আচার-ব্যবহারের এই বাহ্যিক রূপ নিশ্চয়ই অন্তরেও সংক্রমিত হইয়াছিল। বাহিরে কারো অনিষ্ট ত করিতামই না, অন্তরেও অনিষ্টের চিন্তা করিতাম না। বাহিরে যাঁকে যত শ্রদ্ধা-ভক্তি দেখাইতাম, অন্তরেও তাঁকে ততখানি ভাবিবার চেষ্টা করিতাম। এইভাবে আমার মনে এই ধারণা ও বিশ্বাস জন্মিল যে আমি যখন কারো ক্ষতি বা অনিষ্ট করি নাই, তখন অপরেও আমার ক্ষতি বা অনিষ্ট করিবে না। আমি যখন কারো অনিষ্ট চিন্তা করি না, তখন অপরেও আমার অনিষ্ট চিন্তা করে না। এ সবেরই যোগফলে আমার বিশ্বাস হইল আমি ‘অজাতশত্রু’। এ বিশ্বাস আমার এতই দৃঢ় ছিল যে আমি পাড়াগাঁয়ে অন্ধকার রাতেও একা-একা পথ চলিতে ভয় পাইতাম না। লোকেরা বা বন্ধু-বান্ধব ভয় দেখাইলে বলিতাম : ‘আমার কোনও শত্রু নাই। ভয় কিসের?
এই মনোভাবটায় যে আসলে সাহসের চেয়ে অহংকারই ছিল বেশি, সেটা আমাকে বুঝাইয়াছিলেন সুভাষবাবু। তিনিই সর্বপ্রথম আমার এই অহংকারে প্রচণ্ড আঘাত হানিয়াছিলেন। সেটা ছিল ১৯৩৮ সালের শেষ দিক। তিনি তখন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ইচ্ছা। এলগিন রোডের বাসায় পারিষদবর্গের সঙ্গে আলোচনা। পারিষদদের মধ্যে আমিও একজন। তর্কে তর্কে কথার পিঠের কথায় আমি বড়াই করিয়াছিলাম : ‘আমার কোনও শত্রু নাই।’ তাঁর সুন্দর মুখখানিতে মৃদু হাসি ফুটাইয়া সুভাষবাবু বলিয়াছিলেন : আপনার ধারণা ভুল। বোবারই শত্রু নাই। আপনি বোবা নন।
সুভাষবাবুর কথায় তখন বেজার হইয়াছিলাম, পরে বুঝিয়াছিলাম, তার কথাই সত্য। কিন্তু বুঝিতে বেশ সময় লাগিয়াছিল। তখন আরো বুঝিয়াছিলাম যে কথাটা সুপ্রাচীন বলিয়াই আমরা উহার সংকীর্ণ অর্থই করিয়া থাকি। আসলে ও-বাবার অর্থ শুধু ‘বোবা’ নয়। কালাও। অজাতশত্রু হইতে গেলে শুধু বোবা হইলেই চলে না, কালাও’ হইতে হয়।
.
১২. সততা ও তুকাব্বরি
সৎ-সাধু হওয়ার দরুন গর্ববোধ করা, টন-টনা আত্মসম্মানবোধ থাকা দোষের নয়। সততা-সাধুতার ওটা পুরস্কার। কিন্তু সে সততা-সাধুতার গর্ব যদি দম্ভ অহংকারে প্রসারিত হয়, সে অহংকার যদি অপরকে ঘৃণা-অবজ্ঞা করিতে শিখায়, তবে সেটা হয় তখন আযাযিলের তুকাব্বরি। এই তুকাব্বরি মহৎ মানুষকে নীচ করে, বড় মনকে ক্ষুদ্র করে। ফলে সৎ-সাধু লোকেরা নিতান্ত স্পর্শকতার হইয়া পড়েন। সমালোচনাকে তারা নিন্দা মনে করেন। হিতোপদেশ-দাতাদের তারা অশিষ্ট ধরিয়া লন। এটা নিজের দিক। অপরদিকে পরের উপর তারা অবিবেচক, অসহিষ্ণু, নিষ্ঠুর ও হৃদয়হীন হইয়া পড়েন। মহাপুরুষদের এই মহাকাব্য, ‘পাপকেই ঘৃণা করিও, পাপীকে ঘৃণা করিও না’, বেমালুম ভুলিয়া যান তাঁরা। নিজের সততা-সাধুতার অন্ধ অহংকারে তারা গুনাহে-সগিরা ও গুনাহে-কবিরার পার্থক্য ভুলিয়া যান। লঘু গুরুর জ্ঞান হারাইয়া ফেলেন।
