আমার মাকে খুবই শ্রদ্ধা করতো ওসমান গনি। ভাবী ডাকতো।
একদিন বাজারের দিকে যাচ্ছি, দশ পনেরোজন রাজাকার নিয়ে বাজারে চক্কর দিচ্ছে ওসমান গনি। হাত ইশারায় আমাকে ডাকলো, এইদিকে আয়।
ভয়ে বুকটা ধ্বক করে উঠল আমার। ঢোক গিলে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আসলামালায়কুম চাচা।
সে আমার সালামের জবাব দিল না। কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কই যাস?
বাজারে যাই চাচা, বাজারে।
বাজারে যাইতাছস ক্যান? খালি ভেগাবণ্ডের মতন ঘুইরা বেড়াও ক্যান? রাজাকারি ট্রেনিংটা লইতে পারো না?
ভয়ে ভয়ে বললাম, ট্রেনিং কেমনে লমু? আমার তো কেউ নাই চাচা?
নাই মানে?
মা আর আমি ছাড়া তো কেউ নাই। বেবাকতে মইরা গেছে।
হ। ওইডা আমি জানি।
অহন মার অবস্থাও খুব খারাপ। যখন তখন মইরা যাইবো। আমি বাজার বোজার কইরা মারে খাওয়াই। বাড়ির পাকশাক বেবাকই আমার করতে হয়।
কস কী তুই?
হ চাচা।
ওসমান গনি একটু চিন্তিত হলো। তোর মার অসুখ? কেউ নাই? আইচ্ছা তুই যা। মার সেবাযতœ কর গিয়া।
সঙ্গের রাজাকারদের বলল, ওরে কেউ কিছু কইয়ো না। বুড়া মা ছাড়া ওর অহন আর কেউ নাই। ভাইবোন বেবাক মইরা গেছে।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাজারে না গিয়ে ফিরে এলাম বাড়িতে। মাকে বললাম ওসমান গনির কথা।
পরদিন গেলাম ঢুফির বাজার। ক্যাম্পে গিয়ে জব্বারকে বললাম ওসমান গনির কথা। তার অত্যাচার এবং মানুষ মারার কথা।
জব্বার চুপচাপ সব শুনে রাখল।
ঈশ্বরগঞ্জ ক্যাম্পে কিছু মিলিশিয়াও আসছে। কালো সালোয়ার কামিজ পরা। ভয়ঙ্কর দেখতে এক একটা। রাজাকারদের নিয়ে বাজারে ঘুরে বেড়াই তারা। গরিব দুঃখী গৃহস্থলোকেরা টুকটাক জিনিসপত্র নিয়ে আসে বাজারে, সেইসব জিনিসের যেটা যেটা পছন্দ হয় সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে নেয়। কেউ কোনও প্রতিবাদ করতে পারে না। করলেই ধাম করে কোঁকসা বরাবর বুটপরা পায়ের লাথি। কখনও কখনও রাইফেলের বাট দিয়ে বারি। মুদিদোকান থেকে তেলের টিন নিয়ে যাচ্ছে, একজন গৃহস্থ হয়তো দুটো মুরগি এনেছে বিক্রি করতে, ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মাঠ থেকে ধরে নিয়ে আসছে গরু ছাগল। জবাই করে খাচ্ছে ক্যাম্পে বসে। শুয়োরের বাচ্চাদের আনন্দ উল্লাসের সীমা নেই। কিন্তু এলাকার লোক নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেকের বাড়িতেই খাবার নেই।
ওসমান গনিকে একদিন দেখলাম, জঘন্য ব্যবহার করলো এক গৃহস্থের সঙ্গে। লোকটা বুড়ো মতন, মুখে পাঁকা দাড়ি। একজোড়া মুরগি বিক্রি করতে এনেছে বাজারে। ওসমান গনির চোখে পড়ল সেই মুরগি। একজন রাজাকারকে বলল, বুইড়ার কাছ থিকা ওই দুইটা লইয়া আমার বাড়িতে দিয়া আয়।
লোকটা কাতর গলায় বলল, বাবারে, আমার ঘরে কয়েকদিন ধইরা খাওন নাই। ঘরে বেচনের মতন কোনও জিনিসও নাই। খালি এই মুরগি দুইটা আছিল, এই দুইটা বেইচা চাইল ডাইল লইয়া বাড়িত যামু। বউ পোলাপাইনরে খায়ামু।
লোকটাকে বিরাট ধমক দিল ওসমান গনি। কথা কইস না নডিরপুত। গুল্লি কইরা দিমু।
লোকটা ওসমান গনির সঙ্গে একটু তর্ক করেছিল। আপনের মতন মানুষ এমন করলে আমরা যামু কই, কার কাছে যামু?
