গাজী সাহেবের এন্তেকালের কয়েক বছর পরে তার একমাত্র পুত্র জাফর সাহেব নওগাঁ (আসাম) চলিয়া যান। দেশভাগ হওয়ার আগেত বছরে দু’বছরে একবার জাফর চাচা আমাদেরে দেখিতে আসিতেন। তিনি তখন খুব অবস্থাশালী মাতব্বর ‘গা বুড়ো’ ছিলেন। তিনি ইতিমধ্যে আসামেই এন্তেকাল করিয়াছেন বোধ হয় প্রায় আশি বছর বয়সে। আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য, দুই-একবার বড়দের জন্যও, এন্ডিমুগার কাপড় ও অন্যান্য উপহার আনিতেন। বর্তমানে (১৯৬২) তার ছেলেরা শিক্ষিত ও অবস্থাশীল ভারতীয় নাগরিক।
আছরউদ্দিন ফরাযী সাহেবের তিন পুত্র হওয়ার পর চতুর্থ সন্তান হয়। একটি মেয়ে। এই মেয়ে প্রসব করিয়াই আছরউদ্দিন সাহেবের বিবি এন্তেকাল করেন। আছরউদ্দিন সাহেব এর পরেও বহুদিন বাঁচিয়া ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন নাই। নবজাত শিশুকন্যাকে তিনি তাঁর বিশেষ বন্ধু কাজীর শিমলা গ্রামের জানু খোন্দকার সাহেবের কাছে পোষ্য দেন। জানু খোন্দকার সাহেবের কোনো সন্তানাদি না থাকায় বন্ধুর মেয়েকে পোষ্য নিয়াছিলেন। কিন্তু পোয্য নেওয়ার কয়েক বছর পরেই তার এক পুত্রসন্তান। লাভ হয়। ইনিই কাজীর শিমলা গ্রামের খোন্দকার মিজানুর রহমান। জানু খোন্দকার সাহেব তার পালিত কন্যাকে যথাসময়ে নিজের আত্মীয়ের মধ্যে যোগ্য ঘরে পাবনা জিলার চৌহালী গ্রামের খোন্দকার বাড়িতে বিবাহ দেন। সেখানে আমার উক্ত দাদির এক পুত্র ও এক কন্যা হয়। পুত্র খোন্দকার আলাউদ্দীন আহমদ বিখ্যাত আলেম ও ম্যারেজ রেজিস্ট্রার ছিলেন। ভাইবোন উভয়েরই বংশধরেরা আজিও সুখে-সম্মানে বাঁচিয়া আছেন।
অধ্যায় দুই – জন্ম ও শৈশব
১. জন্ম
বাংলা ১৩০৫ সালের ১৯ ভাদ্র (ইং ১৮৯৮, ৩ সেপ্টেম্বর) শনিবার ফযরের ওয়াতে আমার জন্ম। আমি বাপ-মার তৃতীয় সন্তান। আমাকে পেটে লইয়াই মা গুরুতর অসুখে পড়েন। সে রোগ দীঘস্থায়ী হয়। আমার জন্মের অনেক দিন পরে তিনি আরোগ্য লাভ করেন। কয়েক দিন স্থায়ী বেদনার পরে আমি ভূমিষ্ঠ হই এবং প্রসবের পরেই মা অজ্ঞান হইয়া পড়েন। আগের দুই প্রসবে মার কোনোই কষ্ট হয় নাই। কাজেই আমার প্রসবের সময়কার মার। এই কষ্ট ও এই অজ্ঞান হইয়া পড়াকে বাড়ির সকলে অশুভ লক্ষণ মনে। করেন। মা শ্বশুর-শাশুড়ির আদরের বউ ছিলেন। মার জন্য সকলে কান্নাকাটি জুড়িয়া দেন।
এদিকে দাই আমাকে প্রসব করাইয়া ঘোষণা করে যে মৃত সন্তান হইয়াছে। সাধারণ অবস্থায় দাইদের অমন কথায় কেউ বিশ্বাস করিতেন না। নিজ চক্ষে সন্তান দেখিবার জন্য সবাই উদ্বিগ্ন হইতেন। কিন্তু আদরের বড় বউয়ের মরা-বাঁচা লইয়া সবাই এত ব্যস্ত ছিলেন যে মরা সন্তান দেখিবার জন্য কেউ বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন নাই। কাজেই মরা সন্তানটিকে যথাসময়ে দাফন-কাফন করা সাপেক্ষে আমাকে একটি সুপারির খোলে ঢাকা হয় এবং বাইরে ফেলিয়া রাখিলে কাক-কুকুরে নিয়া যাইতে পারে বলিয়া ঘরের এক অন্ধকার কোণে রাখা হয়।
