আমাদের অঞ্চলেও তৎকালে অনেক গণক ঠাকুর ছিলেন। বাপ-মা আদরের ছেলেপিলে দেখিলেই গণক ঠাকুরেরা যা যা বলিয়া থাকেন, আমার বেলায়ও তা-ই বলিলেন। তারা আমার হাত দেখিয়া বলিলেন, ছেলের কপালে রাজটিকা আছে। বাঁচিয়া থাকিলে এ ছেলে কোনো দিন দেশের রাজা হইবে। কিন্তু এর ভাগ্যে বড় বড় ফাড়া আছে। শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করিলেই সেসব ফাড়া কাটিয়া যাইবে।
রাজভাগ্য ও ফাড়া গণকদের মুখে অবিচ্ছেদ্য। এটাই তাদের স্টক-ইন ট্রেড। কারণ, এ দুইটি কথায় কোনো বাপ-মার মন স্থির থাকিতে পারে? কোনো কৃপণ মা-বাবার টাকার থলির মুখ এর পরেও বন্ধ থাকিতে পারে? বলেন, গণক ঠাকুর ঐ যে কী বলিলেন ওটা করিতে কত খরচ লাগে? খরচ? খরচ আর এমন বেশি কী? একরূপ কিছুই লাগিবে না। কিন্তু ছেলেটার জন্ম শনিবারে কিনা। তাই শনি ও রাহু এই দুইজনে প্রতিযোগিতা করিয়া ছেলেটার অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেছে। কে কার আগে বেশি অনিষ্ট করিতে পারে? কাজেই দশ-বার টাকা লাগিয়া যাইবে। কঠিন স্বস্ত্যয়ন কিনা। আরেক গণক আসিয়া বলিলেন, দশ টাকা লাগিবে কেন? কোন গণক বলিয়াছে শনি এ ছেলের দুশমন? সে গণকই নয়। এ ছেলের জন্ম যখন শনিবারে তখন স্বয়ং শনিই এর রক্ষক: যেমন চোরের হেফাযতে ধন রাখা। যে চুরি করিবে সেই চোরই যদি হয় পাহারাদার, তবে সেটা চুরি হওয়ার সম্ভাবনা কোথায়? শনি এই ছেলের রক্ষক হওয়ায় স্বয়ং বৃহস্পতি এই ছেলের প্রতি অনুকম্পা করিবে। কাজেই এই ছেলে বিদ্যার সাগর ও বুদ্ধির রাজা হইবে। তবে যেসব ছোটখাটো গ্রহের কুদৃষ্টি আছে, সেগুলি কাটাইতে হইবেই। তাতে চার টাকার বেশি খরচ লাগিতে পারে না।
এই গণক ঠাকুরই ভাল। বুঝেও ভাল, অথচ সস্তাও। আমার দাদি, মা ও বাড়ির মেয়েদের সকলেরই ইচ্ছা হইত, সস্তায় আমার সব ফাড়া কাটাইয়া আমার রাজভাগ্যের আকাশটা একদম মেঘশূন্য করিয়া রাখিতে। তলে-তলে বাপজীরও সমর্থন ছিল। কিন্তু দাদাজী ও চাচাজীর জন্য কিছু করা সম্ভব ছিল না। তারা দুইজনই ছিলেন একদম পাক্কা ফরাযী। হাদিস-কোরআনের বাহিরে কোনো কথা বলা বা কাজ করা তাদের দ্বারা ত কল্পনাও করা যাইত না। অপরেও তাদের সামনে করিতে পারিতেন না। ফলে আমার জীবনের ফাড়াকাটাইবার জন্য গণকদের কথিত কোনো বেশরা কাজ হইল না বটে, তবে প্রচুর তাবিজ-কবচ দেওয়া হইতে লাগিল।
.
