.
৭. গাজী সাহেবের তবলিগ
অল্প দিনেই গাজী সাহেবের অনেক শিষ্য-শাগরেদ জুটিয়া গেল। এদেরে সঙ্গে লইয়া তিনি শরা জারিতে লাগিয়া গেলেন। তিনি জেহাদে যাইবার সময় শরা জারি সম্বন্ধে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখিয়া গিয়াছিলেন, তার কিছুই তিনি দেখিতেছেন না বলিয়া আফসোস করিতেন। কারী ময়েযুদ্দিন ছাড়া গাজী সাহেবের আরো দুইজন নিত্য সহচরের সঙ্গে আলাপ করিবার সৌভাগ্য আমার হইয়াছিল। এঁদের মধ্যে একজন আমার দূর সম্পর্কের নানা মুনশী ওয়ালী মাহমুদ মির্যা। আরেকজন আমাদের নিকট প্রতিবেশী ইব্রাহিম শেখ। মির্যা সাহেব গাজী সাহেবের তালবিলিম’ হিসাবে তার সাথে-সাথে ঘুরিতেন। তিনি মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের বাড়ির মসজিদের ইমাম ছিলেন। আর ইব্রাহিম শেখ ছিলেন গাজী সাহেবের অতিশয় প্রিয়পাত্র দেহরক্ষী। কিশোর ইব্রাহিম শেখ পুরা ছয় ফুট উঁচা বিশালকায় জোয়ান ছিলেন। গায়ে ছিল তাঁর পাঁচজনের শক্তি। আমাদের আমলে এই ইব্রাহিম শেখ দস্তুরমত বুড়া হইয়া গিয়াছেন। তবু তার বিশাল কায়া দেখিলে ও তাঁর বুলন্দ আওয়াজ শুনিলে ভয় হইত। গ্রামে কথা চলতি ছিল যে, ইব্রাহিম শেখকে দেখিলে ভূতেও ডরায়। এই ইব্রাহিম শেখের মুখে আমরা গাজী সাহেবের প্রাত্যহিক জীবনের অনেক চাক্ষুষ বিবরণী শুনিয়াছি। আমার দাদাজী, কারী ময়েযুদ্দিন, নানা ওয়ালী মাহমুদ মির্যা এবং ইব্রাহিম শেখের নিকট যা-যা শুনিয়াছি তার সংক্ষিপ্তসার এই :
গাজী সাহেব তহবন্দ নিয়া বেশি মাথা ঘামাইতেন না। কারণ নিজে তিনি পাজামা পরিয়া থাকিতেন। আর তত দিনে লোকেরার তহবন্দ-বিদ্বেষ অনেকটা কমিয়া গিয়াছে। অনেকেই জুম্মার বা ঈদের দিনে বাড়ি হইতে তহবন্দ পরিয়া রওনা হন। অবশ্য কিছু লোক কাছা দিয়াই মসজিদে বা ঈদের জামাতে আসিত এবং এখানে অযু করার আগে বা পরে কাছা খুলিয়া তহবন্দ পরিত। তেমন লোক আজও আছে। আজকাল যেমন টুপি-ছাড়া নামাজিরা জমাতে শামিল হইয়া কাতারে দাঁড়াইয়া পকেট হইতে কিশতি টুপি বা রুমাল বাহির করিয়া তাহাই মাথায় চড়ান, তেমনি তৎকালে অনেক লোক কাতারে দাঁড়াইবার পর কাছা খুলিয়া মুছুল্লি হইতেন।
যা হোক, গাজী সাহেব তহবন্দ ফেলিয়া গান-বাজনার উপরই হামলা চালাইলেন বেশি। আছরউদ্দিন ফরাযী সাহেবের আমলে শরা কবুলের শর্ত ছিল চারটি : (১) পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িতে হইবে, (২) রোযায় চোঙা ব্যবহার চলিবে না (৩) কাছা দিয়া কাপড় পরিতে পারিবে না, (৪) গান বাজনা বন্ধ করিতে হইবে।
