.
৪.
শিক্ষণীয় বিষয়টা এই : মানুষ সামাজিক জীব হইলেও তার একটা ব্যক্তিত্ব আছে। ঐ ব্যক্তিত্বে সে একা ও স্বাধীন। এই বইয়ের ভূমিকাতেও আমি ইশারায় এই কথাটাই বলিয়াছি। তার এই ব্যক্তিগত ব্যাপারে তার কর্তব্য, দায়িত্ব, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ, আপদ-সম্পদ সম্পূর্ণ তার একার।
কিন্তু এই ব্যক্তি-জীবনের বাইরে সে সমষ্টির অংশ। সেখানে সে একাও নয়, স্বাধীনও নয়। তথায় সে একার ইচ্ছায় একা কিছু করিতে পারে না। সেখানকার ভাল-মন্দ, সফলতা-নিষ্ফলতা, আপদ-সম্পদ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ বিষাদ তার একার নয়, সমষ্টির। সেখানকার দায়িত্ব-কর্তব্যও কাজেই তার একার নয়। ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখের নিন্দা-প্রশংসাটা তার নিজের একার। কিন্তু সমাজ-জীবনের ভাল-মন্দের নিন্দা-প্রশংসার অধিকারী সে একা নয়। সুফল-কুফলও সে একা ভোগ করে না।
মানুষের প্রাইভেট ও পাবলিক এই যে দুইটা জীবন সে দুইটা আলাদা ভাবে যাপন করিবার কায়দা যারা জানিতে পারিয়াছে, তারাই এক জীবনে অতৃপ্ত থাকিয়াও অপর জীবনে তৃপ্ত হইতে পারিয়াছে। খোদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আমি এদের মধ্যে একজন।
.
৫.
প্রাইভেট লাইফে আমি সবুরী। পাবলিক লাইফে আমি গণতন্ত্রী। উভয় জীবনেই উচ্চাশা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর দশজনের মতই আমার ছিল। কিন্তু তার যতটুকু আমার পূর্ণ হইয়াছে, তাতেই আমি তৃপ্ত। আমার পাওয়ার যতটুকু আমি পাইয়াছি, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমার প্রাপ্যের পরিমাণ, আমার যোগ্যতার পরিমাপ ও আমার অধিকারের সীমানা উপরের কোনও অদৃশ্য শক্তির অসীম জ্ঞান যে-যেখানে নির্ধারণ করিয়াছেন, সেটাই নিশ্চয় ঠিক। এই উপলব্ধি হইতে আমার বেশি সময় লাগে নাই এটা বোধহয় আমার সহজাত। আমার বাপ-মা ও দাদা-দাদিকে আমি এমনি সবুরী পাইয়াছিলাম। আমাদের এটা নাই, ওটা হইল না, এ ধরনের কথা তাদের মুখে শুনি নাই। যৌবনে স্ত্রীর মুখে এবং বার্ধক্যে ছেলেদের মুখেও ঐ ধরনের কথা শুনি নাই। আমার ব্যক্তিগত তৃপ্তি ও সন্তুষ্টিই যেন আমার সংসারের আবহাওয়া।
কিন্তু পাবলিক লাইফে ব্যক্তিগত সবুরে চলে নাই। গণতান্ত্রিক উপলব্ধির দরকার হইয়াছে। সে জীবনেও আমার ব্যক্তিগত মর্যাদা প্রাপ্যাধিকই পাইয়াছি। কিন্তু পাবলিকের জন্য কী পাইয়াছি? দেশ, জাতি ও কৃষক শ্রমিকদের মুক্তির জন্য যে সব কথা বলিয়াছি ও লিখিয়াছি, ওয়াদা করিয়া মেম্বর-মন্ত্রী হইয়াছি, সেগুলি ত আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। ও-সবে ত আপোস করিবার, অল্পে তুষ্ট হইবার কোনও অধিকার আমার ছিল না। তবু তৃপ্ত হইলাম এই উপলব্ধিতে যে ও-সব প্রচারেই আমার অধিকার। প্রয়োগে নয়। এটাই গণতন্ত্র। আমার নির্দেশিত পথটা যতই ঠিক হউক, জোর করিয়া তা প্রয়োগ করা যাইবে না। করিলে সেটা হইবে ডিক্টেটরশিপ। ডিক্টেটররা পরিণামে জনগণের কল্যাণ করেন না। ক্ষমতার লোভেই তারা ক্ষমতা খাটান। জনতার জিন্দাবাদ-ধ্বনির লোভ বড় লোভ।
ব্যক্তিজীবনে ধন-লোভের তৃপ্তি নাই। রাষ্ট্র-জীবনে ক্ষমতা-লোভেরও তৃপ্তি নাই। ডিক্টেটররা ক্ষমতা ছাড়িতে এবং রাষ্ট্র-নেতারা রিটায়ার করিতে পারেন না, এই কারণে। সব জীবনের এটাই চরম শিক্ষা।