খোলাখুলিভাবে বর্ণিত হইলে তা অপরের শিক্ষা গ্রহণের জীবন।
এই সংগ্রাম ও নিরাপত্তা, উভয়টারই বিচার হয় জীবনসায়াহ্নে। কাজেই জীবনের অর্থপূর্ণতার উপলব্ধি হয় জীবনের সন্ধ্যাতেই। এই কারণে আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছা ও সংকল্পও জন্মিতে পারে এই মুদ্দতেই। এই জীবন-সন্ধ্যায় দাঁড়াইয়া পিছন ফিরিয়া তাকাইয়া দেখিবার ও বুঝিবার একমাত্র উপায় না হইলেও প্রধান উপায় স্মৃতি। প্রধানত এই স্মৃতির উপর ভরসা করিয়াই আত্মজীবনী লেখকের গোটা জীবনের আশা-নিরাশা, সুখ দুঃখ, সাফল্য-অসাফল্য, ভুল-ত্রুটির খতিয়ান লিখিতে হয়। অথচ এই বয়সে স্মৃতির বাতিটাও অনেকটা ধোঁয়াটে হইয়া যায়। এই ধোয়াটে স্মৃতিতে ভর করিয়াই আত্মজীবনী লিখিতে হয়। লেখাও হয়। কারণ সাধারণ গল্পী লোকের মতই আত্মজীবনীকারদের কথা বলিবার আগ্রহ খুবই প্রবল। কথা বলার চেয়ে লেখা অনেক বেশি শ্রমসাধ্য। তাই এখানে ইচ্ছা-আগ্রহটা হওয়া চাই আরো বেশি প্রবল।
এই প্রবল ইচ্ছার প্রেরণা হইতে পারে দুইটা : এক. সংগ্রাম-সাফল্যের বাহাদুরি করা। দুই. ভাবীকালের লোকদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে নিজের জীবনের কাহিনী বলা। এই দুইটি উদ্দেশ্যই লেখকের সচেতন মনে জাগরূক নাও থাকিতে পারে। অবচেতন মনে গোপন থাকিতে পারে। কিন্তু এই দুই শ্রেণীর আত্মজীবনীর মধ্যেও একটা পার্থক্য আছে। সে পার্থক্য সাবধান পাঠকের কাছে ধরাও পড়ে। একটিতে লেখক বাছিয়া-বাছিয়া শুধু নিজের গুণ ও সাফল্যের কথাটাই প্রধান করিয়া তোলেন। গুণগুলির অতিরঞ্জন করেন। দোষগুলি চাপিয়া যান। অপরটিতে লেখক সত্য ও সরল কথায় নিজের ভাল মন্দ ও দোষ-গুণ উভয়টাই পাঠকের কাছে তুলিয়া ধরেন। সচেতন-অবচেতন মনের দরুনই এ পার্থক্যও লেখকের অজ্ঞাতেই হইতে পারে। বাহাদুরিটাও। অনিচ্ছাকৃত হইতে পারে। আবার বিনয়ের নিরপেক্ষতাটাও চেষ্টাকৃত হইতে পারে। আমাদের মধ্যে যেমন বদ-মেজাজি ও বিনয়ী উভয় প্রকার লোক আছেন এবং এই বদ-মেজাজিদের মধ্যে সাধুতা ও বিনয়ীদের মধ্যে ভণ্ডামি থাকিতে পারে, আত্মজীবনী-লেখকদের মধ্যেও তা-ই আছে। তবু নিজের দোষ উপলব্ধি করা খুবই কঠিন। সেটা মুখে ও কাগজে-কলমে স্বীকার করা আরো কঠিন। এই কারণে আত্মজীবনী লেখার কাজটা এমন কঠিন।
আর অসাধারণ এই জন্য যে যাদের জীবনী জানা ও পড়ার যোগ্য, যাদের জীবনকথা অপরের জন্য স্মরণীয় ও শিক্ষণীয়, যেসব প্রতিভাবান মনীষী, রাষ্ট্রনেতা ও জননায়ক দেশ ও দশের মঙ্গল সাধন করিয়াছেন, তাঁদের আত্মজীবনী লিখিবার দরকারই হয় না। অপরেই তাদের জীবনী লেখেন। তাঁদের সহকর্মী ও অনুসারীরা ত লেখেনই, দেশ-বিদেশের শক্তিশালী লেখকেরাও লিখিয়া থাকেন। যারা ব্যক্তিগতভাবে এই সব নেতা-নায়কদের জানেন না বা দেখেন নাই, তারাও লেখেন। গবেষণা করিয়া তাঁদের জীবনের অজানা কথা, ঘটনা ও বৃত্তান্ত আবিষ্কার করেন।
তবে এই ধরনের জীবনী ও আত্মজীবনীর মধ্যে পার্থক্য আছে। অপরের জীবনী-লেখকেরা সাধারণত তাদের নায়কের জীবনের ভাল দিকটাই দেখান। এই সব লেখক সাধারণত যার-তার নায়কের ভক্ত-অনুরক্ত হওয়ায় তাঁদের লেখা গুণাবলি বর্ণনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। নিতান্ত ভক্ত-অনুরক্ত না হইলে সাধারণ ভদ্রতা ও শালীনতার খাতিরে আলোচ্য ব্যক্তির জীবনের অপর দিকটা চাপিয়া যান। আর ভক্ত-অনুরক্তেরা ত শুধু গুণাবলির বর্ণনা করিবেনই। তাতে কিছুটা অতিরঞ্জনও করিতে পারেন। লেখক-ভেদে এই ধরনের জীবনী উৎকৃষ্ট শ্রেণীর সাহিত্য হইতে পারে, কিন্তু সত্য ও প্রকৃত তথ্যের দিক হইতে এগুলি সত্যনিষ্ঠ, অতএব শিক্ষণীয় না-ও হইতে পারে। পক্ষান্তরে জীবনী লেখক যদি নায়কের বিরোধী পক্ষের লোক হন, তবে তাঁর রচনা হয় প্রধানত নিন্দা-কুৎসা। আলোচ্য ব্যক্তিকে লোকচক্ষে হেয় করিবার অপচেষ্টা। তাতে প্রকৃত ও সত্য জীবনী লেখা হয় না। ফলে অধিকাংশ জীবনী হয় প্রশংসা ও গুণকীর্তন, নয় ত নিন্দা ও ছিদ্রান্বেষণ। কোনোটাই ঐতিহাসিক সত্য হয় না।