জিন-পরি-ভূত-প্রেতে লোকেরা আজও বিশ্বাস করে। আগে আরো বেশি বিশ্বাস করিত। আগেকার জনসাধারণের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তার লেভেল বুঝাইবার উদ্দেশ্যেই গাজী সাহেব সম্বন্ধে ঐ সব কিংবদন্তির উল্লেখ করিলাম।
.
৯. গাজী সাহেবের বিবাহ ও সন্তানাদি
গাজী সাহেব ১৮/২০ বছর বয়সে ১৮২৭/২৮ সালে মোজাহেদ বাহিনীতে যোগ দেন। ত্রিশ-বত্রিশ বছর পরে প্রায় ১৮৬০ সালের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে কমবেশি পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধ বাড়ি ফিরিয়া আসেন। আমার দাদাজী ও গাজী সাহেবসহ আমাদের পূর্বপুরুষেরা সবাই কৃষ্ণবর্ণ ছিলেন। কিন্তু সবাই আমারই মত লম্বা ছিলেন। পরিমাণমত মোটাসোটা, উঁচা-নাক, চাপ দাড়িওয়ালা ছিলেন। গাজী সাহেব ব্যায়ামবীর ও যোদ্ধা হওয়াতে তিনি দেখিতে আরো বলিষ্ঠ এবং সুপুরুষ ছিলেন। সেইজন্য ঐ পঞ্চাশ বছর বয়সেও তাকে বুড়া দেখাইত না। মাথার চুল ও দাড়ি-মোচে বেশ পাক ধরিয়াছিল বটে, তবে খুব কাছে না গেলে তা দেখাই যাইত না।
কাজেই স্বয়ং দাদাজী, আত্মীয়-স্বজন ও শিষ্য-শাগরেদরা সবাই ধরিলেন তাঁকে বিয়া করিয়া সংসারী হইতে। তিনি অনেক ওযর-আপত্তি দেখাইয়া, এমনকি নিরাপত্তার অনিশ্চয়তার দোহাই দিয়া, ঘন ঘন তাঁর আত্মগোপনের হেতুর দিকে ইশারা করিয়া অনেক দিন বিয়া ঠেকাইয়া রাখিলেন। আনুমানিক পাঁচ-ছয় বছর পরে তিনি বিয়া করিলেন। বিয়া করিলেন এক শাগরিদের মেয়েকে। তাঁর বাড়ি ছিল ফুলবাড়িয়া থানার পশ্চিম সীমান্তে বালাশর নামক গ্রামে। অন্তরঙ্গ শাগরিদরা ঠাট্টা করিয়া বলিতেন, শাহাদাঁতের পবিত্র ময়দানে বালাকুটের নামের সাথে এই গ্রামের মিল আছে বলিয়াই গাজী সাহেব সেখানে বিয়া করিতে রাজি হইয়াছেন।
যা হোক, ঘরে ভাবি আনিবার সঙ্গে সঙ্গেই দাদাজী পৈতৃক ভূসম্পত্তির (তত্ত্বালে প্রায় ২শ বিঘা) অর্ধেক ভাগ করিয়া বড় ভাইকে দিয়া দিলেন। সেই জমি চাষাবাদ করিবার জন্য ভাল-ভাল বর্গাদারও ঠিক করিয়া দিলেন তিনিই। গাজী সাহেবের থাকিবার জন্য দাদাজী আগেই ভাল একটি ঘর করিয়া দিয়াছিলেন। এখন পৃথক পাকঘরও বানাইয়া দিলেন। দাদাজীর নিজের দুই-তিন জোড়া হাল ও দরকারমত বছরিয়া কামলা ছিল। দাদাজী তাদের সঙ্গে লইয়া হাল-চাষাবাদ, গৃহস্থের সব কাজকর্ম নিজে করিতেন। কিন্তু গাজী সাহেব ঐসব কিছুই পারিতেন না বলিয়া সব জমি বর্গাপত্তন দিয়া দিলেন। কিন্তু গাজী সাহেব এর পরেও প্রায়শ কাউকে না বলিয়া নিরুদ্দেশ হইতেন বলিয়া গাজী সাহেবের সংসারের হাট-বাজারটাও দাদাজীকেই করিয়া দিতে হইত।
