তাদের কথা শুনে আমার সেই প্রিয় স্যার আর তার বড়ছেলেকে, আমার প্রিয়বন্ধু রুনুর বাবা আর তার বড়ভাইকে কেরামত আর আক্কাসের চোখের সামনে গুলি করে মারলো মিলিটারিরা। সেই মৃত্যু দৃশ্য থেকে হায়েনার মতো খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছিল কেরামত আর আক্কাস।
হেডমাস্টার স্যার আর তার বড়ছেলেকে আক্কাসরা এইভাবে হত্যা করিয়েছিল পুরনো একটা ক্রোধ মিটাবার জন্য। ঈশ্বরগঞ্জে রুনুদের ছিল অঢেল জায়গা সম্পত্তি। কেরামত লোভী চেয়ারম্যান। রুনুদের জায়গা সম্পত্তি বেশ কিছু সে দখল করেছিল। ওসব নিয়ে স্যারের সঙ্গে মামলা মোকদ্দমাও চলছিল। মামলায় জিততে পারছিল না কেরামত। অন্যদিকে আরও জমি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছিল। স্বাভাবিক অবস্থায় তো স্যারকে খুন করা যায় না। কারণ স্যার খুবই জনপ্রিয় মানুষ। তাকে খুন করালে খুবই বিপদে পড়বে কেরামত। এইজন্য মিলিটারিদের মাধ্যমে পথের কাঁটা সরিয়ে দিল।
আমার সঙ্গে তখন একটা পয়সাও নেই।
সকালবেলা স্টেশনের ওদিক দিয়ে রওনা দিয়েছি। তার আগে আক্কাসের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আক্কাসের বাড়ি আমাদের বাড়ির সঙ্গেই তো। সকালবেলা আমি গোসল করেছি। গামছা পরে গোসল করে ওই ছেঁড়াপ্যান্ট গেঞ্জি পরেছি। তারপর চুপচাপ পথে নেমেছি। আক্কাস কিছু বুঝতেই পারেনি।
ঢুফির বাজার জায়গাটা ঈশ্বরগঞ্জ থেকে বেশ অনেকটা দূরে। ক্ষেতখোলা বিল বাওড়ের ভেতর দিয়ে, গ্রামের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ। আমি হাঁটছি, হাঁটছি। ঢুফির বাজারে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল।
ঢুুফির বাজারে গিয়ে দেখি এ যেন একেবারেই অন্যরকমের একদেশ। মানুষের কোনও চিন্তা টেনশান কিচ্ছু নেই। বাজার করছে, খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে। চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কোনও ভাবনাই নেই কারুর। দেশে যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, পাকিচ্চানীরা যে মানুষ মেরে শেষ করে ফেলছে এসব নিয়ে যেন মাথা ব্যথা নেই। একেবারেই স্বাভাবিক অবস্থা চারদিকে।
আমি অবাক।
এ কোন দেশে এলাম?
কোথায় আমাদের শ্বাসরুদ্ধকর ঈশ্বরগঞ্জ, আর কোথায় এই ঢুফির বাজার? হাতেরম মুঠোয় প্রাণ নিয়ে ঢুকতে হয় ঈশ্বরগঞ্জে। এই বুঝি রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেল মিলিটারি ক্যাম্পে, এই বুঝি ক্যাম্পের পিছনে নিয়ে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে দাঁড় করালো, এই বুঝি গুলি করে দিল বুকে।
আর ঢুফির বাজার?
ঢুফির বাজার যেন আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, সেই স্বাধীন এক টুকরো বাংলাদেশ।
আমার মন ভালো হয়ে গেল।
বুক ভরে গেল উচ্ছ্বাস আনন্দে।
বাজারের দিকে যাচ্ছে এমন একজন লোককে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, এখানে মুক্তিবাহিনী কোথায় থাকে?
লোকটা সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকালো। কেন?
এখানকার মুক্তিবাহিনীতে আমার এক আত্মীয় আছে। আমি একটু তার লগে দেখা করুম।
তোমার আত্মীয়র নাম কী?
