গাজী সাহেব লাঠি বা তলওয়ার হাতে এক জায়গায় দাঁড়াইতেন। তাঁর চারপাশে আট-দশ হাত দূরে-দূরে চারজন লোক দাঁড়াইত। তাদের এক-এক জনের কাছে এক-এক ধামা বেগুন। চারদিক ঘিরিয়া পাঁচ গাঁয়ের লোক ভিড় করিয়া তামাশা দেখিত। ধামাওয়ালা চারজন লোক ক্ষিপ্ত হস্তে একযোগে গাজী সাহেবের মাথা হইতে কোমরের উপর পর্যন্ত শরীর সই করিয়া বেগুন ছুড়িতে থাকিত। গাজী সাহেব কখনও শুধু লাঠি বা শুধু তলওয়ার, কখনো বা এক হাতে লাঠি এক হাতে তলওয়ার লইয়া একই জায়গায় দাঁড়াইয়া চরকির মত ঘুরিতেন এবং লাঠি বা তলওয়ার অথবা লাঠি ও তলওয়ার ঘুরাইতেন। দর্শকেরা বিস্ময়ে দেখিত, একটি বেগুনও গাজী সাহেবের গায়ে লাগে নাই। লাঠি বা তলওয়ারে ঠেকিয়া বেগুনগুলি মাটিতে পড়িয়া যাইত। ধামাওয়ালাদের ধামার বেগুন শেষ হইলে গাজী সাহেব তার হাতের লাঠি বা তলওয়ার ঘুরানো বন্ধ করিতেন। তখন সকলে মিলিয়া একটা-একটা করিয়া দেখিত যে তলওয়ারে লাগা বেগুনগুলি সব দুই টুকরা হইয়া গিয়াছে, আর লাঠিতে লাগা বেগুনগুলিতে লাঠির দাগ পড়িয়াছে। এইরূপ উস্তাদির জন্য জনসাধারণের কাছে, বিশেষত যুবকদের কাছে, গাজী সাহেবের জনপ্রিয়তা ছিল বিপুল। গাজী সাহেবের হুকুমে জান দিবার জন্য তৈয়ার ছিল গাঁয়ের শত-শত যুবক। কিছুকাল পরে পুলিশ নাকি তলওয়ার খেলা নিষিদ্ধ করিয়া দেয়। কাজেই গাজী সাহেব আর তলওয়ার ব্যবহার করিতেন না। শুধু লাঠি খেলিয়া এই উস্তাদি দেখাইতেন। তলওয়ারের জন্য পীড়াপীড়ি করিলে গাজী সাহেব অগত্যা রাম। দাও দিয়া সে খেলা দেখাইতেন। কিন্তু তাতে দর্শকদের মন ভরিত না।
শাগরেদদের ও স্থানীয় যুবকদের কাছে গাজী সাহেবের জনপ্রিয়তার আরো অনেক কারণ ছিল। তারা বিশ্বাস করিতেন, গাজী সাহেব জিন-পরি পালিতেন। তাঁদের মধ্যে আমার ছেলেবেলায় যাঁরা বাঁচিয়াছিলেন, তাঁদের অনেকেই নিজের চক্ষের দেখা বলিয়া অনেক নজির দিতেন। এঁদের মধ্যে পূর্ব-বর্ণিত কারী ময়েযুদ্দিন সাহেব, আমার দূর সম্পর্কের এক দাদা রমজান আলী শাহ ফকীর, আমার দূর সম্পর্কের এক নানা পূর্ব-বর্ণিত ওয়ালী মাহমুদ মির্যা, আমাদের নিকট প্রতিবেশী বাবুজান শেখ, শরাফত শেখ ও পূর্ব-বর্ণিত ইব্রাহিম শেখ প্রভৃতি আরো অনেকে এই ধরনের মাযেজার সাক্ষ্য দিতেন। কোনো দিন পথ চলিতে-চলিতে গাজী সাহেব ওয়ালায়কুমুস সালাম বলিয়া থমকিয়া দাঁড়াইতেন এবং অদৃশ্য লোকের সাথে হাল-পুর্সি করিতেন। কথা শেষ করিয়া আসোলামু আলায়কুম বলিয়া আবার পথ চলিতে শুরু করিতেন। তা না করা পর্যন্ত সঙ্গী-সাথিরা কেউ কথা বলিতে পারিতেন না। আবার কোনো দিন সঙ্গী-সাথিদেরেও জিন দেখাইতেন। পথ চলিতে চলিতে হঠাৎ একটা বড় বটগাছতলায় দাঁড়াইয়া পড়িতেন। সঙ্গীদেরে বলিতেন, তোমরা যদি জিন দেখিতে চাও তবে