মাদারীর পূজা ও মেলার সুস্পষ্ট চিত্র আমাদের চোখের সামনে তুলিয়া ধরিবার জন্য দাদাজী ওটাকে হিন্দুদের চড়কপূজার সহিত তুলনা করিতেন। তত্ত্বালে আমাদের বাড়ির অদূরেই হিন্দুপাড়া ছিল। প্রতিবৎসর চৈত্র মাসে সংক্রান্তির দিনে তাদের চড়কপূজা হইত। গ্রামের বাজার-সংলগ্ন খোলা মাঠে, তদভাবে চাষের জমিতে পূজা হইত ও মেলা বসিত। খুব লম্বা ও বেশ মোটা। একটা শাল-গজারি কাঠ খাড়া করিয়া গাড়া হইত। তার আগায় থাকিত একটা আড়ি কাঠ। আড়ি কাঠের দুই মাথা হইতে দুইটা মযবুত রশি মাটিতক ঝুলিয়া থাকিত। আড়ি কাঠটা খাড়া কাঠের সঙ্গে এমন কেড়কি কৌশলে লাগানো হইত যে আড়ি কাঠের রশি ধরিয়া খাড়া কাঠের চারপাশে দৌড়াইলে আড়ি কাঠও ভনভন করিয়া ঘুরিত। আমরা যখন দেখিয়াছি, তখন আড়ি কাঠের দুই পাশের রশি ধরিয়া লোকেরা মাটির উপরেই দৌড়াদৌড়ি করিত। কিন্তু আমরা বুড়াদের কাছে শুনিতাম যে আগেরকালে দুইজন লোক ঐ দুই রশি ধরিয়া শূন্যে ঝুলিয়া ঝুলিয়া চড়কগাছের চারিদিকে ঘুরিত। কিন্তু নিজ চক্ষে ওটা আমরা কোথাও কোনো দিন দেখি নাই। যা হোক ঐ চড়কপূজায় পূজা-পালি ছাড়া একটা মেলা বসিত। এই মেলায় চিনি-বাতাসা, খই-মুড়ি চিড়া, কদমা-জিলাপি-মিসরি, বাঁশি ও খেলনা ইত্যাদি ছেলেমেয়ের প্রিয় জিনিস পাওয়া যাইত। এছাড়া দাও, কুড়াল, কোদাল, লাঙলের ঈষ ও ফাল ইত্যাদি কৃষকদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যাইত। মোট কথা, এই বার্ষিক মেলা সকল দিক দিয়া জাতি-ধর্মনির্বিশেষে ছেলে-বুড়া-পুরুষ-নারী সকলের জন্যই বহু আকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছিল। দাদাজী আমাদেরে বুঝাইতেন মাদারীর মেলা অবিকল এই রকম ছিল। তিনি বলিতেন, ‘মাদার পূজা’ছিল বেশরা। মুসলমানদের চড়কপূজা। তার বয়স যখন সাত-আট বছর, তখন হইতেই আমাদের বাড়িতে ঐ ‘মাদার পূজা’ও মেলা বসার প্রথা বন্ধ হয়। তিনি বলিতেন যে, ঐ মেলা বন্ধ হওয়ায় প্রথম-প্রথম স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান জনসাধারণ অসন্তুষ্ট হইয়াছিল। তাঁর নিজেরও খুবই খারাপ লাগিয়াছিল, তাও তিনি স্বীকার করিতেন।
.
