.
৬. আকস্মিক দুর্ঘটনা
কিন্তু ইতিমধ্যে আমার শরীরের উপর দিয়া সাংঘাতিক বহু দুর্ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে। তার মধ্যে বড়-বড় কয়টা এইরূপ :
(ক) প্রথম আঘাত পাইয়াছিলাম বাপজীর নিজের হাত হইতে। তিনি একদিন একটা কোদালের আছাড়ি লাগাইতেছিলেন। কোদাল-কুড়ালের আছাড়ি টাইট করিবার জন্য উল্টা দিক হইতে কাঠ বা বাঁশের কচি মারিতে হয়। বাবজি। এই কাজটিই করিতেছিলেন। আছাড়িটা লম্বা হওয়ায় তিনি দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া মুগুর পিটাইয়া কচি ঢুকাইতে ছিলেন। এক হাতে কোদাল ধরিয়া আরেক হাতে পিটাইতে ছিলেন। একটা বাড়ি বেকায়দায় পড়ায় হাত হইতে কোদালটা ছুটিয়া সবেগে উল্টা দিকে মাটিতে গিয়া পড়ে। আমি তখন মাত্র আড়াই বছরের শিশু। সবেমাত্র দৌড়িতে শিখিয়াছি। আমি হঠাৎ কোথা হইতে দৌড়িয়া বাপজীর কাছে আসিতেছিলাম। ঐ কোদাল আসিয়া পড়িল আমার মাথায়। আমি চিৎকার করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেলাম। লহুতে আমার মাথা লাল হইয়া গেল। বাপজী হায় কী করিলাম’ বলিয়া আমাকে কোলে করিয়া বাড়িতে ঢুকিলেন। ভাগ্যিস আমার মাথায় কোদালটার মুখ না লাগিয়া এক পাশ লাগিয়াছিল। মুখ লাগিলে আমার কচি মাথা দুই ফালা হইয়া যাইত। সেটা না হওয়ায় ঐ বিপদেও সকলে সান্ত্বনা পাইলেন এবং আল্লার দরগায় শোকরিয়া জানাইতে লাগিলেন। আমার দাদি ও মা উভয়ের কাটা-ছেঁড়ার ধন্বন্তরি ঔষধ জানিতেন। সেটা পাড়াগাঁয়ে সহজলভ্য একটি গাছড়ার রস। সেই ঔষধ লাগাইয়া আমার মাথায় গালপাট্টা বাধিয়া দেওয়া হইল। এটা সারিতে প্রায় এক মাস লাগিয়াছিল। এই আঘাতের দাগ আজও আমার তালুতে বিদ্যমান রহিয়াছে।
(খ) করাতিরা একবার আমাদের একটা খুব বড় কড়াইগাছ কাটিয়াছিল। সেটা মাটিতে পড়িবার পর কুড়াল দিয়া ওটার ডাল ছাঁটা হইতেছিল। বহু লোক ভিড় করিয়া তামাশা দেখিতেছিল। সে তামেশগিরদের মধ্যে আমিও ছিলাম। তামেশগিররা সকলেই আমার চেয়ে বড় ও লম্বা। কাজেই তামেশগিরের মধ্যে আমি ডুবিয়াছিলাম। অথচ করাতিদের কুড়ালের কোপে একটা ডালের বড় একটা ধারালো টুকরা ভনভন করিয়া উড়িয়া সকল তামেশগিরদেরে ডিঙ্গাইয়া আমার মাথায় বিধিয়া পড়ে। আমি গুরুতররূপে। আহত হইয়া বেহুঁশ হইয়া পড়ি। ধরাধরি করিয়া বাড়িতে আনার অনেকক্ষণ পরে আমার হুঁশ হয়। এটা ঘটে আমার ছয়-সাত বছর বয়সে। এর দাগ আজ পর্যন্ত আমার কপালের দিকে মাথায় আছে।
(গ) তখন আমার বয়স নয়-দশ বছর। সে সময় আমাদের অঞ্চলে অবস্থাপন্ন সব গৃহস্থের বাড়িতেই এক বা একাধিক দৌড়ের ঘোড়া ছিল। শুকনা দিনে মোহররম পর্ব পড়িলে সেই পরবের দিনে অথবা হিন্দুদের চড়কের মেলার সময় পাঁচ গ্রামে ঘোড়দৌড় হইত। আমাদেরও একটা ঘোড়া থাকিত। দুই-এক বছর পর-পর ঘোড়া বদল করা হইত। খুব ছেলেবেলা হইতেই আমার ঘোড়া দৌড়াইবার শখ ছিল। স্কুল হইতে ফিরিবার পর বিকালে মাঠে ব্যাটবল (ক্রিকেট), ডাংগুটি বা কপাটি খেলিতাম। খেলা শেষ করিবার পর এবং মগরেবের নামাজের আগ পর্যন্ত আধঘণ্টা খানেক ঘোড়া দৌড়াইতাম। গ্রামের ঘোড়াওয়ালারাও এই সময় যার তার ঘোড়া লইয়া বাহির হইত। মাঝে মাঝেই একত্রে বাজি রাখিয়া বা আড়াআড়ি করিয়া ঘোড়া দৌড়াইতাম। ঘোড়-সওয়ারদের মধ্যে কিন্তু আমার মত অল্প বয়সের কেউ ছিল না। আমার একটা বিশেষ অভ্যাস ছিল এই যে, মাঠে ঘোড়া দৌড় শেষ করিয়া বাড়ি ফিরিবার পথে আমাদের পুকুরপাড় হইতে তিন-চার রশি দূরে থাকিতেই লাগাম ছাড়িয়া দিয়া ঘোড়র পেটে গোড়াতালি দিতাম। ঘোড়া পবনের বেগে লম্বী দৌড় দিত। আমি লম্বীর সাথে তাল রাখিয়া দুই হাতে তালি বাজাইয়া ঘোড়াকে শাবাশ দিতাম। টাল সামলাইবার জন্য দরকার হইলে এক-আধবার বাম হাতে ঘোড়ার বাক বা গদির ইলট ধরিতাম। টাল সামলাইয়া আবার ছাড়িয়া দিতাম। এটা রোজই করিতাম।
সেদিন দেরিতে বাহির হইয়াছিলাম। কাজেই ফিরিতেও দেরি হইল। বরাবর মগরেবের আযান শুনিয়াই ঘোড়া ফিরাইতাম। এবং মগরেবের জমাতে শামিল হইতাম। আমাদের বাড়ির মসজিদে তৎকালে মগরেব ও এশা এই দুই ওয়াক্তিয়া নামাজেও পাড়ার লোকেরা জমাতে শামিল হইত। সেদিন কিন্তু আযান শুনিয়াই ঘোড়া ফিরাইলাম না। যাই যাচ্ছি করিয়া আও দুই একটি চক্কর দিলাম। অবশেষে ঘাটতি পূরণের আশায় ঘোড়াটিকে বরাবরের চেয়ে তেজের লম্বী দৌড় দেওয়াইলাম। আমার গোড়াতালির জবাবে ঘোড়াটা পিছনের পা দিয়া বাতাসে একটি লাথি মারিয়া বাতাসের আগে ছুট দিল।
আমাদের পুকুরের পুব পাশের প্রশস্ত পাড়াটায় পাট লাড়িবার জন্য সারি সারি বাঁশের আড় বাঁধা ছিল। পাটের মওসুম শেষ হইয়াছে। কাজেই আড়গুলি খোলার সময় হইয়াছে। দুই-এক দিনের মধ্যে খোলা হইবে এই অবস্থা। এই আড়ের সারির মধ্যে দিয়াই প্রশস্ত যাতায়াতের রাস্তা। এই রাস্তা দিয়াই আমি বরাবর অনায়াসে ঘোড়া চালাইয়া থাকি। বাহির হইবার সময়ও এই রাস্তা দিয়াই ঘোড়া দৌড়াইয়া গিয়াছি। বরাত মন্দ। ইতিমধ্যে কোনো কারণে একটা আড়ের বাঁশের গিরো খুলিয়া বাঁশের আগাটা রাস্তার দিকে গলা বাড়াইয়া ছিল। বাঁশের আগাটা ছিল একদম কলম কাটা। অন্ধের মত ঘোড়া ছুটাইয়া যখন এই জায়গায় আসিলাম, তখন হঠাৎ আমার নজরে পড়িল বাশের এই কলমকাটা আগাটা তির বেগে আমার ডান দিকের গলা সোজা আসিতেছে। চক্ষের নিমেষে ওটা আমার গলা ভেদ করিয়া ফেলিবে। লাগাম আমার হাতে ছিল না। কাজেই ঘোড়া থামাইবার প্রশ্ন উঠে না। জৈবিক উৎপ্রেরণা বশে ডাক হাতে ঘোড়ার বাঁক ধরিয়া বাম হাতে বাঁশের আগাটা ঠেকাইবার চেষ্টা করিলাম। কিসে যে কী হইল কিছুই জানিতে পারিলাম না। পরে শুনিয়াছি এবং অনুমান করিয়াছি যে ঘোড়ার গতিবেগে আমার হাতের চাপে বাশের গোড়ার দিকে দুই-একটা গিঁরো ছিঁড়িয়া যায় এবং তাতে বাঁশের আগাটা নুইয়া পড়ে। ফলে বাঁশটা আমার গলায় বা বুকে বিঁধিয়া বাম উরুতে গভীর খাদ করিয়া এক দলা গোশত উল্টাইয়া বাঁ দিকে বাহির হইয়া যায়।