আমিও সরলভাবে আমাদের প্রোগ্রামের যৌক্তিকতা তাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম। আমাদের ন্যাশনাল ইনকাম, পার-ক্যাপিটা ইনকাম, সে ইনকামের সাথে সরকারি কর্মচারীদের আনুপাতিক পার্থক্য, মাথাভারী শাসন ব্যয়ের জন্যই আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব ইত্যাদি উচ্চ পলিটিক্যাল-ইকনমিকসের উপর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা করিলাম। উপসংহারে বলিলাম : ব্যাংক ব্যালেন্স, ইনশিওরেন্স, প্রভিডেন্ট ফান্ড, জুয়েলারি, গহনা-পত্র, অনাবশ্যক সম্পত্তি, বাড়ি-ঘর, সাজ-সরঞ্জাম যার যত আছে সব সরকারে বাযেয়াফত করাই আমাদের প্রোগ্রাম।
আলাপে-আলাপে নগেনবাবুর বাসার সামনে আসিয়া পড়ায় আদাব দিয়া বিদায় হইলাম। কিন্তু বাসায় ফিরিয়া কাপড়-চোপড় ছাড়িতে-না-ছাড়িতেই নগেনবাবু আমার বৈঠকখানায় ঢুকিয়া ‘উকিল সাব’ ‘উকিল সাব’ বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিলেন। রাজা-মহারাজা, লাট-মন্ত্রী হইলেও এ সময়ে নাশতা-চা না খাইয়া বাহির হইতাম না। কিন্তু এ যে হাকিম। ঐ অবস্থায়ই বাহির হইয়া আসিলাম। নগেনবাবু সোজাসুজি বলিলেন : ‘এ ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত না করিলে আজ আমার আহার-নিদ্রা হইবে না। তাই একটা ফয়সালা করিতে আসিলাম।’
ক্ষুধায় আমার মেজাজ গরম হইয়াছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু পরম দক্ষতার সহিত তা গোপন করিয়া হাসি মুখে বলিলাম : আপনারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে টাকা পান, তা আপনারা জমা করেন ভবিষ্যৎ অসুখ-বিসুখ ও আপদ-বিপদে খরচ করিবার জন্য, এই ত? কিন্তু আপনারা কি জানেন না যে, ঐ সঞ্চয়ের দ্বারাই আপনারা নিজেদের অসুখ-বিসুখ ও আপদ-বিপদ ডাকিয়া আনেন?
নগেনবাবু : সেটা কেমন?
আমি : আপনি ভগবানে বিশ্বাস করেন?
নগেনবাবু দাঁতে জিভ কাটিয়া বলেন : কন কি মনসুর সাব? আমি ভগবান মানি না?
বলিয়া তিনি জোড়হাত কপালে ঠেকাইলেন। আমি বলিলাম : আপনি চিত্রগুপ্তের নাম শুনিয়াছেন?
নগেনবাবু যেন অপমানিত হইলেন। বলিলেন : আমি হিন্দু, চিত্রগুপ্তের নাম শুনি নাই আমি?
আমি : বেশ। তা হইলে এই চিত্রগুপ্তের কাজটা কি তাও আপনি জানেন। চিত্রগুপ্ত ভগবানের ফাইন্যান্স মিনিস্টার, চ্যান্সেলার-অব-দি-এক্সচেকার, প্রজেক্ট ডাইরেক্টর, একাউন্টেট-জেনারেল ও অডিটর-জেনারেল। তিনি চতুর্দশ, যমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যম। মানেন আপনি?
নগেনবাবু জীবন ফাটাইয়াছেন মোকদ্দমার ফাইল ও আইনের পুস্তক পড়ায়। অত কথা তিনি জানেন না। তবু আমার মত আইনজ্ঞের কাছে সে কথা স্বীকারও করিতে পারেন না। তাই শুধু সম্মতিসূচক মাথা ঝুকাইলেন।
.
