একেকদিক মুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা তখন আগাচ্ছে। জব্বাররা প্ল্যান করেছে এবার তারা ধীরে ধীরে ঈশ্বরগঞ্জের দিকে আগাবে। কীভাবে ঈশ্বরগঞ্জ ক্যাম্প আক্রমণ করবে তার পরিকল্পনা চলছে।
এসময় একদিন রুনু এসে হাজির ঢুফির বাজার ক্যাম্পে। উ™£ান্তের মতো চেহারা। আমাদের সেই রাজপুত্রের মতো রুনু আর নেই। মাথার চুল কাকের বাসার মতো, চোখ গর্তে ঢুকে গেছে, চেহারা ভাঙাচোরা। সুন্দর মুখটা ভরে গেছে দাড়িগোঁফে। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে গেছে।
আমি সেদিন জব্বারদের ক্যাম্পে।
রুনুকে দেখে হইচই পড়ে গেল ক্যাম্পে।
জব্বার বলল, কী রে রুনু, তুই আছিলি কই?
রুনু উদাস গলায় বলল, মিলিটারি ক্যাম্পে।
কী?
হ। আমি ধরা পইড়া গেছিলাম। বাবারে আর দাদারে মাইরা ফালানের পর আমরা সবাই পলাইতেছিলাম। বাড়ির সবাই পলাইতে পারছে আমি পারি নাই। আমি ধরা পইড়া গেছি।
জব্বার হলো কমান্ডার। সে কথা বলবার সময় অন্যকেউ কথা বলে না। তারপরও সাহস করে রুনুকে আমি জিজ্ঞাস করলাম, তোরে টর্চার করছে?
রুনু বলল, বহুত টর্চার করছে।
জব্বার বলল, কীভাবে টর্চার করছে?
যত রকমভাবে করা যায়। মারতে মারতে আমার হাড্ডিগুড্ডি ভাইঙ্গা দিছে। বহুত ম্যান্টাল টর্চার করছে। দেখস না আমার কথাবার্তার ঠিক নাই।
সত্যি রুনু কেমন যেন একটু অ্যাবনরমাল। রুনুর জন্য যে আমার কী খারাপ লাগলো।
জব্বার বলল, মিলিটারির হাত থেকে তুই বাঁইচা আইলি কেমনে?
জামিনে আইছি।
কে তোর জামিন হইছে?
হইছে একটা লোক, তোরা চিনবি না।
কেমনে সে তোর জামিন হইলো?
আর্মির লগে তার খুব খাতির। আমারে দেইখা তার মায়া লাগছে। আমি তার হাতেপায়ে ধইরা কইছি, আপনে আমার জামিন হন, পাঁচটা দিনের লেইগা আমারে ছাড়ান। আমি হিন্দুর পোলা, এক জবানের মানুষ। ঠিক পাঁচদিন পর আপনার কাছে ফিরত আসুম। এই পাঁচদিনে আমি আমার মা ভাইবোনরে খুুঁইজা বাইর করুম। খালি একটু জানতে চাই, তারা বাঁইচা আছে কি না।
আমি বললাম, লোকটা তোরে বিশ্বাস করলো? রাজি হইল তোর কথায়?
হ হইল।
জব্বার বলল, তুই এইসব বলার পর মিলিটারিগ হাত থিকা তোরে ছাড়াইলো কেমনে?
মিলিটারিগ গিয়া সে কইলো, ও খুব ভালো পোলা, আমি ওর জামিন হইলাম। ও পাঁচদিন পর ফিরত আইবো। না আইলে আমারে গুল্লি কইরা মাইরেন।
এই রকম ঘটনা কী ঘটে?
নিজের জীবনের বিনিময়ে অচেনা একটি ছেলেকে কি কেউ এইভাবে ছাড়ায়?
আমরা কেউ কিন্তু ঘটনাটা বিশ্বাস করলাম না। জব্বার আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, রুনুর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। আর্মির টর্চারে ওর সব কিছু উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। তোর তো ঘনিষ্ঠ বন্ধু তুই ওরে আড়ালে ডাইকা নিয়া ভালো কইরা সব জাননের চেষ্টা কর।
আমি রুনুকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেলাম। রুনু, কই ধরা পড়ছিলি তুই?
