.
৬. গাজী সাহেবের প্রত্যাবর্তন
দাদাজীর বয়স তখন চল্লিশের কাছাকাছি। সেটা গদর বা সিপাহী বিদ্রোহের মুদ্দত। ঐ সময়ে একদিন গ্রামের উত্তরপাড়ার কয়েকজন তোক একটি কাবুলি পোশাক পরা লোককে আমাদের বাড়িতে নিয়া আসেন। উনিই দাদাজীর বড় ভাই আশেক উল্লা সাহেব। প্রায় ত্রিশ বৎসর আগে তিনি দেশ ছাড়িয়াছিলেন। এই ত্রিশ বৎসরে তিনি কোনো প্রকার চিঠিপত্র বা খবর-বার্তা দেন নাই। গিয়াছিলেন সবেমাত্র দাড়ি-গোঁফ-গজানো তরুণ। আসিয়াছেন কাঁচা-পাকা চাপ দাড়িওয়ালা আধবুড়া মানুষ। কাজেই বড় ভাইকে চিনা দাদাজীর পক্ষে কঠিন হইয়াছিল। সঙ্গে আসা লোকজনেরা যা বলিয়াছিলেন তা এই : ঐ কাবুলি মার্কা লোকটাকে তাঁরা তাঁদের বাড়ির আশপাশে ঘোরাফেরা করিতে দেখেন। কৌতূহলী হইয়া তাঁরা কাছে যাইয়া পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন। লোকটি দুর্বোধ্য ভাষায় যা বলেন, সেসব কথার মধ্যে আছরউদ্দিন, আরমান উল্লা, আশেক উল্লা এই তিনটি নাম তাঁরা বুঝিতে পারেন। তাতেই পাড়ার মুরুব্বিদের মনে পড়ে আছরউদ্দিন ফরাযীর জেহাদে যাওয়া ছেলের কথা। আছরউদ্দিন ফরাযীর বড় ছেলে জেহাদে গিয়াছেন, এ কথা এই অঞ্চলে বয়োজ্যেষ্ঠ সকলেরই জানা ছিল। তিনি যখন জেহাদে যান, তখন আছরউদ্দিন ফরাযী সাহেবের বাড়ি উত্তরপাড়া মৌযাতেই ছিল। তারপর তিনি দক্ষিণ দিকে প্রায় আধমাইল দূরে অন্য মৌযায় আসিয়া বাড়ি করেন। এটাই আমাদের বর্তমান বাড়ি। আশেক উল্লা সাহেব স্বভাবতই তা জানিতেন না। সুদূর অতীত বাল্যের স্মৃতির বলেই তিনি সাবেক পৈতৃক ভিটাতে নিজেদের বাড়ি তালাশ করিতেছিলেন।
ইতিমধ্যে আছরউদ্দিন ফরাযী নিজে, তাঁর স্ত্রী এবং দ্বিতীয় পুত্র আরজ উল্লা এন্তেকাল করিয়াছেন। আরজ উল্লা বিবাহের আগেই মারা যান। কাজেই এই সময় ফরাযী বাড়িতে কেবল আমার দাদা আরমান উল্লা, তার স্ত্রী বিবি মহরম, আয়েযুননেছা নামে আট-দশ বছরের এক মেয়ে এবং আবদুর রহিম নামে দুই-এক বছরের একটি ছেলে। বহুদিন পরে পাওয়া বড় ভাইকে আমার দাদাজী আরমান উল্লা অতি আদরে গ্রহণ করিলেন। প্রতিবেশীদের সহায়তায় বাড়ির ভিতরে তার থাকিবার ঘর করিয়া দিলেন।
আশেক উল্লা সাহেব প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ বছর বিদেশ থাকিয়া মাতৃভাষা একরকম ভুলিয়াই গিয়াছিলেন। শোনা যায়, তিনি আরবি-ফারসি-উর্দুতে খুব ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু দাদাজীর নিকট হইতে এ বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য খবর সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। দাদাজী নিজে লেখাপড়া জানিতেন না। আমাদের এক আত্মীয় ছিলেন কারী ময়েযুদ্দিন সাহেব। তিনি গাজী সাহেবের সাথে অনেক দিন কাটাইয়াছিলেন। তাঁর মুখে শুনিয়াছি, তিনি গাজী সাহেবের নিত্য সহচর ছিলেন। ধানীখোলা গ্রামের মৈশাটিকি