আমার জীবনেই এটা ঘটিয়াছিল। প্রয়োজনবোধের সীমাজ্ঞান হইতেই হক-নাহকের নীতিবোধের জন্ম। ছেলেবেলা হইতেই আমি জমিদার মহাজনদের প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থ-লালসার মতই ঘুষ রেশওয়াতেরও প্রচণ্ড নিন্দুক হইয়া উঠিয়াছিলাম। জমিদারদের মাথট-আবওয়াব, মহাজনদের চক্রবৃদ্ধি সুদের মতই মোল্লা-মৌলবীদের দান-খয়রাত, পীর-ফকিরদের নজরানাকেও অন্যায় যুলুম ও নাজায়েয উশুল বলিতাম। পরবর্তীকালে উকিল হইয়া কোর্টে-আদালতে আসিয়া কেরানি-পেশকার ও পিয়ন চাপরাশিদের উপরি বখশিশকেও ঘুষ আখ্যা দিতাম। ধুচিয়া গাল পাড়িতাম। শুধু মুখে গাল দিতাম না। অন্তরেও ঘৃণা করিতাম। মাত্র বিশ টাকা মাহিয়ানায় পিয়ন-চাপরাশির, আর মাত্র চল্লিশ টাকা বেতনে কেরানি পেশকারের চলে না। কিছু উপরি পাওনা ওদের দরকার। এসব যুক্তি আমি মানিতাম না। অবস্থা ভেদের মাত্রাজ্ঞান আমার ছিল না। পান হইতে চুন খসিলেই আমি ক্ষেপিতাম। মামলা-মোকদ্দমার টাউটদের আমি দু’চক্ষে দেখিতে পারিতাম না। তাদেরে আমি আমার বৈঠকখানায় ঢুকিতে দিতাম না। লোকাল বোর্ড, ডিসট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান-মেম্বরদের তৎকালে বদনাম ছিল। লোক-মুখে তাঁদের দুর্নীতির কাহিনী শুনিয়াই তাঁদের নিন্দা শুরু করিলাম। শহরে টাউন হল প্রাঙ্গণে এবং মফস্বলে মাঠে-ময়দানে সভা করিয়া তাঁদের নিন্দায় প্রস্তাব গ্রহণ করিতে লাগিলাম। আমার এই অভিযানে কারো কোনও ক্ষতি বা আর্থিক লোকসান হইয়াছিল বলিয়া শুনি নাই।
কিন্তু অন্তত একজনের বস্তুত একটা পরিবারের সত্য-সত্যই এতে বিপুল ক্ষতি হইয়াছিল। আমার জীবনে এটা একটা অনুশোচনার স্মৃতি। সেটা ১৯৩২-৩৩ সালের ঘটনা। লাহোর হাইকোর্টের জনৈক বিচারপতি মি. রবার্ট ইয়ং এই সময়ে কোর্টে দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্যে একটি ‘এন্টি-কোরাপশান’ সংঘ গঠন করেন এবং সারা ভারতের হাইকোর্টে ও তাদের অধীনস্থ আদালতসমূহে তার শাখা স্থাপনের প্রস্তাব দেন। তদনুসারে ময়মনসিংহেও একটি শাখা স্থাপিত হয়। মি. হেন্ডারসন (পরে কলিকাতা হাইকোর্টের জজ) এই সময়ে ময়মনসিংহের জিলা জজ। তারই উদ্যোগে হাকিম-উকিলদের যুক্ত সভায় একটি কমিটি গঠিত হয়। অন্যতম মুনসেফ মি. মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম (পরে জুডিশিয়াল সেক্রেটারি ও খান বাহাদুর) এই কমিটির সভাপতি ও আমি সেক্রেটারি নির্বাচিত হই। ঐ কমিটির রিপোর্টে একজন কেরানি প্রথমে সাসপেন্ড ও পরে ডিসমিস হন। সাসপেন্ড থাকাকালে তিনি ছেলেমেয়েসহ সপরিবারে আমার বাসায় আসেন। তিনি নিজে আমাকে এবং তার স্ত্রী আমার স্ত্রীকে অনেক অনুরোধ-উপরোধ ও কাকুতি-মিনতি করেন। নিজেদের ও ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের দোহাই দেন মর্মস্পর্শী ভাষায়। তিনি এও জানাইলেন যে, তার উপরওয়ালারা তাকে আশ্বাস দিয়াছেন যে আমার। একটা ভাল রিপোর্ট পাইলেই জজ সাহেব তার চাকরি বহাল রাখিবেন। এর পরেও আমার মন গলিল না।