রুনু উদাস গলায় বলল, কংশনদী পার হওনের সময়।
আর্মিরা তোরে কই ধইরা লইয়া গেছিল?
কংশনদীর ওইপারের ক্যাম্পে।
অহন তুই কী করবি?
ওই ক্যাম্পে ফিরত যামু।
কচ কী?
হ। যেই লোকটা আমার জামিন হইছে, আমি না গেলে তো সে ছাড়া পাইবো না। তারে তো মিলিটারিরা গুল্লি কইরা মারবো।
আরে বেডা, ওরে লইয়া তুই চিন্তা করছ ক্যান? তারে মিলিটারিরা গুল্লি কইরা মারুক, নাইলে ছাইড়া দেউক, ওইডা তো তোর ব্যাপার না। তুই তোর জান বাঁচা! ওই ক্যাম্পে ফিরত গেলে মিলিটারিরা তো বেডা তোরে গুল্লি কইরা মারবো।
রুনু অপলক চোখে আমার মুখের দিকে তাকালো। তুই এইডা কী কইলি ধলা? আমি আমার মা ভাইবোনরে দেখনের লেইগা পাগল হইয়া গেছিলাম। আমার অনুরোধে অচেনা একটা লোক আমার জামিন হইছে। তুই একবার ভাইবা দেখ তো কতবড় আত্মার মানুষ সে। আমার জন্য জীবনের রিস্ক নিছে। আর আমি তার লগে বেঈমানি করুম? নিজের জীবন বাঁচানের লেইগা জামিনদাররে মাইরা ফালামু। এইডা হয় না দোস্ত। আমার জীবন তো এমনেই শেষ হইয়া গেছে। বাপ মরছে বড়ভাই মরছে। মা আর বইনগুলোও মনে হয় বাঁইচা নাই। ছোট ভাইটাও হয়তো মরছে। তয় আর আমার একলা বাঁইচা থাকনের অর্থ কী? আমি একজন নামকরা হেডমাস্টারের পোলা। জীবন বাঁচানের জন্য ওই রকম বাপের পোলার তো জবান নষ্ট করন ঠিক হইব না।
ওই রাতটা আমাদের সঙ্গে থাকলো রুনু।
সবাই মিলে অনেক বুঝালাম তাকে। তুই যাইচ না রুনু, তুই তোর জানটা বাঁচা।
মানুষ যে নিজের জীবনকে এত তুচ্ছ করতে পারে সেই প্রথম আমি তা টের পেলাম। সতেরো আঠারো বছরের একজন যুবকের কাছে জীবনের চেয়ে যে তার জবানের দাম বড় ওই প্রথম আমি তা দেখলাম।
রুনু কোনও কিছু কেয়ারই করলো না। পরদিন সকালে বলতে গেলে হাসি মুখেই চলে গেল কংশনদীর ওপারকার আর্মি ক্যাম্পে।
রুনুর জন্য আমি খুব কেঁদেছিলাম।
রুনুর সঙ্গে ওই আমার শেষ দেখা।
কংশনদীর ওপারকার আর্মি ক্যাম্প থেকে রুনু আর কখনও ফিরে আসেনি।
জব্বারদের ক্যাম্পে পাগলাটে ধরনের একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। কাছাকাছি এলাকার বেশ বড় ঘরের ছেলে। বাপ হয়েছে শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যান, ছেলে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা।
আমি সেদিন ক্যাম্পে।
সেই ছেলেটা জব্বারের কাছে এসে বলল, আজ রাতেই সে তার বাপকে মারতে চায়।
জব্বার বলল, পারবি?
অবশ্যই পারবো।
তয় বাড়িতে গিয়া মারনের কাম নাই। আমগ ক্যাম্পে ধইরা লইয়া আয়।
সত্যি সত্যি রাত দুপুরে মুক্তিযোদ্ধা ছেলে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে এলো শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যান বাপকে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝখানে গামছায় চোখ বাঁধা শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যান। মুক্তিযোদ্ধা ছেলে তার দিকে রাইফেল তাক করলো।