এসবের মধ্যে গাজী সাহেব গান-বাজনা বন্ধের দিকেই অধিকতর দৃষ্টি দিলেন। ওয়াযের মহফিলে ছাড়া বাড়ি-বাড়ি ঘুরিয়াও তিনি গান-বাজনার কুফল বর্ণনা করিতেন। কিছুকাল প্রচারের পরেও যারা গান-বাজনা ছাড়িল না, তাদের উপর গাজী সাহেব বল প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। যারা ঢোল ডগর বিক্রয় করিয়া ফেলিতে দেরি করিল, গাজী সাহেব লাঠি দিয়া পিটাইয়া তাদের ঢোল-ডগর ভাঙ্গিয়া গুড়া-গুঁড়া করিয়া ফেলিতে লাগিলেন। গাজী সাহেবের ভয়ে যারা দিনের বেলায় বা নিজ বাড়িতে গান-বাজনা করিত না, তারা গভীর রাতে মাঠে-জঙ্গলে বসিয়া গান-বাজনা করিতে লাগিল। এই ধরনের লোকের বাদ্যযন্ত্র তালাশ করিতে গিয়া গাজী সাহেব এদের বাড়িতে ঢুকিয়া পড়িতেন। এ কাজ করিতে গিয়া গাজী সাহেব দু’একবার শারীরিক বিপদের সামনে পড়িয়াছেন। সন্দেহজনক লোকের বাড়িতে গিয়া প্রথমে পুরুষ মুরুব্বিদেরে এবং অন্দরে ঢুকিয়া মেয়েদেরে বাদ্যযন্ত্রের কথা পুছ করিতেন। পরিবারের অপরাধীকে ধরাইয়া দিতে স্বভাবতই কেউ রাজি ছিল না। বরঞ্চ ঐ পরিবারের একাধিক লোকই গান-বাজনা করিয়া থাকে। কাজেই। সকলেই একবাক্যে মিছা কথা বলিত। ঐ বাড়িতে বাদ্যযন্ত্র থাকার কথা মুখ পুঁছিয়া না করিত। কিন্তু গাজী সাহেব ত আর নিজের কানকে অবিশ্বাস করিতে পারেন না। তিনি গভীর রাত্রে ঐ বাড়িতেই বাজনার আওয়াজ নিজ কানে শুনিয়াছেন যে। কাজেই গাজী সাহেব বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া ঘরে-ঘরে আনাচে-কানাচে উগারের উপর-নিচে ও ডুলি-ডালায় বাদ্যযন্ত্রের তালাশ করিতেন। এক-আধটা বাদ্যযন্ত্র পাওয়া গেলে আর রক্ষা ছিল না। সঙ্গীগণকে ঐ বাদ্যযন্ত্র ভাঙ্গিবার আদেশ দিয়া গাজী সাহেব বাড়ির লোকদের হেদায়েত করিতে লাগিতেন। ভাঙার কাজে কোনোরূপ শৈথিল্য, বিলম্ব অথবা অসম্পূর্ণতা দেখিলে গাজী সাহেব নিজের হাতের লাঠি দিয়া বাদ্যযন্ত্র ভাঙ্গিতে শুরু করিতেন। বাদ্যযন্ত্রকে বাদকেরা যে প্রাণের চেয়েও ভালবাসে, সে জ্ঞান। গাজী সাহেবের ছিল না। নিজের প্রাণের চেয়ে প্রিয় বাদ্যযন্ত্র ভাঙ্গিতে দেখিয়া দু’একবার দু’এক তরুণ যুবক আত্ম-সম্বরণ করিতে পারে নাই। বেহুঁশ হইয়া গাজী সাহেবকে তারা আক্রমণ করিতে আসিয়াছে। উপস্থিত লোকজন গাজী সাহেবকে রক্ষা করিয়াছে। নইলে দু-একবার তিনি নিশ্চয়ই আহত হইতেন।
.
৮. গাজী সাহেবের জনপ্রিয়তা
শরা-শরিয়ত সম্বন্ধে গাজী সাহেব এমন কড়া, সুতরাং আন-পপুলার হওয়া সত্ত্বেও অন্য দুই-একটি কারণে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি গ্রামের যুবকদেরে কুস্তি-কসরত ও লাঠি-তলওয়ার খেলা শিখাইতেন। লাঠি ও তলওয়ার খেলার একটা উস্তাদির নমুনা ছিল এইরূপ :