৬. চিত্রগুপ্তের বাজেট
আমি বলিতে লাগিলাম : মানুষের জীবন-মৃত্যু, অসুখ-বিসুখ, সুখ-সম্পদ ও আপদ-বিপদের মালিক এই চিত্রগুপ্ত। ভগবান এই চিত্রগুপ্তকে কনসাল্ট করিয়াই এ সব বিলি-বণ্টন করিয়া থাকেন। আমাদের গবর্নমেন্ট যেমন বছরের গোড়াতে ফাইনান্স মিনিস্টারের মারফত বাজেট রচনা ও ঘোষণা করিয়া থাকেন, ভগবানও তেমনি প্রতি বছর শিবরাত্রিতে চিত্রগুপ্তের মারফত এটা করিয়া থাকেন। মুসলমানদের আল্লাহ এ বাজেট করেন শবে-বরাতে। অসুখ-বিসুখ ও আপদ-বিপদের কথাটাই ধরা যাউক। শিবরাত্রে ভগবান সভাসদ লইয়া বাজেট করিতে বসেন। চিত্রগুপ্ত বসেন তাঁর খাতা-পত্র লইয়া। ভগবান চিত্রগুপ্তকে ডাকিয়া বলেন : দেখ ত অমুক মহারাজের অসুখ-বিসুখের তহবিলে কত টাকা আছে। চিত্রগুপ্ত খাতা দেখিয়া বলিলেন : এক লাখ। ভগবান বলিলেন : দেও তারে একটা ক্যানসার। ভগবান বলেন : দেখ ত অমুক রাজা-বাহাদুরের ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত বলেন : পঞ্চাশ হাজার। ভগবান বলেন : দেও তারে একটা করোনারি থ্রম্বসিস। এরপর দেখ ত অমুক রায় বাহাদুরের ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত বলিলেন : বিশ হাজার। ভগবান বলেন : দেও তারে একটা টিবি। তারপর দেখ ত সাব-জজ নগেনবাবুর ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত খাতার পাতা উল্টাইয়া বলেন : দশ হাজার। ভগবান বলেন : দেও তারে একটা ডায়েবেটিস। তারপর দেখ ত সরকারি উকিল সতীশ দত্তের ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত বলিলেন : মাত্র পাঁচ হাজার সার। ভগবান বলিলেন : দেও তারে একটা টায়ফয়েড। তারপর দেখ ত উকিল উপেন দের ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত দুই-তিনবার পাতা উল্টাইয়া আঙুলে গনিয়া বলেন : মাত্র পাঁচ শ টাকা মহারাজ। ভগবান ঘাড় ও মাথা চুলকাইয়া অবশেষে বলেন : কি আর দিবে ওকে? দেও একটা সর্দি-জ্বর। তারপর দেখ ত অশ্বিনী মোখতারের ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত অত বড় খাতাটার এক মলাট হইতে অপর মলাট পর্যন্ত দুই-তিনবার উল্টাইয়া অবশেষে বলিলেন : এক পয়সাও নাই, ভগবান। ভগবান তখন সকলের দিকে চাহিয়া মুচকি হাসিয়া বলেন : দেও, ও-হতভাগাকে ছাড়িয়াই দেও।
আমি গোড়াতে ক্ষুধার মেজাজে রাগ করিয়া নগেনবাবুকে উত্ত্যক্ত করিবার জন্যই বোধহয় কথাগুলি শুরু করিয়াছিলাম। কিন্তু অল্পক্ষণেই অনুপ্রেরণার উচ্চস্তরে উঠিয়া গেলাম। ক্ষিধা বেশি লাগিলে আমার বক্তৃতা ভাল জমে। সেদিনও বোধ হয় তাই হইয়াছিল। দেখিলাম নগেনবাবু হাঁ করিয়া আমার কথাগুলি গিলিতেছেন।
আমার কথা শেষ হইলে তিনি গম্ভীর মুখে বলিলেন : আপনি যে সব কথা বলিলেন, তা সত্যি-সত্যি শাস্ত্রের কথা নাও হইতে পারে কিন্তু কথাগুলি সত্য। নিজের জীবনেই আমি তার ফল পাইয়াছি। আপনার কথা শুনিবার পর আজ তা বুঝিলাম। আপদ-বিপদ অসুখের নামে যত বেশি জমাইয়াছি, সত্য-সত্যই আপদ-অসুখ তত বাড়িয়াছে। তার এক ছেলে যে মারা গিয়াছে, তার এক মেয়ে যে বিধবা হইয়াছে, তার সঙ্গে নিজের ঐ সময়ের সঞ্চয়ের কার্য-কারণ সম্পর্কে দেখাইলেন।