এইভাবে বেশ কিছুকাল যাওয়ার পর বাড়ির সকলের উপদেশে বাপজীর ঘরের কেওয়াড়ে ভিতর থেকে শিকল লাগানো হইল। আমি ছেলেমানুষ। খুব সকাল-সকাল ঘুমাইয়া পড়িতাম। বাবা-মা শোবার সময় দরজার শিকল লাগাইয়া শুইতেন। ঘুমন্ত অবস্থায় আমি শিকল খুলিয়া বাহির হইয়া যাইতাম। কপাটের উপরের চৌকাঠে লাগানো শিকল আমার মত শিশুর নাগালের বাহিরে। তবু সেটা আমি কীরূপে খুলিতাম, এটা সকলের বিস্ময় সৃষ্টি করিত। এ ঘটনায় আমার মুরুব্বিদের, আত্মীয়-স্বজনের ও পাড়া-প্রতিবেশীর মনে আর কিছুমাত্র সন্দেহ থাকিল না যে জিনের আছরেই আমি এসব কাজ করিতেছি। এরপর বাবা-মা পালা করিয়া রাত জাগিয়াছেন। তার মধ্যেও কোন ফাঁকে আমি বাহির হইয়া পড়িয়াছি। বাবা-মার কাছে পরে শুনিয়াছি, বসা অবস্থায়ও তারা যখনই এক-আধটু ঝিমাইয়াছেন, সেই ঝিমানের ফাঁকেই আমি আলগোছে বাহির হইয়া গিয়াছি।
দিনের বেলার একটি ঘটনা এইরূপ : সেদিন আমাদের বাড়িতে ছোটখাটো একটি মেহমানি। বাড়ির পুরুষেরা সবাই বাহির বাড়িতে মেহমানদেরে লইয়া ব্যস্ত। বাড়ির মেয়েরা সকলে রান্না-বাড়ায় অতিরিক্ত খাটুনির পর যোহরের প্রায় শেষ ওয়াতে কেউ গোসল করিতে, কেউ নামাজ পড়িতে ব্যস্ত। আমার খুবই ক্ষিধা পাওয়ায় মেহমানদের খাওয়ার আগেই মা আমাকে খাওয়াইয়া-দাওয়াইয়া ঘুম পাড়াইয়া ছিলেন। হঠাৎ দেখা গেল আমি ভিতর বাড়ির উঠানের কোণের নারিকেলগাছের অনেকখানি উঁচায় উঠিয়া দুই হাতে গাছটা জড়াইয়া ধরিয়া আছি। নারিকেল-সুপারিগাছে উঠিতে দুপায়ে জুড়োম দরকার হয়। কিন্তু আমি খালি পায়েই গাছে উঠিয়াছি। বিশ হাত উঁচা গাছের অর্ধেকের বেশি উঁচায় আমি উঠিয়াছি। সকলেই বুঝিলেন আমি ঘুমের ঘোরে গাছে উঠিয়াছি। এটাও তাঁরা বুঝিলেন হৈচৈ করিলেই আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া যাইবে এবং হুঁশ হওয়া মাত্র আমি ভয় পাইয়া মাটিতে পড়িয়া যাইব। এবং মারা যাইব। সারিসুরি করিয়া বাহির বাড়িতে খবর পাঠানো হইল। বাড়ির ও আত্মীয়-স্বজনের অনেক পুরুষ মানুষ আসিলেন। চাকর-বাকরেরাও সকলে আসিল। জাল, খেতা, ফরাস, চাদর, চট যা জুটিল সব আনিয়া লোকজনেরা নারিকেলগাছ ঘেরিয়া এসব পাতিয়া ধরিলেন। একজন দক্ষ গাছ-বাওয়ালোক গাছে উঠিলেন। আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে তুলিয়া লইলেন। আমার ঘুম ছুটিতেই চিৎকার শুরু করিলাম। কিন্তু লোকটি আমাকে সবলে চাপিয়া ধরিয়া নিচে নামিয়া আসিলেন। সকলে আরামের নিশ্বাস ফেলিলেন। মা-দাদি তাঁরা খুশিতে কাঁদিয়া ফেলিলেন।
.
