ঢুফির বাজার ক্যাম্প থেকে আমার বন্ধু কমান্ডার জব্বারের আদেশ পালন করতে অন্যরকমের এক মুক্তিযোদ্ধা হয়ে আমি ঈশ্বরগঞ্জে ফিরে এলাম। জব্বার যেভাবে বলেছিল সেইভাবে কাজ শুরু করলাম।
ডাকবাংলোর অদূরে বিশাল এক মাঠ।
সেই মাঠে গরু চড়ায় এলাকার হতদরিদ্র কৃষকরা। এই শ্রেণীর মানুষকে মিলিটারিরাও কিছু বলে না, রাজাকাররাও কিছু বলে না। আমি গিয়ে তাদের সঙ্গে মিশে গেলাম। ছেঁড়া একটা লুঙ্গি জোগাড় করেছি, গামছা এবং মাথলা জোগাড় করেছি। জুন জুলাই মাসের রোদে পুড়ে যাচ্ছে দেশ, খোলামাঠ ঝাঁ ঝাঁ করে রোদে। হাঁটু পর্যন্ত উঁচু করে ছেঁড়া লুঙ্গি পরি। কোমরের কাছে বাঁধি পুরনো গামছা, মাথায় মাথলা দিয়ে হতদরিদ্র কৃষকদের সঙ্গে মিশে ওদের গুরুগুলো চড়াই। আমাকে পেয়ে কেউ কেউ তাদের গরু আমার জিম্মায় দিয়ে অন্যান্য কাজে চলে যায়। আমি গরু চড়াবার ফাঁকে ফাঁকে ডাকবাংলোর আর্মি ক্যাম্পের দিকে চোখ রাখি। তারা কী করে, কাকে ধরে আনে, কাকে মারে সব দেখে রাখি।
কখনও কখনও রাখালের সাজেই বাজারের দিকে যাই। বাজারের চারদিকে গিজগিজ করে রাজাকার। প্রত্যেকের কাঁধে থ্রি নট থ্রি রাইফেল। প্রত্যেকেই নিয়েছে রাজাকারি ট্রেনিং। কিন্তু ভিতরে ভিতরে অনেকেই রাজাকার না। ওই যে বলেছি জীবন বাঁচাবার জন্য রাজাকার হয়েছে কেউ কেউ। ওই শ্রেণীর রাজাকাররা সত্যিকার অর্থেই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। কারণ তারা নানারকম ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করছিল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে।
প্রথম দিন আমাকে রাখালের চেহারায় দেখে ওরকম দুজন রাজাকার জিজ্ঞেস করলো, কী রে ধলা, খবর কী?
আমি শুকনো গলায় বললাম, কোন রকমে মারে লইয়া বাঁইচা আছি ভাই। তোমগ এইদিককার খবর কী?
এইরকম টুকটাক কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আগাতে চাচ্ছি। রাজাকারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ওইসব মুক্তিযোদ্ধা বুঝে যায়, আমি আসলে কী জানতে চাই, আমি আসলে কাদের হয়ে কাজ করছি?