৪. সামাজিক অনাচার
শরা জারির আগে আমাদের অঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে যেসব আচার ব্যবহার প্রচলিত ছিল, সে সম্বন্ধে দাদাজী ও তার সমবয়সীদের মুখে এইরূপ শুনিয়াছি :
তৎকালে নামাজ-রোযা খুব চালু ছিল না। ওয়াকতিয়া ও জুম্মার নামাজ বড় কেউ পড়িত না। এ অঞ্চলে কোনো মসজিদ বা জুম্মার ঘর ছিল না। বছরে দুইবার ঈদের জমাত হইত বটে, কিন্তু তাতে বড়রাই শামিল হইত। কাজেই জমাতে খুব অল্প লোক হইত। ঈদের মাঠে লোক না হইলেও বাড়ি বাড়ি আমোদ-সামুদ হইত খুব। সাধ্যমত নূতন কাপড়-চোপড় পরিয়া লোকেরা বেদম গান-বাজনা করিত। সারা রাত ঢোলের আওয়াজ পাওয়া যাইত। প্রায়ই বাড়ি-বাড়ি ঢোল-ডগর দেখা যাইত। বা ঈদের গরু কোরবানি কেউ করিত না। কারণ জমিদারদের তরফ হইতে উহা কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ ছিল। খাশি-বকরি কোরবানি করা চলিত। লোকেরা করিতও তা প্রচুর।
তরুণদের ত কথাই নাই, বয়স্কদেরও সকলে রোযা রাখিত না। যারা রোযা রাখিত, তারাও দিনের বেলায় পানি ও তামাক খাইত। শুধু ভাত খাওয়া হইতে বিরত থাকিত। পানি ও তামাক খাওয়াতে রোযা নষ্ট হইত না, এই বিশ্বাস তাদের ছিল। কারণ পানি তামাক খাইবার সময় তারা রোযাটা একটা চোঙার মধ্যে ভরিয়া রাখিত। কায়দাটা ছিল এই : একদিকে গিরোওয়ালা মোটা বরাক বাশের দুই-একটা চোঙা সব গৃহস্থের বাড়িতেই আজও আছে, আগেও থাকিত। তাতে সারা বছর পুরুষেরা তামাক রাখে। মেয়েরা রাখে লবণ, সজ, গরমমসলা, লাউ-কুমড়ার বিচি ইত্যাদি। আগের কালে এ রকম চোঙার অতিরিক্ত দুই-একটা বাড়ি-বাড়িই থাকিত। রোযার মাসে মাঠে যাইবার সময় এই রকম এক-একটা চোঙা রোযাদাররা সঙ্গে রাখিত। পানি-তামাকের শখ হইলে এই চোঙার খোলা মুখে মুখ লাগাইয়া খুব জোরে দম ছাড়া হইত। মুখ তোলার সঙ্গে সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি গামছা, নেকড়া বা পাটের টিপলা দিয়া চোঙার মুখ কষিয়া বন্ধ করা হইত, যাতে বাতাস বাহির হইয়া না আসে। তারপর আবশ্যকমত পানি-তামাক খাইয়া চোঙাটা আবার মুখের কাছে ধরা হইত। খুব ক্ষিপ্রহস্তে চোঙার ঢিপলাটা খুলিয়া মুখ লাগাইয়া মুখে চুষিয়া চোঙার বন্ধ রোযা মুখে আনা হইত এবং সেঁক গিলিয়া একেবারে পেটের মধ্যে ফেলিয়া দেওয়া হইত। খুব ধার্মিক ভাল মানুষ দু’একজন এমন করাটা পছন্দ করিতেন না বটে, কিন্তু সাধারণভাবে এটাই চালু ছিল।
আছরউদ্দিন ফরাযী ও তার তিনজন সাথি শরা কবুল করার পরেও জনসাধারণের মধ্যে বহুকাল যাবৎ ঐ আচার প্রচলিত ছিল। ঐ চারি বন্ধুর প্রচারে ক্রমে ক্রমে আরো অনেক লোক শরা কবুল করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু সারা গ্রামবাসীর তুলনায় তাঁরা ছিলেন নগণ্য মাইনরিটি।
.
৫. ধুতি বনাম তহবন্দ
তৎকালে তহবন্দ পরা খুবই শরমের ব্যাপার ছিল। সবাই কাছা দিয়া কাপড় পরিত। শরা জারির আগে ত বটেই, শরা জারির পরেও এটা চালু ছিল। ঈদের জমাতেও লোকেরা কাছা দিয়া ধুতি পরিয়াই যাইত। নামাজের সময় কাছা খুলিতেই হইত। সে কাজটাও নামাজে দাঁড়াইবার আগে তক করিত না। প্রথম প্রথম নামাজের কাতারে বসিবার পর অন্যের আগোচরে চুপি চুপি কাছা খুলিয়া নামাজ শেষ করিয়া কাতার হইতে উঠিবার আগেই আবার কাছা দিয়া ফেলিত। শরম কাটিবার পর অবশ্য নামাজের কাতারে বসিবার আগে ত বটেই, অযু করিবার আগেই কাছা ভোলা চালু হইয়াছিল। পক্ষান্তরে শরা কবুল করিবার পর আছরউদ্দিন ফরাযী ও তাঁর সঙ্গীদের পরিবারের তরুণদের সকলে না হইলেও অন্তত বয়স্করা নামাজ বন্দেগির সময় ছাড়াও চব্বিশ ঘণ্টা তহবন্দ পরিয়া থাকিতেন। এটা নাকি তাঁদের পীরের হুকুম ছিল, শরা কবুলের অন্যতম শর্ত ছিল। সাদা লুঙ্গিকেই আগে তহবন্দ বলা হইত। দাদাজীর আমলে রঙিন লুঙ্গি কেউ দেখেন নাই। রঙিন লুঙ্গির প্রথম প্রচলন হয় বার্মা হইতে। লুঙ্গির প্রচলন হওয়ার আগে পর্যন্ত সকলেই তহবন্দ পরিত। সাড়ে চার হাত লম্বা মার্কিন (অধোলাই লংক্লথ) বা নয়ানসুখ (ধোলাই লংক্লথ) কাপড়ের দুই মাথা একত্র জুড়িয়া সিলাই করিলেই তহবন্দ হইত।