৫. ঘুমে চিৎকার
আমার দ্বিতীয় রোগটা ছিল ঘুম হইতে চিৎকার করিয়া উঠা। এই চিৎকার অনেকক্ষণ ধরিয়া চলিত। তেমন শীতের মধ্যেও ঘামে আমার সারা গা ও কাপড়-চোপড় ভিজিয়া যাইত। স্বপ্নে আমি ভয়াবহ কিছু একটা দেখিয়া ভয়ে কাঁদিয়া উঠিতাম। কিন্তু সেটা কী, গোছাইয়া বলিতে পারিতাম না। তখনও বুঝিতাম, এই বৃদ্ধ বয়সে আজও বুঝি, ব্যাপারটা শুধু অনুভব করিবার, বর্ণনা করিবার নয়। অনুভব করাটাও নিতান্ত আবছা-আবছা। আজও যতদূর মনে পড়ে, তাতে এইটুকু বলা যায়, গরু-মহিষের গাড়ির চাকার মত বড় লোহার একটা খুব ভারী চাকা ভনভন করিয়া ঘুরিতে-ঘুরিতে আমার কাছে আসিয়া আমার চোখ-মুখ ঝলসাইয়া দিত। কে যেন সবলে আমাকে সেই চাকায় উঠাইয়া দিত। আমাকে লইয়া সেই চাকা ঊর্ধ্ব দিকে বন্দুকের গুলির বেগে ছুটিতে থাকিত। তাতেই আমার শ্বাস বন্ধ হইয়া আসিত। আমি চিৎকার করিয়া উঠিতাম। কিন্তু সহজে সে স্বপ্ন ছুটিত না।
এই দুইটা রোগ আমার দশ-এগার বছর বয়স পর্যন্ত ছিল। বয়স হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই আমার এই রোগ সারিয়া থাকুক, আর চিকিৎসার ফলেই সারিয়া থাকুক, কৃতিত্ব সবটুকু পাইয়াছিলেন আমার দাদার মামাশ্বশুর মফিযুদ্দিন আখন্দ সাহেব। কারণ শেষ চিকিৎসা করিয়াছিলেন তিনি একা, অনেকবারই তিনি আমাকে তাবিজ-কবচ ও পানি-পড়া দিয়াছেন বটে কিন্তু সেটা তখন ছিল এজমালি। রমজান আলী শাহ সাহেব ছাড়া মাঝখানে ‘পাবনার মৌলবী’ নামক এক আলেম একাদিক্রমে তিন মাস আমাদের বাড়ি থাকিয়া আমার চিকিৎসা করিয়াছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকিয়া থাকেন এই আখন্দ সাহেব। তার শেষ চিকিৎসাটা ছিল এইরূপ : চারটি তাজা রক্তজবা ফুল যোগাড় করা হইল। চারটি নয়া মাটির টোফা কিনা হইল। আখন্দ সাহেব চারটি রক্তজবায় আরবি আয়াত পড়িয়া-পড়িয়া দশ-দশ বার ফুঁ দিলেন এবং আমার মাথায়, চোখ, মুখে ও বুকে ঐ ফুল ছুঁয়াইয়া মাটির টোফায় ভরিলেন। নিজ হাতে টোফার মুখে ভাল করিয়া লেপিয়া-পুঁছিয়া আমাদের বাড়ির চার কোণে চারটি টোফা পুতিলেন। টোফা পপাতা জায়গা চারটি নিজে সযত্নে লেপিয়া পুঁছিয়া দিলেন। এই সব লেপা-পোছার কাজেও আখন্দ সাহেব প্রতিবার হাত চালাইবার সময় এক-একটি আরবি শব্দ উচ্চারণ করিলেন। সারাক্ষণ তিনি আমাকে সঙ্গে সঙ্গে রাখিলেন। তাতেই এই সব খুঁটিনাটি আমার স্পষ্ট মনে আছে। লেপা-পৌঁছার পর তিনি আদেশ করিলেন ঐ চারটি জায়গা যেন কেউ, বিশেষ করিয়া আমি, কখনও পায়ে না মাড়াই।
মুরুব্বিদের কাছে শুনিয়াছি, এরপর আমি আর কোনো দিন ঘুমের ঘোরে হাঁটি নাই বা ঘুম হইতে চিৎকার করিয়া উঠি নাই।