এই বিয়ার ঘরে প্রথমে ফাতেমা নাম্নী একটি মেয়ে হইল। কয়েক বছর পরে দ্বিতীয় প্রসবের সময় একটি পুত্রসন্তানসহ গাজী সাহেবের বিবি সাহেবও এন্তেকাল করিলেন। গাজী সাহেব দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে রাজি হইলেন না। ইতিমধ্যে দাদাজীর ঘরে যমিরুদ্দিন ও ছমিরুদ্দিন নামে আরো দুইটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করিলেন। গাজী সাহেব দ্বিতীয়বার বিয়া না করার আরো একটি যুক্তি পাইলেন। দাদাজীকে বলিলেন, খোদার রহমতে তোমারই যখন তিনটি পুত্র হইল তখন এরাই আমাদের খান্দানের নাম রাখিবে। আমার আবার বিয়ার দরকার নাই। দাদাজী ও আত্মীয়-স্বজনের উপরোধ এড়াইবার জন্যই যেন গাজী সাহেব এবার বেশ কিছুদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হইলেন।
গাজী সাহেব মাঝে-মাঝে নিরুদ্দেশ হইয়া কোথায় যান প্রায় সবাই তা অনুমান করিতে পারিতেন। কারণ অতীতে অনেকবার এমন ঘটিয়াছে। তাঁর যাওয়ার স্থান ছিল সাধারণত মোজাহেদ ভাইদের বাড়ি। দাদাজীর মুখে ছেলেবেলা এইসব মোজাহেদ ভাইদের নাম প্রায়ই শুনিয়াছি। এখন আর সকলের নাম-ঠিকানা মনে নাই। যে কয়জনের নাম মনে আছে, তাঁদের মধ্যে আটিয়া (বর্তমান টাঙ্গাইল) মহকুমার দেলদুয়ারের মৌ, ইব্রাহিম, আকালুর খোন্দকার যহিরুদ্দিন ও জামালপুর মহকুমার নূর আলী তরফদারের নাম মনে আছে। নূর আলী সাহেব জেহাদে শহীদ হইয়াছিলেন। কাজেই তিনি দেশে আর ফিরিয়া আসেন নাই। খোন্দকার যহিরুদ্দিন বোধ হয় পুলিশের ধাওয়ায় আকালু ত্যাগ করিয়া জামালপুরের বানেশ্বরদী গ্রামে চলিয়া আসেন এবং সেখানেই বিয়া-শাদি করিয়া বসবাস করিতে শুরু করেন। শহীদ নূর আলী সাহেবের এক পুত্র ছিলেন। তিনি তখন বিবাহ করিয়াছিলেন। কাজেই গাজী সাহেবের যাওয়ার স্থান ছিল আটিয়ার একটি : মৌ. ইব্রাহিমের বাড়ি, আর জামালপুরে দুইটি : খোন্দকার যহিরুদ্দিনের এবং নূর আলী তরফদারের বাড়ি। দাদাজী ও আত্মীয়েরা এসব জায়গায় খোঁজ করিতেন না, শুধু অনুমান করিতেন। তৎকালে খোঁজখবর লওয়ার ও যাতায়াতের মোটেই সুবিধা ছিল না। কিছুদিন নিরুদ্দেশ থাকিয়া গাজী সাহেবই ফিরিয়া আসিয়া এই সব ও অন্যান্য জায়গার নাম করিতেন।
