ব্যাংক একাউন্ট একটা ভোলাই ছিল। কৃষক-এর সম্পাদকতাকালে অধ্যাপক হুমায়ুন কবির কংগ্রেস নেতা মি. ধীরেন মুখার্জির সদ্যপ্রতিষ্ঠিত হুগলি ব্যাংকে আমাকে দিয়া একটা সেভিং একাউন্ট খুলান। ঐ খুলা তকই। বহুদিন পরে ঐ একাউন্টের কথা মনে পড়িল। বিবির হুকুম-মত পরদিন সকালে আফিসে কিছুক্ষণ কাজ করার পরই ব্যাংকে রওয়ানা হইলাম।
কলিকাতা তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-বিধ্বস্ত। ট্রাম বন্ধ। বাসও আংশিক বন্ধ। শুধু বিশেষ বিশেষ রুটে কিছু বাস চলে। কলুটোলা ও পার্ক সার্কাসের মধ্যে মুসলিম প্রধান-এলাকায় যোগাযোগ রক্ষার জন্য যে সার্ভিসটি চালু ছিল, তা বরাবরের লোয়ার সার্কুলার রুটে না গিয়া ইলিয়ট রোড, রয়েড স্ট্রিট, ওয়েলেসলি, ধর্মতলা, বেন্টিক স্ট্রিট, লোয়ার চীৎপুর দিয়া যাকারিয়া স্ট্রিটে নাখোদা মসজিদ পর্যন্ত যাইত। হুগলি ব্যাংক ধর্মতলা স্ট্রিটে। কাজেই আমি পার্ক-সার্কাস হইতে এই বাস ধরিলাম। ধর্মতলায় হুগলি ব্যাংকের কাছাকাছি গিয়া বাস হইতে নামিলাম। দুতলাস্থ ব্যাংকে গেলাম। কাউন্টারে টাকা দিতে গিয়া দেখিলাম পকেটে মানিব্যাগ নাই। ধরিয়া নিলাম বাসেই পকেটমার গিয়াছে। বুঝিলাম, ওটা ফেরৎ পাওয়ার চেষ্টা পাগলামি। কিন্তু কিসের তাড়নায় পাগলামিটাই করিলাম। দুতলা হইতে ছুটিয়া রাস্তায় নামিলাম। দেখিলাম, অদূরেই বাসটি তখনও দাঁড়াইয়া আছে। দু-চারজন বাসযাত্রী উঠিতেছে। আমি সেদিকে ছুটিতেই বাসটি স্টার্ট দিল। আমি চিৎকার করিতে-করিতে বাসের পিছনে ধাওয়া করিলাম। ধরিলাম। বাসে উঠিলাম। দরজায় দাঁড়ানো কন্ডাকটরকে হাঁপাইতে-হাঁপাইতে ব্যাপারটা বলিলাম। সে আমার এ পাগলামিতে একটু হাসিল। কিন্তু তার মনে দয়া হইল। সে চিল্লাইয়া বলিল : এ বাসে একজনের পকেট-মার গিয়াছে। যারা নামিবেন, তাদেরে আমরা সার্চ করিব। কন্ডাকটরের সহকারী ছিল দুইজন। তারাও এমনি ঘোষণা করিল। পথে অনেক স্টপেজে বাস থামিল। অনেক যাত্রী উঠিল। কিন্তু দু-একজন ছাড়া কেউ নামিল না। যারা নামিল, তারা নিজেরাই নিজ-নিজ পকেট-টকেট দেখাইয়া গেল। তাদেরই খালি করা সিটের একটিতে আমাকে বসাইল। শেষ পর্যন্ত বাসটি নাখোদা মসজিদের সামনে অস্থায়ী টার্মিনালে থামিল। যাত্রীরা নামিতে লাগিল। কন্ডাকটরদের নামমাত্র তল্লাশি করিতে হইল। কারণ সবাই স্বেচ্ছায় পকেট-টকেট দেখাইতেছিল। আমার বুকের ধড়ফড়ানি দ্রুত বাড়িয়া অবশেষে প্রায় শেষ। আর আশা নাই। পাথরের মত বসিয়া আছি। সবাই নামিয়া গেল। আমার মানিব্যাগ উদ্ধার হইল না। কন্ডাকটররা আমাকে সমবেদনা জানাইতে আসিয়া দেখিল আমার পাশেই একজন যাত্রী বসা। তাদের সন্দেহ হইল। তাকে ধাক্কাইয়া তুলিল। দেখা গেল, তার পাছার নিচেই আমার মানিব্যাগ। ব্যাগটা আমাকে দিল। কাঁপা হাতে খুলিয়া দেখিলাম সব ঠিক আছে। আমি শোকরানার মোনাজাত করিলাম। কন্ডাকটররা লোকটাকে বেদম মারপিট করিতে লাগিল। আমি তাকে ছাড়িয়া দিতে কাকুতি-মিনতি