.
৯. জ্ঞান ও বুদ্ধি
শুধু বাড়ি করার ব্যাপারে নয়, সব ব্যাপারেই বন্ধুরা আমাকে বুদ্ধিমান-জ্ঞানী বলিতেন। আমিও মনে-মনে তৃপ্তি, এমনকি গর্ব বোধ করিতাম। এই বুড়া বয়সে বার্ধক্যের জ্ঞান আমার কিছুটা থাকিলেও বিষয়-বুদ্ধি নাই। জ্ঞান ও ‘বুদ্ধি’ দুইটা গুণকে এক করিয়া ভাবাতেই এই বিভ্রান্তি ঘটিয়াছে। আসলে দুইটা এক নয়। জ্ঞানটা জানায় সীমাবদ্ধ। বুদ্ধিটা করায় প্রসারিত। বিষয়ী জীবনের জন্য থিওরেটিক্যাল জ্ঞান যথেষ্ট নয়। প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধিও দরকার। এমনকি বিষয়ী জীবনের সাফল্যের জন্য জ্ঞান অত্যাবশ্যক নয়, শুধু বুদ্ধি থাকিলেই চলে। বুদ্ধিমানেরা জ্ঞানীর’ জ্ঞান ধার করিয়া শুধু বুদ্ধির জোরে জীবনে সাফল্য লাভ করিয়াছেন, সমাজের সকল স্তরে এর ভূরি-ভূরি দৃষ্টান্ত রহিয়াছে। সাংবাদিক হিসাবে কলিকাতা জীবনে আমি যখন মেসে থাকি, তখন আমার রুমমেট ও আমি এক বেকার বন্ধুকে আমাদের রুমে বিনা ভাড়ায় থাকিতে দিয়াছিলাম। বেকার বন্ধুর তখতপোশ ও বিছানা-পত্র কিনিবার সাধ্য ছিল না। সারাদিন কাজের তালাশে ঘুরিতেন। রাত্রে মেঝের মাদুরে শুইয়া থাকিতেন। আমরা তাঁকে স্বাধীন ব্যবসার উপদেশ ও ব্যবসায় চালাইবার জ্ঞান দান করি। দরকারি কাগজ-পত্র মুসাবিদা করিয়া দেই। আমরা কলিকাতা থাকিতেই ঐ বন্ধুর দু’তলা বাড়ির ভাড়াটিয়া ছিলাম। থিওরেটিক্যাল জ্ঞান ও প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধির পার্থক্য এইখানে। আসলে প্র্যাকটিক্যাল না হইলে জ্ঞানও পূর্ণ হয় না।
আমি যে মোটেই প্র্যাকটিক্যাল নই, এ কথা বলিলেও নিজের উপর অবিচার করা হইবে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আরাম-আয়েশ ও আর্থিক সচ্ছলতায় আমি মোটেই উদাসীন ছিলাম না। কিন্তু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাসিতা, আর্থিক সচ্ছলতা ও ধনী হওয়া, এক জিনিস নয়, এ বিষয়েও সচেতন ছিলাম। আমি সন্ন্যাস, ফকিরি, কৃপণতা, কৃচ্ছ-সাধনা ও অপরিচ্ছন্নতার বিরোধী। সুস্থ দেহ ও সৎ মন যা খাইতে, পরিতে এবং যেভাবে থাকিতে চাহিবে, সেভাবেই খাওয়া-পরা-থাকার আমি পক্ষপাতী। সুস্থ মনের কোনও স্ট্যান্ডার্ড নাই, এ কথা আমি মানি না। যে মন নিজের ও অপরের প্রয়োজনের সীমা সরহদ্দ চিনে, সেটাই সুস্থ মন। কড়ার ফকির হাজার টাকার মালিক হইলে সে লক্ষ টাকা চাহিবে, লক্ষ পাইলে কোটি চাহিবে, মিলিয়ন পাইলে বিলিয়ন চাহিবে এটা সাধারণ ব্যাপার হইলেও সুস্থ মনের পরিচায়ক নয়। সুস্থ মন জানে, খাওয়া-পরার মতই মানুষের সব ভোগের একটা সীমা আছে। টাকা-পয়সার প্রয়োজনেরও সীমা আছে। এ সীমা লঙ্ঘনের ফলেই অর্থে অনর্থ ঘটিয়া থাকে।