বেশ কিছুদিন পরে এবার ফিরিয়া আসিলে দাদাজী ও আত্মীয়-স্বজনেরা একরূপ জোর করিয়া আমাদের পুরাতন আত্মীয় ফুলবাড়িয়া (বর্তমানে ত্রিশাল) থানার মাগুরজোড়া গ্রামের মৌ. আহসানুল্লাহ সাহেবের এক বোনের সাথে বিয়া দেন। গাজী সাহেবের এই বিয়া স্থায়ী হয়। এই ঘরে জাফর নামে একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। গাজী সাহেবের দেশ ভ্রমণের বাতিকও দূর হয়। গাজী সাহেব বিবাহিতা কন্যা ফাতেমা ও নাবালক পুত্র জাফর সাহেবকে রাখিয়া অনুমান ষাট বছর বয়সে এন্তেকাল করেন। তৎকালে বয়স আন্দাজ-অনুমান করিয়াই বলা হইত। তেমন অনুমানের কতকগুলি অবিস্মরণীয় ঘটনাকেই হিসাবের খুঁটি ধরা হইত। যেমন ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১২৭৬ সালের আকাল), গদর (সিপাহী বিদ্রোহ ইং ১৮৫৮ বাং ১২৬৫), বালাকুটের জেহাদ (বাং ১২৩৮ ইং ১৮৩১), তিতুমীরের লড়াই (১৮৩১ ইং) ইত্যাদি। দাদাজীর জন্মতারিখও এ ধরনে হিসাব করা হইত। কিন্তু আশ্চর্য এই যে বাপজী ও চাচাজীর কুষ্ঠি ছিল। দাদাজীর বন্ধু এক বামন ঠাকুর নাকি ঐ কুষ্ঠি তৈয়ার করিয়াছিলেন। চাচাজী নজ্রমিকে কুফরি বলিতেন। কিন্তু নিজের কুষ্ঠিটি তিনি ছিঁড়িয়া ফেলেন নাই। গণক ছাড়া কেউ কুষ্ঠি পড়িতে পারিতেন না। তবে জন্ম-মৃত্যুর সন বুঝা যাইত। কুষ্ঠি অনুসারে বাপজীর জন্ম ১২৬৫ সন ও চাচাজীর জন্ম ১২৭২ সন। বাপজী ১৩৪১ সালে ইং ১৯৩৪ সালে ৭৯ বৎসর বয়সে এন্তেকাল করেন। চাচাজী ৮৫ বৎসর বয়সে ১৩৫৭ সালে (ইং ১৯৫০) এন্তেকাল করেন। দাদাজীর কোনো কুষ্ঠি ছিল না। নিজের জন্মতারিখ তিনি বলিতে পারিতেন না। তবে তিনি তাঁর বয়স পঁচানব্বইর কাছাকাছি দাবি করিতেন। ১৯১৩ সালে এন্তেকালের সময় দাদাজী আমাদের অঞ্চলে সর্বজ্যেষ্ঠ বৃদ্ধ ছিলেন। গদরের (সিপাহী বিদ্রোহের) দুই-তিন বছর পর গাজী সাহেব যখন দেশে ফিরিয়া আসেন, তখন দাদাজীর বয়স প্রায় চল্লিশ ছিল, এ সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। এই হিসাবে দেখা যায়, আমার পূর্বপুরুষের সকলেই মোটামুটি দীর্ঘায়ু ছিলেন। দাদাজী বলিতেন, তাঁর বাবা আছরউদ্দিন ফরাযী সাহেবও সত্তরের অধিক বয়সে মারা যান। আমার একমাত্র ফুফু আয়েযুননেসা দুইবার সন্তানহীন অবস্থায় বিধবা হওয়ার পর আর বিবাহ বসেন নাই এবং শেষ দিন পর্যন্ত আমাদের বাড়িতেই থাকেন। তিনি কমবেশি তিরানব্বই বৎসর বয়সে ১৩৫০ সালে (ইং ১৯৪৩) এন্তেকাল করেন।