এক-একজন গাছের একটি করিয়া পাতা একটানে ছিঁড়িয়া আনো। সকলে এক-একটা পাতা হাতে গাজী সাহেবের সামনে দাঁড়াইতেন। তিনি এক-এক করিয়া সকলের পাতায় শাহাদত আঙুল দিয়া কী যেন লিখিতেন ও ফুঁ দিতেন। যার তার পাতা যার তার হাতে ফিরাইয়া দিয়া বলিতেন, ‘এক ধ্যানে পাতার দিকে চাহিয়া থাকো, মনে মনে সোবহানাল্লাহ পড়িতে থাকো। সাবধান, আমার হুকুম না পাওয়া পর্যন্ত চোখ তুলিয়ো না বা অন্য দিকে নজর ফিরাইয়ো না।’ সকলে তা-ই করিতেন। কী তাজ্জব। সকলে দেখিতেন বিরাট ধুমধাম ও শান-শওকতের সাথে একটা নবাব-জমিদারের বিয়ার মিছিল যাইতেছে। সকলে অবাক বিস্ময়ে ঐ মিছিল দেখিতেছেন। অমন সময় গাজী সাহেব বলিয়া উঠেন, “তোমরা চোখ তোলো। সকলে দেখিলেন, চারিদিকে ফাঁকা। যে যেখানে দাঁড়াইয়া ছিলেন, সেখানেই দাঁড়াইয়া আছেন।
এসব কাহিনীর নির্ভরযোগ্য কোনো সাক্ষী পাওয়া যাইত না। যাকে আমরা জীবনে মিথ্যা বলিতে দেখি নাই, সেই দাদাজী আরমান উল্লা ফরাযী কখনো তার বড় ভাইয়ের এইসব মাযেজার সাক্ষ্য দিতেন না। দাদাজীর সত্যবাদিতারও আমি খুব বড় সাক্ষী নই। কারণ আমার বয়স যখন মাত্র ষোল বছর, সেই ১৯১৩ সালেই দাদাজী এন্তেকাল করেন। কিন্তু তার সমবয়সীরাও বলিতেন, দাদাজীকে মিথ্যা কথা বলিতে তারাও দেখেন নাই। দাদাজী খুব দৃঢ়তার সাথেই এই বলিয়া বড়াই করিতেন, ‘আমি জীবনে কোর্টে সাক্ষ্য দেই নাই। আমার ন পুস্তের মধ্যে কেউ দিয়াছেন বলিয়াও শুনি নাই। তারা সাক্ষ্য দিতেন না মানে মামলার কোনো পক্ষই তাঁদেরে সাক্ষী মানিত না। দাদাজী বলিতেন, কথাটা সত্যও, যে মামলার পক্ষেরা কেউ সত্য কথা বলিবার জন্য সাক্ষী মানে না। যার-তার পক্ষে কথা বলিবার জন্যই মানে। যা হোক, আমার দাদাজী গাজী সাহেবের উপরিউক্ত মাযেজার একটাও সাক্ষী ছিলেন না। অন্য লোকের মুখে শুনিয়া দাদাজীকে জেরা করিলে তিনি বলিতেন, তিনি নিজে ও সব কিছু দেখেন নাই। বড় ভাইয়ের বুযুৰ্গির কোনো হানি না হয়, সে উদ্দেশ্যেই বোধ হয় বলিতেন, ‘আমি মিয়া ভাইর সাথে খুব কমই বেড়াইতে বাহির হইতাম।’
কিন্তু সাক্ষীদের সকলেই কমবেশি আলেম ছিলেন। প্রতিবেশী বুড়া মুরুব্বিদেরও অবিশ্বাস করিবার কোনো কারণ ছিল না। একমাত্র উক্ত শাহ রমজান আলী ফকির ছাড়া আর কেউই পীরগিরি ব্যবসাও করিতেন না। রমজান আলী শাহ ফকির সাহেব শুধু পীরগিরি ব্যবসাই করিতেন না; তিনি নিজেও জিন-পরি পালেন বলিয়া দাবি করিতেন। তিনি আমাদের বাড়িতে প্রায়ই মেহমান হইতেন, আমাদের কাছে বড়াই করিতেন, তার অধীনে এমন শক্তিশালী জিন আছে, যে তার হুকুমে পুকুরপাড়ের ঐ কাঁঠালগাছটা উখড়াইয়া ছুড়িয়া ঐ দূরে ফেলিয়া দিতে পারে। কিন্তু আমাদের হাজার আবদার অনুরোধেও তিনি কোনো দিন তাঁর জিন দিয়া কাঁঠালগাছ উখড়ান নাই।