নগেনবাবু চলিয়া গেলে নিজের কথাগুলিই অনেকক্ষণ পর্যালোচনা করিলাম। চা-নাশতা করিতে করিতে ঐ লইয়া স্ত্রীর সাথে রসিকতা করিবার চেষ্টাও করিলাম। বাধ-বাধ ঠেকিল। বুঝিলাম, রসিকতা করিতে গিয়া অন্তরের কথাই বলিয়াছি। এই কারণেই বোধহয় জীবনে টাকা সঞ্চয় করিলাম না। ব্যাংকের একাউন্ট খুলিলাম না। যেমন আয় তেমনি ব্যয়। এই জন্যই আমি সঞ্চয়কে আহাম্মকি মনে করিয়া থাকি। নিজে না খাইয়া টাকা জমাইয়া যারা বাড়ি-ঘর, ধন-সম্পদ করে, তাদেরে বিদ্রূপ করিয়া আমি অনেক রচনা লিখিয়াছি। কলিকাতা চিত্তরঞ্জন এ্যাভিনিউ-এর সুরম্য প্রাসাদগুলিতে বাস করেন ভোগ-বিলাসী ভাড়াটিয়ারা। আর বাড়িওয়ালা বাস করেন বড় বাজারের তুলাপট্টির কবুতরের খোপে। মাসে লাখ-লাখ টাকা তারা রোযগার করেন, জমা করেন। কিন্তু কাগজের চেক, সোনার মোহর বা রুপার টাকা নয়। ব্যাংকে যা জমা হয় তাও সোনা-রুপা নয়, শুধু ফিগার : লাখের পর কোটি, কোটির পর পরার্ধ্ব। মিলিয়নের পরে বিলিয়ন, তারপর ট্রিলিয়ন। এমনিভাবে কোটিপতি তুলাপট্টির কবুতরের খোপেই মারা যান। পুত্র যদি বাপের মত সাধু-সজ্জন হয়, তবে সে কোটিকে করে পরার্ধ্ব। পরে বাপের মতই মারা যায়। আর সে যদি বুদ্ধিমান হয় তবে মদে-মেয়েলোকে ও রেসে সব উড়াইয়া দেউলিয়া হয়। এইই সঞ্চয়ের পরিণাম। এই সঞ্চয়েরই যারা প্রাণপাত করে, তারা আমাকে নির্বোধ বলিতে পারে, কিন্তু আমিও তাদেরে বুদ্ধিমান বলি না।
সব মতবাদের নৈতিক ও অর্থনৈতিক দুইটা দিকই আছে। ধনতান্ত্রিক সমাজে এই সঞ্চয়কে ক্যাপিটেল কর্মেশন বলে। আমি বলি এটা হোর্ডিং। সব দ্রব্য হোর্ডিং-এর মত এটাও আমার মতে পাপ।
কিন্তু বাড়ি করা সম্পর্কে আমার মতামত আরো অদ্ভুত। ওটা নিছক অর্থনীতিক। ওর কোনও নৈতিক দিক নাই। আমি নিজে বাড়ি না করিয়া ভাড়াটিয়া বাড়িতে থাকার পক্ষপাতী। হিতৈষীরা আমাকে নিজের বাড়ি তৈরি করিতে বহু হিতোপদেশ দান করিয়াছেন। কিন্তু আমাকে রাজি করিতে পারেন নাই।
.
৭. নিজের বাড়ি
নিজস্ব বাড়ি তৈয়ার করিতে আমার কোনও নৈতিক আপত্তি ছিল না। আপত্তিটা ছিল নিছক বিষয়-বুদ্ধির হিসাব-নিকাশের কথা। আমার যুক্তিটা ছিল এইরূপ : আমি বর্তমানে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া দিয়া সে বাড়িতে আছি তা তৈয়ার করিতে কম-সে-কম পঁচিশ হাজার টাকা লাগিয়াছে। এই রকম সুবিধার নিজস্ব বাড়ি তৈয়ার করিতে বর্তমানে আরো বেশি টাকা লাগিবে। তেমন আর্থিক ক্ষমতা আমার নাই। যদি থাকিতও, তবু আমি ঐ টাকা খরচ করিয়া নিজস্ব বাড়ি করিতাম না। কারণ তার অর্থ এই হইত যে, মাসে-মাসে বাড়ি ভাড়া না দিয়া আমি পঞ্চাশ বছরের ভাড়া অগ্রিম দিয়া একটি বাড়ি ভাড়া করিলাম। তাতেও রক্ষা নাই। কোয়ার্টারে-কোয়ার্টারে মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স, বছর-বছর জমির খাযনা, বছর-বছর হোয়াইট ওয়াশ, কিছুদিন পরে-পরে তাতেও এ সব খরচা আমাকে করিয়া যাইতেই হইত। ভাড়াটিয়া বাড়িতে। এসব খরচা আমার নাই। পক্ষান্তরে পঁচিশ হাজার টাকা না থাকা সত্ত্বেও যদি আমাকে নিজের বাড়িতে থাকার গৌরবলাভ করিতে হয়, তবে অল্প টাকা খরচ করিয়া