মৌযার মুনশী আজিম উদ্দিন সাহেবও একজন আলেম ছিলেন। তিনিও গাজী সাহেবের অন্যতম সহচর ছিলেন। পারতপক্ষে কারী সাহেব ও মুনশী সাহেবকে সঙ্গে না লইয়া গাজী সাহেব কোথাও সভা করিতে বা বেড়াইতে যাইতেন না। এই কারী সাহেব আমাদের কাছে বলিয়াছেন, গাজী সাহেব আরবি-ফারসি-হিন্দিতে খুব লিয়াকত রাখিতেন। হিন্দি মানে এখানে উর্দু। বর্তমানে আমরা যাকে উর্দু বলি, আমাদের ছেলেবেলায় তাকেই হিন্দি বলা হইত। আমি যখন ছেলেবেলা আমাদের বাড়ির মাদ্রাসায় চাচাজীর কাছে এবং পরে অন্যান্য মৌলবীর কাছে রাহে-নাজাত, তিফতাহুল জান্নাত, ফেকায়ে মোহাম্মদী, দুরাতুন নাসেহীন ইত্যাদি উর্দু কেতাব পড়িতাম, তখনও ঐসব কেতাবকে উস্তাদজিরা হিন্দি কিতাব বলিতেন। মাদ্রাসা ছাড়িয়া যখন মাইনর স্কুলে ইংরাজি পড়া শুরু করি, তখনও আমাদের ক্লাসে অপশনাল বিষয় হিসাবে একটি পুস্তিকা পাঠ্য করা হয়। তার নাম ছিল উর্দু কি পহেলি কিতাব। হিন্দিকে উর্দু বলিতে এই প্রথম শুনি। পুস্তকে উর্দু লেখা থাকিলেও মাস্টার ছাত্র সবাই ওটাকে হিন্দি ক্লাস বলিতাম।
যা হোক, কারী ময়েযুদ্দিন সাহেবের কাছে শুনিয়াছি যে গাজী সাহেব ফারসি ও হিন্দিতে পশ্চিমে চিঠিপত্র লিখিতেন। সেসব চিঠিপত্র অবশ্যই ডাকে যাওয়া আসা করিত না। লোক মারফত যাওয়া-আসা করিত। মোজাহিদদের এ অঞ্চলে যাতায়াত ছিল। প্রধানত গাজী সাহেবের সাথে সলা-পরামর্শ করিতেই তাঁরা আসিতেন। এঁদের অধিকাংশই পাটনা, কলিকাতা, মালদহ, এমনকি লাহোর, লাখনৌ হইতেও আসিতেন। কথাবার্তা, দেখা-সাক্ষাৎ খুব গোপনেই হইত। কারী সাহেব ও দাদাজীর মতে ঐ সময় কলিকাতা, মালদহ ও রাজশাহীতে কোনো কোনো মোজাহিদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা চলিতেছিল। অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরওয়ানাও ছিল কি না তা দাদাজী বা কারী সাহেব বলিতে পারিতেন না। তবে কারী সাহেব বলিতেন, গাজী সাহেবের মোজাহেদি নাম ছিল মওলানা শিহাবুদ্দিন। ঐ নামেই গাজী সাহেবের নামে পত্রাদি আসিত। গাজী সাহেবের মত সব মোজাহেদিদেরই একটি করিয়া ফী নাম (ছদ্মনাম) ছিল। তথাপি গাজী সাহেব কাউকে কিছু না বলিয়া হঠাৎ গায়েব হইয়া যাইতেন। সপ্তাহ, মাস এমনকি কখনো-কখনো দুমাস, ছমাস পরে আবার বাড়ি ফিরিতেন। এমন চলিয়াছিল দশ-বার বছর। জীবনের শেষ দিনতক গাজী সাহেবকে সপ্তাহে একবার থানায় হাজিরা দিতে হইত। আমাদের থানা ছিল তখন কোতোয়ালি। তখনও ত্রিশাল থানা হয় নাই। গাজী সাহেব দশ মাইল রাস্তা হাঁটিয়া কোতোয়ালি হাজিরা দিতে যাইতেন। ভাষার জন্য প্রথম দিকে কিছুদিন তাঁর অসুবিধা হইলেও তা থাকে নাই। আঠার বছরের কওয়া মাতৃভাষা মানুষ ত্রিশ বছরেও ভুলিয়া যাইতে পারে না। অতি অল্প দিনেই গাজী সাহেব মাতৃভাষায় দখল পুনরায় ফিরিয়া পাইলেন। তখন হইতেই তিনি লোকজনের সাথে পুনরায় মিলা-মিশা করিতে লাগিলেন।