করিলাম। ততক্ষণে বাস ঘেরিয়া বিপুল জনতা। অনেকে আমার সমর্থন করিল। লোকটাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইল। কন্ডাকটররা ও জনতার অনেকে সব শুনিয়া আমাকে কংগ্রেচুলেট করিলেন। আনন্দ পুলকে আমার চোখে পানি দেখা দিল। আমি শুধু মেহেরবান আল্লাহকে দেখিলাম না। কন্ডাকটররাও আমার নজরে ফেরেশতা মনে হইল। আমাকে হেফাযত করিতে আল্লাই ওঁদেরে পাঠাইয়াছেন। আমি তাদেরে বখশিশ ত নয় নজরানা দিতে চাহিলাম। নিদান পক্ষে চা-নাশতা খাওয়াইতে চাহিলাম : তারা কিছু গ্রহণ করিল না। বরঞ্চ একজন বিশ্বস্ত ট্যাক্সিওয়ালা ডাকিয়া আমাকে বাসায় পৌঁছাইবার ব্যবস্থা করিল। বাসায় পৌঁছাইবার পর ট্যাক্সিওয়ালাও মিটারে উঠা ভাড়া ছাড়া একপয়সা অতিরিক্ত নিল না আমার সাধাসাধি সত্ত্বেও। ট্যাক্সিটা ফিরিয়া গেল। আমি রাস্তার মোড় না ফেরা পর্যন্ত সেদিকে চাহিয়া রহিলাম। মনে হইল আল্লাহর পাঠানো ফেরেশতাদের মধ্যে ঐ ট্যাক্সি ড্রাইভারটিও একজন।
.
১১. ‘অজাতশত্রু’
জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞানের কথা বলিতে গিয়া আমার আরেকটা কথা মনে পড়িয়া গেল। কথাটা মামুলি। তরুণদেরও জানা কথা। জ্ঞানীর পক্ষে অহংকারী হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আত্মসম্মান, গর্ব, অহংকার, সেলফ-রেসপেক্ট, প্রাইড ও ভ্যানিটির পার্থক্য এত সূক্ষ্ম যে বিভ্রান্তি ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। খারাপ অর্থে দম্ভ, অহংকার ও তুকাব্বরির দুইটা রূপ : এক, নিজেকে বড় মনে করা। দুই, অপরকে ছোট মনে করা। দুইটাই খারাপ। জ্ঞানীর জন্য ও বিষয়ীর জন্য প্রথমটার মধ্যে অপর’ অনুপস্থিত অপরকে ছোট মনে না করিয়াও, তার মানে, আর কারো কথা মোটেই চিন্তা না করিয়াও নিজেকে। ‘বড়’ মনে করা সম্ভব। স্থূল দৃষ্টিতে মনে হইবে, এটা মন্দের ভাল। কারণ এ মনোভাবেরও দুইটা মুখ আছে। একটা সুন্দর, অপরটা অসুন্দর। অহংকারের এই রূপে মানুষ নিজেকে অজাত শত্রু মনে করে। আমি এত বড়, এত ভাল, এত গুণবান যে আমাকে সবাই শ্রদ্ধেয় মনে করে। আমি সমাজের একটা সম্পদ। কাজেই আমার কোনও শত্রু নাই। আমি অজাত শত্রু। এটাও যে নিরর্থক দম্ভ তা আমি বুঝিয়াছিলাম অধিক বয়সে। বিনয়ী, শিষ্টাচারী ও আদব-কায়দা-দুরস্ত হওয়ার শিক্ষা পাইয়াছিলাম শৈশব হইতেই। মুরুব্বি, গুরুজন, শিক্ষক-অধ্যাপকরা সবাই এসব গুণের জন্য আমার তারিফ করিতেন। ভাল’ বলিতে-বলিতে মানুষ সত্য-সত্যই ভাল হইয়া যায়, এটা অংশত সত্য হইলেও পূর্ণ সত্যটা এই যে যাকে ভাল’ বলা যায় সে নিজেকে ভাল মনে করিয়া বসে। বিশ্বাস করে। আমিও বিশ্বাস। করিলাম। সঙ্গে-সঙ্গে আমি ঐ তারিফের পুরামাত্রায় যোগ্য হইবার চেষ্টাও করিতে লাগিলাম। সর্বদা হুঁশিয়ার থাকিলাম, লোকমুখের ঐ তারিফের কোনও ব্যাঘাত না ঘটে। লোকে নিন্দা করিতে পারে, ভদ্রতার খেলাফ হইতে পারে, এমন কোনও কাজই করিতাম না।