ওসমান গনি আর কথা বলল না। একজন রাজাকারকে কী ইশারা করল, দুতিন মিনিটের মধ্যে ক্যাম্প থেকে একদল মিলিশিয়া এলো, এসে প্রথমে লোকটার দাড়ি ধরে দুতিনটা হেঁচকা টান দিল। তারপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল বাজারের মাটিতে। লোকটার চোখ দিয়ে তখন পানি পড়ছে। শব্দ করে কাঁদছে না সে, কাঁদছে নিঃশব্দে। মুরগি নিয়ে ওসমান গনির দল চলে গেছে। বাজারের মাটি থেকে গামছাটা কুড়িয়ে উঠে দাঁড়াল সেই লোক। গামছায় চোখ মুছতে মুছতে হাঁটতে লাগল।
আমি তখন ভয়ে ভয়ে থাকি, পালিয়ে পালিয়ে থাকি। যখন যেটুকু খবর পাই, জব্বারকে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসি।
এই খবরও দিয়ে এলাম।
বাপ এবং ভাইকে মেরে ফেলার পর রুনুদের ফ্যামিলিটা তছনছ হয়ে গেছে। কে কোথায় চলে গেছে কিছুই জানি না আমি। এদিকে মিলিটারিরা কেমন যেন একটু বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে। দেশের সর্বত্র চলছে প্রচণ্ড যুদ্ধ। ঈশ্বরগঞ্জ ডাকবাংলোর ক্যাম্পে মিলিটারিদেরকে খুবই অস্থির দেখি। প্রথম প্রথম যে ভয় গ্রামের মানুষের ছিল তা যেন বেশ কিছুটা কমে এসেছে। রাতভর টহল দেয় আর্মি। এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে। উড়ো খবর পেয়ে কোথাও কোথাও ছুটে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধানে। সঙ্গে রাজাকার আর শান্তিবাহিনীর লোক। গভীর রাতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে কোনও বাড়িতে। প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে টুকটাক যুদ্ধ হচ্ছেই। কোনও বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা আছে বা আশ্রয় নিয়েছে শুনলেই কোনও কিছু না ভেবে সেই বাড়ি ঘেরাও করে গোলাগুলি শুরু করে মিলিটারিরা। তারপর আগুন জ্বালিয়ে দেয় সেই বাড়িতে।
জব্বারদের ক্যাম্পেও দেখি এক ধরনের অস্থিরতা। দল বেঁধে একেক দিকে যাচ্ছে তারা। মিলিটারি যাতে অনায়াসে সর্বত্র যাতায়াত করতে না পারে সেইজন্য ছোটখাটো পুল ব্রিজ সব উড়িয়ে দিচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা। রামগোপালপুরের ব্রিজটা উড়ালো ডিনামাইট দিয়ে। এই ব্রিজটা ছিল বহু পুরনো। গৌরিপুরের ব্রিজটা উড়ালো, সেটাও পুরনো ব্রিজ। শুধু ময়মনসিংহের ব্রিজটা উড়াতে পারলো না। রামগোপালপুর আর গৌরিপুরের ব্রিজ ধ্বংস হয়ে গেছে শুনে ময়মনসিংহের ব্রিজের দুপাশে প্রচুর আর্মি ছিল পাহারায়। মুক্তিযোদ্ধারা ওদিকটাতে যেতে পারেনি।