.
৮. নিজের বাড়ি বনাম ভাড়াটিয়া বাড়ি
বলা বাহুল্য এর একটাও নীতিবাক্য নয়, নিছক বিষয়-বুদ্ধির কথা। আমি প্রেরণা-বশে বা নিজের বুদ্ধি-বিবেচনায় এই সত্য আবিষ্কার করিয়াছিলাম তা নয়। আমার পরম শ্রদ্ধেয় তিনজন চিন্তাবিদের কথা ও কাজ হইতে এই প্রেরণা আমি লাভ করিয়াছিলাম। এই তিন মনীষী হইতেছেন, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মি, অতুলচন্দ্র গুপ্ত এবং ডা. নরেশ চন্দ্র সেন। পরবর্তী দুই মনীষী সাহিত্য সেবায় এবং কৃষক-প্রজা আন্দোলনে আমাকে প্রচুর প্রেরণা দিয়াছেন। উকালতি করিয়া এঁরা বিপুল টাকা রোযগার করিতেন। বহু টাকা ভাড়া দিয়ে সুন্দর-সুন্দর প্রাসাদ-তুল্য বাড়িতে পরম বিলাস-ব্যসনে থাকিতেন। কিন্তু নিজের বাড়ি তৈরি করিবার কল্পনাও তারা করিতেন না। মওলানা সাহেবেরও টাকা-পয়সার অভাব ছিল না। তিনি অনেক টাকার ভাড়ার বাড়িতে থাকিতেন। বিপুল পুস্তকরাজির বিশাল লাইব্রেরি ছিল তাঁর। মাসে-মাসে তিনি হাজার-হাজার টাকার বই কিনিতেন। নিত্য-নূতন ট্যাক্সিতে চড়িতেন। নিজে মোটর কিনিতেন না। বিশ্ববিখ্যাত চিন্তা-নায়ক বার্ট্রান্ড রাসেলেরও এই মত। তাঁর পুস্তক পড়িয়াই সর্বপ্রথম জ্ঞান লাভ করি যে, ইউরোপ মার্কিন মুল্লুকের বহু কোটিপতির নিজস্ব কোনও বাড়ি-ঘর নাই। তারা পুরুষানুক্রমে হোটেলে ও জাহাজে বাস করিয়া আসিতেছেন। লর্ড রাসেল লিখিয়াছেন, নিজস্ব বাড়ি ও ভাড়াটিয়া বাড়ির মধ্যে সাধারণ লোকেরা যে পার্থক্য করিয়া থাকে, সেটার ভিত্তি শুধু পযেসরী ইনসৃটিংক্ট। ওটা অবৈজ্ঞানিক সংস্কার মাত্র। অতঃপর এই মতবাদ আমার ঈমানের অঙ্গ হইয়া উঠে। বই-পড়া এই মতবাদ ছাড়াও আমার স্বতঃপ্রণোদিত একটা অভ্যাস ছিল। ভাড়াটিয়া বাড়িইে আমি সত্য-সত্যই নিজের মনে করিতাম। ছোট খাটো অল্প-ব্যয়সাধ্য মেরামত আমি নিজেই করিতাম, বাড়িওয়ালার করার অপেক্ষায় বসিয়া থাকিতাম না। জানিতে পারিয়া বাড়িওয়ালা খরচাটা দিলে নিতাম, না দিলে চাহিতাম না। ধরুন, ঝড়ে আমার বাড়ির একটা জানালার পাল্লার কবৃজা খুলিয়া পড়িয়াছে; কিম্বা পানির কলটা খারাপ হইয়া গিয়াছে। আমি বহুবার দেখিয়াছি ঐরূপ ঘটনায় আমার প্রতিবেশী বাড়িওয়ালাকে মেরামতের জন্য মুখে, টেলিফোনে তাগাদা করিতেছেন। শেষ পর্যন্ত ভাড়া বন্ধ করিবার ও উকিলের নোটিস দিবার ভয় দেখাইতেছেন। ইতিমধ্যে ভাঙ্গা জানালা দিয়া বৃষ্টির পানি আসিয়া তাঁর বিছানা ভিজিতেছে, খোলা-কলে পানি পড়িয়া ছাদের উপরস্থ টাংকির পানি শেষ হইয়া গিয়াছে। বাথরুমের পানির অভাবে রান্না ও গোসলের ভয়ানক অসুবিধা হইতেছে। ভিস্তিওয়ালাকে দিয়া রাস্তার কল হইতে পানি আনাইয়া তিনি কাজ চালাইতেছেন। বাড়িতে ভিজা বিছানা-বালিস রোজ রোদে দিতেছেন। তবু ঐ সামান্য মেরামতের কাজটুকু নিজে করিতেছেন না। পক্ষান্তরে এইরূপ ঘটনায় আমি তৎক্ষণাৎ একটা প্লাম্বারকে চার আনা ও একটি সূতার মিস্ত্রিকে আট আনা দিয়া ঐ কল ও জানালার পাল্লা মেরামত করাইয়া ফেলিয়াছি এবং দিব্যি আরামে জানালা ও পানির কল ব্যবহার করিয়াছি।