ঈশ্বগঞ্জের আব্দুল জব্বার আমার চে’ দুবছরের বড়। কিন্তু আমার তুই তুকারি বন্ধু। শুনেছি আগরতলা থেকে সে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। ঢুফির বাজারের এই দিকেই আছে।
আব্দুল জব্বারের নামই আমি সেই লোকটাকে বললাম।
আব্দুল জব্বার নামটা শুনে লোকটা বেশ চঞ্চল হলো। দূরের একটা বটগাছ দেখিয়ে বলল, ওই বটগাছের ওদিক দিয়া যাও। গেলেই দেখবা বাঁশঝাড়ওয়ালা একটা বড়বাড়ি, ওই বাড়িতেই মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প।
দ্রুত হেঁটে সেই বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার বয়সী, আমার চে’ বড় এরকম তিরিশ চল্লিশজন যুবক। অনেকেই আমার চেনা, অনেকেই ঈশ্বরগঞ্জের ছেলে। আব্দুল জব্বারকে পেলাম প্রথমেই। সঙ্গে আছে সাত্তার। আমাকে দেখে হইচই পড়ে গেল বাড়িতে।
জব্বার বলল, তুই আইছস ক্যান?
আমিও মুক্তিবাহিনীতে যামু। আমিও ট্রেনিং লমু।
সাত্তার বলল, তোর ট্রেনিং লওনের কাম নাই, তুই যা গা।
না আমি যামুই। তোরা আমার যাওনের ব্যবস্থা কর।
জব্বার বলল, সবাই গেলে তো হইব না। সবাই মরলে তো চলবো না। তোর যাওনের কাম নাই।
জব্বারের পরনে হাফপ্যান্ট, কোমরে মোটা বেল্ট। তার ওপর হাফহাতা শার্ট। মাথার চুল লম্বা লম্বা। মুখ দাড়িগোঁফে ভরা। চোখ দুটো টকটকে লাল। জব্বারের কাঁধে ঝুলছে স্টেনগান। গলার আওয়াজ কেমন মোটা ফ্যাফ্যাসে হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সঙ্গের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নানারকম অর্ডার দিচ্ছে।
সাত্তার বলল, তুই মনে হয় বোঝস নাই ধলা। জব্বার হইল আমগ কমান্ডার।
আমি জব্বারের মুখের দিকে তাকালাম। তুই আমারে না করিস না দোস্ত। আমারে ট্রেনিংয়ে পাঠা।
জব্বার ঠাণ্ডা গলায় বলল, থাক এইখানে, পরে বুঝুম নে।
আমি থেকে গেলাম।
একজন মধ্যবয়সী মহিলা রান্নাবান্না করতো ক্যাম্পে। দুপুরবেলা খেলাম সেই মহিলার রান্না ভাত একপদের মাছ আর ডাল। রাতেরবেলা খাসির মাংস আর ভাত। বিকেলবেলা কারা যেন একটা খাসি দিয়ে গিয়েছিল। সেই খাসি জবাই করে রাতেরবেলা বিরাট খাওয়া দাওয়া। খাসির মাংসের বড় বড় টুকরা আর তেলতেলে ঝোল, কী যে আরাম করে খেলাম। মনে হলো বহুদিন পর পেটভরে খাচ্ছি।
খাওয়ার দাওয়ার পর আলাদা করে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল জব্বার। বলল, তোর আগরতলা যাওনের কাম নাই। তোর ট্রেনিং নেওনের দরকার নাই। সবার ট্রেনিং লাগে না। তুই অন্যকাম কর।
কী কাম?
এলাকায় আর্মি আইছে না?
হ আইছে।
তোর কাম হইল ঈশ্বরগঞ্জ ডাকবাংলোর ক্যাম্প থিকা আর্মি কই যায় না যায়, এই খবর রাখন। রাজাকাররা কী করে না করে, এই খবর রাখন। সব খবর লইয়া তুই এই ক্যাম্পে আইসা আমারে জানাইয়া যাবি। তয় কামডা করতে হইব খুব সাবধানে। এইটাও কিন্তু মুক্তিবাহিনীরই কাম। এই কাম করলে তুই মুক্তিযোদ্ধা হইয়া যাবি। এইটা তোর ডিউটি। কাইল সকালেই তুই ঈশ্বরগঞ্জ চইলা যা। কাম শুরু কর।