তবে এই সীমার যেমন ম্যাক্সিমাম আছে, তার একটা মিনিমামও আছে। এই মিনিমাম চিনিতে হইলে জ্ঞান ও বুদ্ধির সমন্বয় দরকার। নিজস্ব বাড়ি করার ব্যাপারে আমার থিওরির জ্ঞানে বুদ্ধির বেড়া দেন আমার স্ত্রী। তারই প্রাধান্যে আমি আজ শহরে বাড়ির মালিক হইয়াছি। নিজের বাড়িতে পুতনাতি লইয়া সপরিবারে পরম সুখে বাস করিতেছি। বার্ট্রান্ড রাসেলের আদর্শ আমার নিজস্ব বাড়ি নির্মাণ ঠেকাইতে পারে নাই। এটা ঘটিয়াছে বুদ্ধির জোরে। সে বুদ্ধিটাও আমার নয়, আমার স্ত্রীর। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন সিএন্ডবি মিনিস্টার আমার পরম বন্ধু কফিলুদ্দিন চৌধুরীর সাথে একরূপ ষড়যন্ত্র করিয়াই আমার স্ত্রী আমার অজ্ঞাতে ও অনুপস্থিতিতে ধানমন্ডিতে জমি বন্দোবস্ত নেন। পরে হাউস বিল্ডিং হইতে টাকা নিয়া বাড়ি করা হয় তাঁরই উদ্যোগে ও আমার সক্রিয় সহযোগিতায়। ততদিনে আমার আদর্শের জোর ও আমার ব্যক্তিগত প্রভাব কমিয়া গিয়াছে। স্ত্রীরও জোর বাড়িয়াছে। ছেলেরা বড় হইয়াছে। আমি তখন বড় পরিবারের অনেকের একজন মাত্র। ক্যাবিনেট সিস্টেমে আমি তখন নাম্বার ওয়ান এমাংস্ট ইকুয়ালস মাত্র। তাছাড়া ততদিনে আমার এই বোধধাদয় হইয়া গিয়াছে যে, সুফি-দরবেশ ও বিজ্ঞানী দর্শনীর জন্য যাই হউক, বিষয়ীর জন্য জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে একটু কাণ্ডজ্ঞান থাকা ভাল।
.
১০. আহাম্মকের পাহারাদার তকদির
বিষয়ী জীবনের টাকা-পয়সার ব্যাপারে আমি খানিকটা বুদ্ধিহীন ছিলাম ঠিকই কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তকদির আমার পাহারাদারি করিয়াছে। অসাবধানতায় যা হারাইয়াছি, বরাত তা ফিরাইয়া দিয়াছে। হারানো বস্তু ফেরত পাওয়া সৌভাগ্যের লক্ষণ–এমন একটা প্রবাদ আমাদের দেশে চালু আছে। আমার জীবনে এমন অনেকবার ঘটিয়াছে। কাজেই আমাকেও ভাগ্যবান বলা যাইতে পারে। সাধারণ অবস্থা ছোট-খাটো বস্তু হারাইয়া ফিরিয়া পাওয়া খুব উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। কিন্তু তৎকালে পঞ্চাশ লক্ষ বাসেন্দার ভিড়ের শহর কলিকাতায় ট্রামে-বাসে হাজার টাকা-ভরা মানিব্যাগ পকেটমার যাওয়ার পরও তা ফিরিয়া পাওয়া সত্যই একটা অসাধারণ ব্যাপার। এটাও বরাতে ঘটিয়াছিল। ব্যাপারটা ঘটে এই ভাবে :
ইত্তেহাদ-এর সম্পাদকরূপে প্রথম মাসের বেতন পাইয়াছি হাজার টাকা। এত টাকা একসঙ্গে বেতন পাই নাই কোনও দিন এর আগে। প্রথম সুযোগেই বাসায় ফিরিলাম। বিবির হাতে টাকাটা দিলাম। তিনি নোটগুলি খানিক হাতাইয়া সেগুলি আমার হাতে দিলেন। বলিলেন : উকালতির টাকাতেই কিছুদিন চলিয়া যাইবে। বেতনের টাকা দিয়া একটা ব্যাংক একাউন্ট খোলো।