ফরাযীদের জন্য এই তহবন্দ পরা বাধ্যতামূলক ছিল। হান্টার সাহেব এ সম্বন্ধে তাঁর বইয়ের ১৯৫ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন :
Farazis can be distinguished by their dresses. They do not wear dhuti. He dresses differently from other Musalmans and wraps his dhuti or waiste cloth round his body without crossing it between his legs.
অর্থ : ফরাযীদের তাদের পোপাশাক দেখিয়াই চিনা যায়। অন্যান্য মুসলমানদের থনে তারা ভিন্ন রকমের পোশাক পরে। তারা তাদের ধুতি বা তহবন্দ শরীরের চারিদিকে পঁাচাইয়া পরে, দুই পায়ের ভিতর দিয়া কাপড় পার করায় না অর্থাৎ কাছা দেয় না। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আজকাল যেমন শুধু পাড়ওয়ালা কাপড়কেই ধুতি বলা হয়, আগের কালের রেওয়াজ তা ছিল। না। কাছা দিয়া কাপড় পরাকেই তখন ধুতি পরা বলা হইত। আজকাল হিন্দুরা ধুতি পরাকেই কাপড় পরা’ বলিয়া থাকেন। তাদের বিচারে প্যান্ট পাজামা পরা আর কাপড় পরা আলাদা ব্যাপার।
আছরউদ্দিন ফরাযী সাহেব ও তার সঙ্গীরা নিজেদের মধ্যে তহবন্দ পরা চালু করিলেও প্রতিবেশীদের মধ্যে তা চালু করিতে পারেন নাই। আছরউদ্দিন সাহেব শুধু মুখে-মুখেই এ বিষয়ে প্রচার করিতেন। কাউকে যবরদস্তি করিতেন না। দাদাজীর কাছে শুনিয়াছি তাঁর বাবা আছরউদ্দিন ফরাযী তার নিতান্ত বাধ্য অনুগত এক লোককে বলিয়া-কহিয়া তহবন্দ পরিতে রাজি করিয়াছিলেন। একদিন তহবন্দ পরিয়াই সে তোক তহবন্দ ফেলিয়া আবার ধুতি পরিয়া আছরউদ্দিন সাহেবের কাছে আসেন এবং মাফ চান। ফরাযী সাহেব তাঁকে তম্বি করিলে জবাবে সে লোক কাঁচুমাচু হইয়া বলেন, তহবন্দ পরিয়া রাস্তা চলিতে আমার ভারি শরম লাগে। কারণ কাছা না দিলে মনে হয় আমি কাপড়ের নিচে ন্যাংটা রহিয়াছি।’ ফরাযী সাহেব হাসিয়া তহবন্দ পরা হইতে তাকে রেহাই দেন।
আছরউদ্দিন সাহেব তহবন্দ পরার তাকিদ করিলে সাধারণত লোকেরা এই ধরনের জবাব দিত, ‘আমরা শরা কবুল করিয়াছি বটে, কিন্তু ফরাযী হই নাই। তহবন্দ পরা শুধু ফরাযীদের কর্তব্য। সব মুসলমানের কর্তব্য নয়। অর্থাৎ জনসাধারণের রায় এই ছিল যে গোড়াতে যে চারজন মওলানা এনায়েত আলী সাহেবের হাতে শরা কবুল করিয়াছিলেন, তাঁরাই ফরাযী এবং তহবন্দ পরা শুধু তাদেরই জন্য বাধ্যতামূলক। যারা পরে ঐ ফরাযীদের হাতে শরা কবুল করিয়াছেন, তাঁরা ফরাযীও নন, তহবন্দ পরাও তাঁদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। শুধু তহবন্দ পরার মত শরমের কাজ এবং কারো-কারো মতে শাস্তি হইতে রেহাই পাইবার আশাতেই জনসাধারণ ফরাযী শব্দের এরূপ সংকীর্ণ ব্যাখ্যা করিয়াছিল, তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু কালক্রমে এটাই চালু হইয়া গিয়াছিল। এতদঞ্চলে শুধু এই চার পরিবারই ফরাযী বলিয়া পরিচিত। আর কোনো পরিবার এই পারিবারিক পদবি লাভ করে নাই। কোনো বেনামাজি বাবু-কেসেমের লোক হঠাৎ নামাজ ধরিলে, দাড়ি রাখিলে এবং সাদা লুঙ্গি ও লম্বা কোর্তা ধরিলে আজ পর্যন্ত লোকেরা বলাবলি করে, ‘লোকটা একেবারে ফরাযী হইয়া গিয়াছে।’ এতে মনে হয় ফরাযীরা ধর্মে কর্মে চালে-চলনে এবং পোশাক-পাতিতে গোঁড়া মুসলমান, এ ধারণা তকালেও ছিল।