ওরা আমাকে খবর দিতে শুরু করে। কাইল সকালে দুই গাড়ি আর্মি যাইবো হালুয়াঘাটে।
পরদিন ভোররাতে ওঠে আমি দৌড়ে যাই ঢুফির বাজার ক্যাম্পে। জব্বারকে দিয়ে আসি যতটুকু খবর সংগ্রহ করতে পেরেছি। দৌড়ে দৌড়ে যাই, দৌড়ে দৌড়ে আসি। তারপরও ফিরতে দুপুর পেরিয়ে যায়।
যেসব রাজাকার ভিতরে ভিতরে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের উদ্দেশ্য একটাই, কাঁধের অস্ত্রটি আর যতগুলো সম্ভব গুলি নিয়ে ওরা একদিন উধাও হয়ে যাবে। সম্ভব হলে আর্মি ক্যাম্প থেকে অস্ত্র চুরি করে উধাও হয়ে যাবে। রাজাকার হিসাবে অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং তো ওদের আছেই।
এরমধ্যে জনা পঁচিশেক অস্ত্র আর গুলি নিয়ে উধাও হয়েছে। সরাসরি চলে গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। যারা এভাবে পালিয়েছে, তারা নিজেরা বেঁচেছে ঠিকই কিন্তু তাদের ফ্যামিলি বাঁচেনি। তাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে আর্মি। মা বাপ ভাইবোন আত্মীয় স্বজন যাকে যাকে পেয়েছে ধরে নিয়ে এসেছে। টর্চারে টর্চারে মেরে ফেলেছে। অস্ত্র নিয়ে কোথায় পালিয়েছে তাদের বাড়ির ছেলে, সেইসব খবরও বের করে ফেলেছে। কিন্তু ধরতে পারেনি একজনও মুক্তিযোদ্ধাকে।
আসল রাজাকারগুলো বাজারে আমাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলেই ওদের মতো রাজাকারিতে নাম লেখতে বলতো। ট্রেনিংটা লইয়া ল ধলা। অস্ত্র পাবি, খাওন দাওন টেকা পয়সা পাবি, অসুবিধা কী?
আমি কাতর গলায় বলি, আমার মা বুড়ো মানুষ তারে নিয়া বড় বিপদে আছি। মার দেখভাল করতে হয়। রান্নাবান্না কইরা খাওয়াইতে হয়। বাড়ি লুট হয়ে গেছে, থাকি খোলা আসমানের তলায়। এই অবস্থায় মারে বাঁচাইয়া রাখন আমার বড় কর্তব্য।
ওইসব রাজাকার জানে মা আর আমি ছাড়া আমার ভাইবোন আর কেউ বেঁচে নেই। সব মারা গেছে। ওদের বুঝি একটু মায়াও লাগতো আমার জন্য। আমাকে আর কিছু বলতো না।
শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যান হয়েছে ওসমান গনি। এলাকায় ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত। বিদ্বান লোক, বুদ্ধিমান লোক। হঠাৎ করে সে গেছে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে। এত ভালো লোক কিন্তু শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চেহারাটা তার বদলে গেল। এমন অত্যাচার শুরু করলো লোকজনের ওপর। তার দোসর হিসেবে আছে সেই কেরামত আলী চেয়ারম্যান। ওই শুয়োরের বাচ্চা আবার একটা ভালো পথ ধরেছে, মিলিটারি আর রাজাকারদের সঙ্গেও খাতির , মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেও খাতির। দুই দলকেই হাতে রাখে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে টাকা পাঠায়, চাল ডাল ওষুধ পাঠায়। কেরামত আলীর এই কায়দা আবার ওসমান গনি টের পায় না। হাতে ক্ষমতা পেয়ে ওসমান গনি গেছে পাগল হয়ে। পাকিচ্চানী মিলিটারিদের চেয়েও বেশি নৃশংস হয়ে উঠেছে সে। যাকে খুশি তাকে ধরে নিয়ে আসে। দিন দুপুরে গুলি করে মারে। মেয়েদেরকে ধরে এনে দিন দুপুরে অত্যাচার চালায়। কোনও কোনও লোককে ধরে এনে তার চেহারার দিকেও তাকায় না, চামচাগুলোকে অর্ডার দেয়, মাইরা ফালা।
হিন্দু হোক মুসলামান হোক, অবিরাম মানুষ মারতে শুরু করলো ওসমান গনি। কোন জনমে কার সঙ্গে তার বিরোধ ছিল সেইসব বিরোধের প্রতিশোধ নিতে লাগলো। অন্যদিকে রাজাকাররা চালাচ্ছে লুটপাট। ওসমান গনি যেহেতু শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান, তার আদেশে চলতো রাজাকাররা। লুটপাট করে বড়লোক হয়ে গেল লোকটা। আগেই বলেছি শিক্ষিত মানুষ। উর্দু খুব ভালো বলে। আর্মিদের সঙ্গে গড় গড় করে কথা বলে। উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে নিজের ফায়দা লুটে।