আমার এই মনোভাব কোনও নৈতিক আদর্শের মনোভাব নয়, নিতান্ত বিষয়-বুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানের কথা। কাজেই এটা বুঝা সহজ হওয়া উচিৎ সকলের পক্ষেই। তাই প্রতিবেশী বন্ধুকে এটা বুঝাইবার চেষ্টা করিতাম। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখিতাম, মানুষের মালিকানাবোধ, বার্ট্রান্ড রাসেল যাকে পযেসরী ইনসৃটিংক্ট বলিয়াছেন তা অতিশয় প্রবল। ভাড়া দিয়া যে বাড়িতে থাকেন, সে বাড়ি যে তার নয় অপরের, এই বোধ সব ভাড়াটিয়ার মনে অতিশয় তীব্র। পরের বাড়িতে তিনি নিজের এক পয়সাও খরচ করিবেন কেন? এ বুদ্ধি তাদের টন-টনা। কিন্তু আমার মত তাঁরা বার আনা পয়সা ব্যয় না করিয়া যে বৃষ্টিতে ভিজিলেন, রান্না-গোসলের কষ্ট ভোগ করিলেন, সে কষ্ট ও দুর্ভোগের দাম যে বার আনার চেয়ে অনেক বেশি, সে কথাটা তাঁদের আক্কেলে ধরা দেয় না। এই নিজস্ব মালিকানা-বোধের অভাবে এবং পরস্ববোধের প্রভাবে তারা ভাড়াটিয়া বাড়িতে ফলের গাছ। লাগান, ফুলের বাগান করা, টব বসানো বা অন্য প্রকারে সাজানকে পরের বাড়িতে অর্থের অপব্যয় মনে করেন। বাগানের ফুলের খোশবু যে তিনিই ভোগ করিবেন; বাড়িওয়ালা করিবেন না, বাড়ির সাজসজ্জা যে তারই নিজের ও তার পরিবারের মনে আনন্দ দান করিবে, বাড়িওয়ালার মনে করিবে না, এটাও বুঝিতে চান না। এই পরস্ববোধের জন্যই এই শ্রেণীর ভাড়াটিয়ারা বাড়ির এখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলিয়া থাকেন, দা হাতুড়ি দিয়া মেঝের সিমেন্ট ও দেয়ালের আস্তর বিনষ্ট করিয়া থাকেন, ছেলে-মেয়েরা কয়লা ও পেনসিল দিয়া দেওয়ালে ‘চিত্র আঁকিয়া থাকে, চাকর-চাকরানিরা দেওয়ালে হাঁড়ি-পাতিলের কালি মাখিয়া রাখে। পরের বাড়ির এই ধরনের অনিষ্ট করিয়া তাঁরা যেন একটা আনন্দ পান। অথচ এই কদর্যতা, অপরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্যহীনতা বাড়িওয়ালা ভোগ করেন না। করিতে হয় ভাড়াটিয়ার নিজেরই। এটাই হইয়া থাকে ঐ পযেসরী ইনসটিংক্ট হইতে। অথচ এ মালিকানাবোধ যে কত ভ্রান্ত, পণ্ডিত রাসেল তা সুন্দররূপে বুঝাইয়া দিয়াছেন। একটু ধীরচিত্তে বিবেচনা করিলেই বুঝা যাইবে শেষ পর্যন্ত আমি যেখানে যখন আছি, তখনকার জন্য সেই স্থানটিই আমার বাসস্থান। আমার সুখ-সুবিধা ও আনন্দের জন্য যা করা দরকার তাই আমাকে করিতে হইবে। এমনকি পথিকও রাস্তার ধারে গাছতলায় বিশ্রাম করিতে বসিলে বসার জায়গাটি ঝাড়িয়া-পুছিয়া পরিচ্ছন্ন করিয়া লয়। জায়গাটি নিজের নয় পরের, সে কথা তার মনেও পড়ে না। আমার বিশ্বাস এই মামুলি কাণ্ডজ্ঞান থাকিলে মানুষ নিজের বাড়ি ও ভাড়াটিয়া বাড়ির মধ্যে। পার্থক্য করিতে পারে না। ভাড়াটিয়া বাড়ির জন্য যেমন ভাড়া দিতে হয়। নিজের বাড়ির জন্যও তেমনি খাযনা-ট্যাক্স দিতে হয়। ওটা না দিলে যেমন বাড়ি থাকে না, এটা না দিলেও তেমনি থাকে না। কাজেই নিজের বাড়িতে বাস করার স্বপ্নে সারা জীবন কষ্ট করার চেয়ে পরের-তৈরি ভাড়াটিয়া বাড়িতে যারা জীবন কাটায়, তারাই বুদ্ধিমান। আহাম্মকেরা ভোজের আয়োজন করে, বুদ্ধিমানেরা তা খায়, ইংরাজি এই প্রবাদটি বাড়ির ব্যাপারেও সত্য।