৩. রোগ ও চিকিৎসা
আমার দাদির মামু মফিজুদ্দিন আখন্দ ও খালাতো ভাই রমজান আলী শাহ ঝাড়-ফুঁক তুকতাক ও তাবিজ-কবচের ব্যবসা করিতেন। রমজান আলী শাহ জিন-পরি পালিতেন বলিয়া লোকের বিশ্বাস ছিল। এই দুইজনই একত্রে এবং পৃথক পৃথকভাবে আমাকে অনেক ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবচ দিয়াছেন। ঐ সব তাবিজ-কবচে কোনো কুফরি কালাম ইস্তেমাল করা হয় নাই, এই সম্পর্কে আমার মুরুব্বিরা নিশ্চিত হইয়া লইতেন। আখন্দ সাহেব বলিতেন, তিনি তাঁর তাবিজে কালামুল্লার আয়াত ও আরবি হরফ ছাড়া কিছু ব্যবহার করেন না। আর শাহ সাহেব? তিনি আখন্দ সাহেবের এক ডিগ্রি উপরে যাইতেন। তিনি দেখাইতেন যে তিনি বোখারার কাগজের উপর যাফরানের কালিতে যইতুন কাঠের কলমে তাবিজ লিখিয়া থাকেন। এঁরা দুইজনই ছিলেন হানাফি। কাজেই এরা পীর-মুরিদির ব্যবসা করিতেন। আমার মুরুব্বিরা মোহাম্মদী। পীর-মুরিদির তারা ঘোর বিরোধী। কাজেই একজন দাদাজীর মামাশ্বশুর ও আরেকজন শালা হওয়া সত্ত্বেও তাদের দেওয়া তাবিজ-কবচ সম্পর্কে এত সাবধানতা অবলম্বন করা হইত। তবু এই দুইজন মিলিয়া আমাকে এত তাবিজ-কবচ দিয়াছিলেন যে আমার গলা, কোমর ও দুই বাহুতে তিল ধারণের জায়গা থাকে নাই।
পেটের পীড়া ও হাড্ডিসার দেহ ছাড়া আমার আরো দুইটা বড় রোগ ছিল। আমার উপরিউক্ত দুইজন চিকিৎসক এ বিষয়ে একমত ছিলেন যে, শেষোক্ত দুইটাই আমার আসল রোগ। প্রথমোক্ত দুইটা শেষোক্ত দুইটার কুফল মাত্র। আমার রোগ দুইটি ছিল এই : (১) আমি নিদ্ৰাচর বা সমনামবুলিস্ট ছিলাম। আমি ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া যাইতাম। বরাবর রাত্রেই এটা হইত। মাত্র দুইবার দিনের বেলা হইয়াছিল। ঘুমন্ত অবস্থায় আমি বাড়ির বাহিরে অনেক দূরে চলিয়া যাইতাম। আমি শৈশবের শেষ পর্যন্ত বাপ-মার সাথে একই বিছানায় শুইতাম। আমাদের বাড়ির নিয়ম ছিল শুধু নবজাত শিশুই বাপ-মার বিছানায় থাকিতে পারিত। তার বড়রা দাদির ঘরে তার বিছানায় যাইত। এই হিসাবে আমার ছোট ভাইয়ের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই আমার দাদির বিছানায় যাওয়ার কথা। কিন্তু আমার বেলা তা হয় নাই। আমার ছোট ভাই ও বহিন এক-এক করিয়া বছরখানেক বয়সেই মার বিছানা ছাড়িয়া দাদির বিছানায় চলিয়া গেল। কিন্তু আমি মার কাছেই থাকিয়া গেলাম।
.
৪. নিদ্ৰাচর
আমার বাপ-মা দুজনই ঘুমে খুব হুশিয়ার ছিলেন। অর্থাৎ ঘুম তাদের খুব পাতলা ছিল। সামান্য শব্দেই তাদের ঘুম ভাঙ্গিয়া যাইত। তাছাড়া মা প্রায় সারা রাতেই নফল নামাজ ও অন্যান্য এবাদত করিয়া কাটাইতেন। কাজেই তাদের নিকট হইতে রাতে উঠিয়া যাওয়া খুবই কঠিন ছিল। তবু কেমন করিয়া না জানি, আমি তাদের পাশ হইতেই ঘুমের ঘোরে উঠিয়া যাইতাম। অবশ্য অল্পক্ষণের মধ্যেই তাঁরা টের পাইতেন। আমার খোঁজে তারা যে হৈচৈ শুরু করিতেন, তাতে সারা বাড়ির এমনকি পাড়ার লোক জাগিয়া উঠিত। লণ্ঠন, পাট সোলার বুন্দা, বাঁশের মশাল ইত্যাদি লইয়া চারদিকে আমার তালাশ করা হইত। সাধারণত বাড়ির আশপাশেই আমাকে পাওয়া যাইত। মাত্র দুইবার আমাকে বাড়ি থনে দূরে মাঠে পাওয়া গিয়াছিল। তালাশকারীরা দেখিয়াছেন, আমি জাগ্রত লোকের মতই সাবধানে পথ চলিতেছি। আঁকা-বাঁকা, উঁচা-নিচা, আইল-বাতরের কোথাও আমি হোঁচট খাইতেছি না। পুকুরাদি, জলাশয়ে না পড়িয়া সাবধানে ও-গুলির পাড় বাহিয়া চলিতেছি। এই অবস্থায় আমাকে ধরিয়া কোলে তুলিবার পরই আবার ঘুম ভাঙ্গিত। তখনই আমি কান্নাকাটি শুরু করিতাম।