শহরতলিতে ছোট বাড়ি করিয়া থাকিতে হয়। শুধু নিজ বাড়িতে থাকিবার নিছক মানসিক ও কল্পিত অহংকারের খাতিরে আমাকে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, যাতায়াতের সুবিধা, শহরের অভ্যন্তরের সুন্দর বাড়ি ছাড়িয়া অসুবিধাজনক বেকায়দায় অসুন্দর বাড়িতে থাকিবার কষ্ট সহ্য করিতে হয়। বন্ধুরা বলিতেন : ‘তবু ত নিজের বাড়ি। আমি বলিতাম : ভাড়াটিয়া বাড়িইবা আমার নিজের বাড়ি নয় কেন? আমি ত ভাড়াটিয়া বাড়িকেই নিজের বাড়ি মনে করি। ফুলের বাগান করি শাক-সবজির গাছ লাগাই। এমনকি ফলের গাছ লাগাই। ছোটখাটো মেরামত নিজে করাই। কই, কখনও ত মনে হয় না পরের বাড়িতে আছি!’ বন্ধুরা বলিতেন : মাসে-মাসে ভাড়া দাও যখন, তখন কি তোমার মনে পড়ে না পরের বাড়িতে আছ? ভাড়া না দিলেই ত বাড়িওয়ালা তোমাকে উঠাইয়া দিবে। আমি বলিতাম : ‘বছর বছর নিজের বাড়ির ট্যাক্স ও জমির খানা দিতে হইবে। ঐ খাযনা-ট্যাক্স না দিলেও ত জমিদার বা সরকার বাড়ি নিলাম করিয়া আমাকে উঠাইয়া দিবেন। পক্ষান্তরে রীতিমত ভাড়া দিলে কোনও বাড়িওয়ালাই আমাকে উঠাইতে পারিবেন না। আমি পুরুষানুক্রমে এই বাড়িতে থাকিতে পারি। আমার ‘পুরুষানুক্রমে’ কথায় বন্ধুরা বলিতেন : নিজের জন্য না হউক ছেলে-পিলের জন্য তাদের মাথা খুঁজিবার আশ্রয়স্থল হিসাবে একটা বাড়ি নিশ্চয়ই থাকা উচিৎ। তুমি চোখ বুজিলে ছেলে-পিলেরা দাঁড়াইবে কোথায়? আমি হাসিয়া বলিতাম : ‘আমার নিজের জন্য তা হইলে তোমাদের আর ভাবিবার নাই। ছেলেদের কথা? আমার ছেলেরা, সব বাপের ছেলেরাই, মাত্র তিন রকমের হইতে পারে। হয় তারা আমার মত হইবে, নয় আমার চেয়ে ভাল হইবে, অথবা আমার চেয়ে খারাপ হইবে। এই তিন অবস্থার কোনও অবস্থাতেই আমার-তৈরি বাড়ি তাদের কাজে লাগিবে না। প্রথমত, তারা যদি আমার মত হয়, তবে তারাও আমারই মত ভাড়াটিয়া বাড়িতে আমারই মত সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকিতে পারিবে। সুতরাং তাদের জন্য আমার বাড়ি করার দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, তারা যদি আমার চেয়ে ভাল ও বড় হয়, তবে তারা কেউ ঢাকায়, কেউ করাচিতে, কেউ বিদেশে থাকিবে। ময়মনসিংহের মত ছোট শহরে থাকিয়া তারা সুখ পাইবে না। সুতরাং তাদের জন্য আগে হইতে বাড়ি করিয়া রাখা বেকার। তৃতীয়ত, আমার ছেলেরা যদি আমার চেয়ে খারাপ হয়, তবে মূর্খ হইতে পারে, চরিত্রহীন হইতে পারে, নির্বোধ হইতে পারে, চোর-গাঁজা-খোর হইতে পারে। তা হইলে তারা কেউ আমার তৈরি বাড়িতে থাকিবে না। ভাই-এ ভাই-এ মারামারি করিয়া, ভাগাভাগি করিয়া, বিক্রয় করিয়া অথবা বন্ধক দিয়া অন্যত্র নিম্নমানের বাড়িতে থাকিবে। সুতরাং এদের জন্যও আমার বাড়ি করার দরকার নাই। নিজস্ব বাড়ির এই শোচনীয় ভষ্যিৎ দেখাইয়া আমি উপসংহার করিতাম : ‘যে টাকায় বাড়ি করিব, সেই টাকা খরচ করিয়া ছেলেদেরে পড়া-শোনা করাইব, দুধ-ঘি খাওয়াইয়া স্বাস্থ্যবান করিব। আত্মমর্যাদাবান, ভদ্র ও চরিত্রবান করিব। তা যদি করিতে পারি, তবে ভষ্যিতে তাদের মাথা পুঁজিবার ঠাইয়ের জন্য এখন হইতে আমাকে চিন্তা করিতে হইবে না।’