চল্লিশ বছর আগের কথা। মাঝে-মাঝেই মনে হইয়াছে, নবাব সাহেবের কথাই বোধহয় ঠিক। কিন্তু মৌলবী মুজিবর রহমানের মূর্তি নবাব সাহেবের মূর্তিকে পিছনে ঠেলিয়া দিয়াছে। আমি এই সান্ত্বনা দিয়াছি মনকে : পরকে ঠকাইতে পারার আনন্দের চেয়ে নিজে ঠকিতে পারার আনন্দে মজা অনেক বেশি। একবার এক হোস্টেল মেটের হাতে পাঁচ টাকা ঠকিয়া যে সম্পদ অর্জন করিয়াছিলাম, প্রতিশোধ নিতে গিয়া তাকে দশ টাকা ঠকাইবার আগুনে সে সম্পদ পোড়াইয়া ছারখার করিয়াছি। তারপরেও আগুন নিবে নাই। জীবন সায়াহ্নে আজো আমি বিশ্বাস করি : অবিশ্বাস করিয়া ঠকার চেয়ে বিশ্বাস করিয়া ঠকা ভাল।
অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার যৌবন হইতেই সীমাবদ্ধ ছিল। মনে করি, আজো তাই আছে। মনে আছে, ছাত্র-জীবনে একবার ত্রিপুরা স্টেট লটারির টিকিট কিনিয়াছিলাম। তৎকালে ওর প্রথম পুরস্কার ছিল এক লাখ। টিকিট কিনিয়া আমার ঘুম নষ্ট হইল। যদি ফার্স্ট প্রাইয পাই, তবে ঐ লাখ টাকা দিয়া আমি করিব কী? আমি যৌবনের সোনালি স্বপ্নের অনেক চিত্র মনে-মনে। আঁকিলাম। কিন্তু লাখ টাকা খরচের কোনও উপায় বাহির করিতে পারিলাম না। রূপান্তরে সে মনোভাব আমার আজো আছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকাকে আমি সত্যই ভয় পাই। পাকিস্তান সরকারের শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রী হওয়ায় আমার চার কোটি টাকার বদনাম হইয়াছে। এ নিয়া কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুসহ ডন-এর এডিটার আলতাফ হোসেনের সাথে আমার রম্য আলাপ হইতেছিল। বন্ধু বলেন : ‘শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রিত্ব একটা সাংঘাতিক ক্ষমতার পদ। এই দুইটা গদিতে একই ব্যক্তি বসিলে তার কাছে চার কোটি কেন, তার চেয়ে বেশি টাকার অফার আসিতে পারে। তুমি কি বলিতে চাও তোমার কাছে কোনও অফার আসে নাই?’ আমি সত্য কথা সরলভাবে স্বীকার করিলাম : নিশ্চয় আসিয়াছে, পরোক্ষভাবে।
বন্ধু বলেন : ‘ঘুষের অফার ইনডিরেকটলিই আসে। সোজা আসে না। তুমি কি এতই একটা ফেরেশতা যে ঐ সব লোভ তুমি সম্বরণ করিয়াছ শুধু সাধুতার খাতিরে?’ আমি সরলভাবে বলিলাম : সাধুতার খাতিরে নয়, অফারের বিশালতার ভয়ে।
.