মেয়ের অন্তিম অবস্থায় খবর পাইয়া আমার নানা মেহের উল্লা ফরাযী আসেন মেয়েকে দেখিতে। নানাজী গৌরবর্ণ দীর্ঘাঙ্গ সুপুরুষ ছিলেন। তাঁর চাপদাড়ি ও সুউচ্চ বাঁশির মত নাকটা দেখিবার মত ছিল। নাকের আগাটা ময়না পাখির ঠোঁটের মত বাঁকা ছিল। নানার মুখে শুনিয়াছি তাঁর বাবা মহব্বত উল্লা ফরাযী আরো গৌরবর্ণ সুপুরুষ ছিলেন। তাঁর নাকটা নাকি আরো সুন্দর ছিল। যা হোক, নানাজী ছিলেন এ অঞ্চলে ডাকসাইটে ধানুরি (ধন্বন্তরি) কবিরাজ। তিনি মেয়েকে দেখিয়া-শুনিয়া এবং তয়-তদবিরের পরামর্শ দিয়া মরা নাতিটি দেখিতে চাহিলেন। তাঁকে ঘরের কোণে রাখা সুপারির খোলটি দেখাইয়া দেওয়া হইল। নানাজী সুপারির খোলটি খুলিয়া আমাকে দেখিলেন। নাড়ি ও বুক পরীক্ষা করিয়া ঘোষণা করিলেন, সন্তানের জান এখনও কবয হয় নাই, যত্ন-তালাফি করিলে এখনও বাঁচিবার আশা আছে। আমার দাদি নানাজীর কথায় দাইকে লইয়া তদবির-তালাফির কাজে লাগিলেন। নানাজীর কথামত কিছুক্ষণ তালাফি করিবার পরই আমি কাঁদিয়া উঠি। নানাজী আমার কানে কলেমা তৈয়ব বারবার আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। বাড়িময় এবং শেষে পাড়াময় চাঞ্চল্য পড়িয়া যায়। নানাজীর প্রশংসায় দেশ ফাটিয়া যায়। তিনি জিন পালিতেন, এ ধারণা লোকের আগেই ছিল। এবার প্রমাণ হইল তিনি মরা মানুষও বাঁচাইতে পারেন। আমার জ্ঞান হইবার পরও বহুদিন দাদি-ফুফু-চাচি এই গল্প করিতেন। বলিবার সময় দাদির নিজের এবং আমার মারও চোখ পানিতে ছলছল করিয়া উঠিত। আমি নিজেও খুব পেট-কান্দুয়া ছিলাম, অর্থাৎ কথায়-কথায় কাঁদিয়া ফেলিতাম। আমিও ঐ গল্প শুনিয়া কাঁদিয়া ফেলিতাম। দাদি-ফুফু বা মা যাকে হাতের কাছে পাইতাম, তাঁরই কোলে মাথা লুকাইয়া ফ্যাক-ফ্যাক করিয়া কাঁদিতে থাকিতাম। মার কাছে ছিল এসবই শোনা কথা। কারণ, এসব ঘটনা ঘটিয়াছিল তাঁর অজ্ঞান অবস্থাতেই। তবু তিনি বহুবার ঐ শোনা কথা বহু মেয়েলোকের কাছে আবৃত্তি করিয়াছেন। আমি কাছে থাকিলে আমাকে বুকে জড়াইয়া বলিতেন, আল্লা আমার হারানো মানিক ফিরাইয়া দিয়াছে।
.
২. স্বাস্থ্য ও ভাগ্য
আমার স্বাস্থ্য বরাবর খারাপ ছিল। প্রধান কারণ মার দুধ পাই নাই। আমার জন্মের পর পুরা এক বছর মা অসুস্থ থাকেন। গরুর দুধ ও ভিমটা কলাই ছিল আমার একমাত্র খাদ্য। বোধ হয় এ কারণেই আমার পেটের অসুখ সর্বদা লাগিয়াই থাকে। ফলে আমার শরীর স্বাভাবিক পুষ্টি লাভ করে নাই। দূর হইতে আমার বুকের ও পাঁজরার হাড়ি গোনা যাইত। হাত-পা লম্বা লম্বা শুকনা কাঠি আর মাথাটা ইয়া বড়। দাঁড়াইলে মনে হইত ঝাঁটার শলার আগায় একটা বেগুন গাঁথিয়া খাড়া করিয়া রাখা হইয়াছে। বস্তুত, এই উপমাটাও লোকজনের দেওয়া। এইরূপ স্বাস্থ্য ও জন্মের সময়কার ঐ অনৈসর্গিক ঘটনার জন্য আমার মুরুব্বিরা আমার জীবন সম্পর্কে সর্বদাই সন্ত্রস্ত থাকিতেন। তারা প্রায়ই বলিতেন, “এটা কি বাঁচিবে? মায়া বাড়াইয়া কোনো দিন না কোনো দিন আমাদেরে কান্দাইয়া চলিয়া যাইবে। মুরুব্বিদের এই সন্ত্রাস আরো বাড়াইবার জন্যই বোধ হয় আমার শরীরের উপর দিয়া ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটিয়া যাইত। মরিতে-মরিতে বাঁচিয়া উঠিতাম।