আছরউদ্দিন ফরাযী ও তাঁর সঙ্গীরা তহবন্দ পরার জন্য লোকজনকে পীড়াপীড়ি না করিলেও লোকজনেরা কিন্তু ফরাযী সাহেবদের অত সহজে ছাড়িয়া দেয় নাই। শরমের খাতিরে লোকেরা নিজেরা ত তহবন্দ পরিতই না, অপরে তহবন্দ পরিয়া রাস্তাঘাটে চলাফেরা করিলেও বোধ হয় তাদের শরম লাগিত। কাজেই ফরাযীরাও যাতে তহবন্দ পরিয়া রাস্তাঘাটে চলাফেরা না করেন, তার চেষ্টা তারা সর্বদাই করিত। তহবন্দ পরাকে তারা নানা প্রকার মুখরোচক, অনেক সময় অশ্লীল রসিকতার দ্বারা আক্রমণ করিত। তহবন্দকে তারা কাপড় না বলিয়া ‘চারা গাছের খাঁচা’, ‘বালিশের ওসার’ ইত্যাদি কবিত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করিত। ফরাযীরা কাপড়ের নিচে বিলাইর বাচ্চা পোষে’, শুনাইয়া-শুনাইয়া এই ধরনের আশালীন রসিকতাও করিত। অপেক্ষাকৃত মুখপোড়া লোকেরা বলাবলি করিত, ‘অঙ্গবিশেষ বড় হইয়া যাওয়াতেই ফরাযীরা কাছা দিতে পারে না।’
এসব ত গেল মৌখিক যুলুম। এর উপর ছিল শারীরিক যুলুম। এই যুলুমের সুপ্রচলিত একটা ট্যাকটিকস ছিল এইরূপ : খুব লম্বা সরু বাঁশের আগায় কলকাঠি বাধিয়া লোকেরা রাস্তার ধারের ঝোপে-জঙ্গলে বসিয়া থাকিত। কোনো তহবন্দ-পরা ফরাযী ঐ রাস্তায় চলিবার সময় পিছন হইতে ঐ কলকাঠি তহবন্দের নিচের পারে আটকাইয়া হেঁচকা টান মারা হইত। তাতে ফরাযী সাহেব একেবারে উলঙ্গ হইয়া পরিতেন। দুষ্কৃতকারীরা অট্টহাস্য করিতে করিতে জঙ্গলে লুকাইয়া পড়িত। এসব কথা গ্রামের মাতব্বরদের কানে গেলে তারা বলিতেন যে দুষ্ট ছেলেরাই এসব অন্যায় কাজ করিয়া থাকে, তাদেরে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা হইবে। কিন্তু কোনো দুষ্ট ছেলেই শাস্তি পাইত না। কাজেই বুঝা যাইত, তলে তলে মুরুব্বিদের সমর্থনেই দুষ্ট ছেলেরা এসব দুষ্টামি করিতেছে। স্বয়ং আছরউদ্দিন ফরাযী সাহেবকেও অনেক সময় এসব যুলুমের শিকার হইতে হইয়াছে। কাজেই ফরাযীরা সাবধানতা হিসাবে কোমরে গিরো দিয়া তহবন্দ পরিতে লাগিলেন। গিরো দিয়া তহবন্দ পরায় অতঃপর উলঙ্গ হইয়া পড়ার লজ্জা হইতে তাঁরা রক্ষা পাইলেন বটে কিন্তু কলকাঠির টানে তাদের তহবন্দ ফাঁড়িয়া যাইতে লাগিল। এতেই বোধ হয় দুষ্কৃতকারীদের প্রাণে দয়া হইল। কারণ ফরাযীদের লজ্জা দিয়া তহবন্দ ছাড়ানোই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। তহবন্দ ছিঁড়িয়া তাঁদের লোকসান করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না।