৫. অর্থম-অনর্থম
মানুষের আর্থিক প্রয়োজন সম্পর্কে আমার মনের কথা বাহির হইয়া পড়িয়াছিল একদা আকস্মিকভাবে। আলাপ হইতেছিল এক জজ সাহেবের সাথে। তখন আমি ময়মনসিংহে উকালতি করি (অনুমান ১৯৩৫-১৯৩৬ সাল)। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু প্রবীণ সাব-জজ। খুব কড়া ও যশস্বী বিচারক। আইনের পোকা। আমার মত জুনিয়র উকিল ত দূরের কথা তার কোর্টে দাঁড়াইতে অনেক সিনিয়র উকিলেরও হাঁটু কাঁপিত। আমার বাসায় যাইতে এই জজ সাহেবের বাসার সামনে দিয়াই যাইতে হইত। কোর্ট-ফেরতা প্রায়ই এক সঙ্গে যাইতাম। উকিল হিসাবে জুনিয়র হইলেও কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা পার্টির নেতা হিসাবে আমি গণ্যমান্য লোক ছিলাম। নগেন বাবু রাজনীতির ‘রা’ও জানিতেন না বটে, কিন্তু অন্য সব ব্যাপারে সদালাপী ছিলেন। বাসায় ফিরিতে এই সবই আলোচনা হইত।
বাসায় ফিরিবার পথে প্রায় প্রতিদিনই তিনি নিজে বাজার করিতেন। বাজার মানে দুই আনা-দশ পয়সার গুড়া মাছ, কয়েক আনার তরি-তরকারি। কলাপাতা বা কচু পাতার ঠোঙ্গায় মাছ বাম হাতে এবং তরি-তরকারি ডান হাতে লইয়া নূতন বাজার হইতে বাহির হইতে নগেনবাবুকে প্রায়ই দেখা যাইত।
একদিন আমি তাকে বলিলাম : এত টাকা মাহিয়ানা পান, খাওয়ায় এত কৃপণতা করেন কেন?
দুঃখিত হইয়া নগেনবাবু বলিলেন : অত টাকা মাহিয়ানা দেখিলেন কই?
আমি যখন স্মরণ করাইয়া দিলাম, তার মাহিয়ানা সাড়ে তেরশ টাকা, তখন তিনি বলিলেন : ঐ শুনিতেই শুধু তেরশ।
অতঃপর তিনি ইনকাম ট্যাক্স, ইনশিওরেন্স, প্রভিডেন্ট ফান্ড, সেভিং ব্যাংক ইত্যাদির সঠিক অঙ্ক উল্লেখ করিয়া দেখাইলেন যে, শেষ পর্যন্ত তাঁর হাতে আসে মাত্র আড়াইশ টাকা। আমি জবাবে বলিলাম যে, এক ইনকাম ট্যাক্স ছাড়া আর সব খরচই তার ইচ্ছাধীন। তাঁর অত-অত টাকা জমা করার কোনও আবশ্যকতা নাই। তিনি তখন সঞ্চয়ের আবশ্যকতা বুঝাইলেন। অসুখ-বিসুখ, আপদ-বিপদ কতটাই ত আছে।
আমি তখন মৌলিক কথায় চলিয়া গেলাম। বলিলাম: তাহা হইলে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইল যে, আপনার মাসিক প্রয়োজন মাত্র আড়াইশ টাকা। এর বেশি যে টাকা আপনি বেতন পান, সেটা বাহুল্য।
সেটা কৃষক-প্রজা আন্দোলনের যুগ। জমিদারি উচ্ছেদ, মন্ত্রী-বেতন হাজার টাকা, শাসন-ব্যয় হ্রাস, সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমান, তৎকালে প্রাত্যহিক স্লোগান। রাস্তা-ঘাটের আলাপের এবং খবরের কাগজের আলোচনার বিষয়। নগেনবাবু আমার কথার বাস্তব অর্থ করিলেন। ব্যগ্রতার সঙ্গে বলিলেন : আপনারা কি সত্য-সত্যই অফিসারদের বেতন কমাইতে চান? বিচার বিভাগের লোকেরও?
আমি যখন বলিলাম ‘নিশ্চয়ই’, তখন তিনি আন্তরিক ব্যাকুলতার সঙ্গে মুনসেফ-জজদের রাতদিন গাধার খাটুনির তুলনায় বেতনের স্বল্পতা, দেড়শ টাকায় মুনসেফি শুরু করিয়া তেরশতে পৌঁছাতক প্রায় কুড়ি বছরের দুঃখ কষ্ট, অভাব-অনটনের কথা বিস্তারিত বলিলেন। তিনি অন্তত মুনসেফ-সাব জজদের বেতন না কমাইবার জন্য আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করিলেন। এটা তিনি এমনভাবে করিলেন, আমিই যেন কমানের কর্তা এবং আজই যেন সে অর্ডার দিতেছি।