বুঝতে পারি, ভয়ঙ্কর ভাবে চলছে নির্যাতন। ধর্ষণ। হয়তো বা পালাক্রমে চলছে। আফ্রিকার বন্যকুকুরের দল যেভাবে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ধরে নিরীহ হরিণ, চারদিক থেকে খাবলে খুবলে ছিঁড়তে থাকে তার মাংস, এযেন ঠিক সেই রকম এক কাজ। মানুষ হয়ে মানুষের ওপরই এরকম নির্যাতন চালাচ্ছে মানুষের মতো দেখতে একশ্রেণীর বন্যকুকুর।
ক্যাম্পের আশেপাশে কোনও লাশ চোখে পড়তো না। মেরে লাশগুলো ওরা ফেলে দিয়ে আসতো দূরের বিল বাওড় কিংবা ডোবা নালায়।
আমাদের পাড়াটা বাস্তবিকই সুনসান হয়ে গেছে, নির্জন হয়ে গেছে। লোকজন বলতে গেলে নেই। আছে ওই শালারপুত আক্কাস। বউবেটি নিয়েই আছে। ওর সঙ্গে কেমন কেমন করে ভাব হয়েছে পাকিস্তান আর্মির। যে বেটা ক্যাপ্টেন, ঈশ্বরগঞ্জ থানার দায়িত্বে, ওই পুঙ্গিরপুতের সঙ্গে খাতির জমিয়েছে আক্কাস। আক্কাসের মতো এলাকার আরও দুচারজন রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছে। ততোদিনে সারা দেশেই পাকিস্তানের পক্ষের লোকগুলো রাজাকার হতে শুরু করেছে। শান্তিবাহিনীর সদস্য হতে শুরু করেছে।
এসব দেখে মা গেল ভয় পেয়ে।
পাড়ায় একমাত্র যুবক ছেলে আমি। আক্কাস যদি এই কথা মিলিটারিদের জানিয়ে দেয় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এর আগে থানা কম্পাউন্ডে, স্কুলের মাঠে মুক্তিযোদ্ধার প্রাথমিক একটা ট্রেনিংও নিয়েছিলাম আমি। আক্কাস এসব জানে।
মা আমাকে বলল, তুই সইরা যা ধলা। আমার যা হওনের হইব তুই তোর জান বাঁচা।
আমাদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার অভাবটা তখন আর নেই। মার সইয়ের বাড়ি থেকে বিরাট একবচ্চা চাল, বেশ কয়েক সের ডাল, আনাজপাতি তরিতরকারি চারজন লোক এসে দিয়ে গেছে। যা দিয়ে গেছে দুজন মানুষের সেই খাবারে তিন চারমাস চলবে।
এদিক দিয়ে আমি খানিকটা নিশ্চিন্ত।
মা অন্তত না খেয়ে মরবে না। তাও মাকে বললাম, বেশি অসুবিধা দেখলে তুমি পুম্বাইলে চইলা যাইও। মাউই মার বাড়িতে গিয়া থাইকো। ওই বাড়িতে থাকলে ভালো থাকবা তুমি। তোমার সই তো আছেই, হাসিবুজিও আছে। আর ওইদিকে তো মিলিটারি যাওনের প্রশ্নই ওঠে না। তুমি পুম্বাইলে চইলা যাইও।
মা বলল, কইলাম না আমারে লইয়া তুই চিন্তা করিস না। তুই তাড়াতাড়ি সইরা যা।
পরনে সেই ছেঁড়া খয়রি প্যান্ট আর স্যান্ডোগেঞ্জি। আমি পথে নামলাম।
স্টেশনের ওদিক দিয়ে একটা রাস্তা আছে। ওই রাচ্চা দিয়ে কয়েক মাইল গেলে ঢুফির বাজার। ‘ঢুফি’ শব্দটার অর্থ হলো ঘুঘু। ঘুঘু পাখি। ঢুফির বাজার মানে ঘুঘুর বাজার। ওই দিকটায় শোনলাম মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প হয়েছে। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মুক্তিযোদ্ধারা। ততোদিনে দেশের এদিক ওদিক যুদ্ধ শুরু করেছে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সামনাসামনি যুদ্ধ করছে, গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করছে। টাঙ্গাইলের ওদিকে কাদের সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনী পাকিস্তানী মিলিটারি মেরে সাফা করে ফেলছে। গোপনে গোপনে যারা স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র শোনে তাদের কাছ থেকে এইসব খবর পাই।
ঈশ্বরগঞ্জ ডাকবাংলোর ক্যাম্পে দশ পনেরোটা আর্মির গাড়ি। প্রায়ই এই গাড়িগুলো ভরে মিলিটারিরা যায় হালুয়াঘাটের দিকে। কাদেরিয়া বাহিনী হালুয়াঘাটের ওইদিক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে নাকি পাকিস্তান আর্মি যাচ্ছে কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে। কিন্তু যুদ্ধে পাকিস্তানীরা একদমই সুবিধা করতে পারছে না। কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে বেধরক মরছে।
ঈশ্বরগঞ্জের ওই পুঙ্গিরপুত ক্যাপ্টেন কেরামত আলী আক্কাস আলীর মতো নেড়িকুত্তাগুলোকে ডেকে বলেছে, আমাদের অনেক রাজাকার দরকার। যে বাড়িতে চারজন পুরুষ আছে, সেই বাড়ির দুজনকে অবশ্যই রাজাকার হতে হবে। যারা হতে চাইবে না তাদেরকে গুলি করে মারবো।
পাকিস্তানের প্রেমে গদগদ হয়ে স্বেচ্ছায় রাজাকার হয়েছিল অনেকেই। আবার কেউ কেউ হয়েছিল প্রাণের ভয়ে, বাঁচার তাগিদে। ভিতরে ভিতরে তারা স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। ওপরে ওপরে রাজাকার। এই শ্রেণীর রাজাকাররা অনেক রকমভাবে আমাদের অনেক উপকার করেছে। আমি তাদেরকে রাজাকার মনে করি না। মনে করি তারাও আসলে মুক্তিযোদ্ধা। জীবন বাঁচাবার জন্য ওপরে ওপরে তারা রাজাকার, ভিতরে ভিতরে তারা মুক্তিযোদ্ধা।
এলাকার কিছু স্বচ্ছল হিন্দুও রয়ে গিয়েছিল। আক্কাসরা সেইসব হিন্দুদেরকে খুঁজে বের করেছে। মিলিটারিদের কাছে তাদের হদিস দিয়েছে। মিলিটারিরা গিয়ে ধরে এনেছে। ধরে এনে প্রথমেই কিন্তু মেরে ফেলেনি। আক্কাসরা কেউ কেউ ততোদিনে বেশ ভালো উর্দু শিখে গেছে। মিলিটারিরা তাদের মাধ্যমে প্রস্তাব দিয়েছে, হিন্দুগুলোকে বলো ওরা যদি পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, ওরা যদি মুসলমান হয়, তাহলে প্রাণে বেঁচে যাবে। ওদেরকে আমরা মারবো না।
রাইফেলের নলের মুখে, প্রাণের ভয়ে রাজি হয়ে গেছে সবাই। মসজিদের ইমাম সাহেবকে আগেই এনে বসিয়ে রাখা হয়েছে ক্যাম্পে। তিনি নিয়ম মতো ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছেন অসহায় হিন্দুদেরকে।
কিন্তু মুসলমান হতে চেয়েও বাঁচতে পারলেন না আমাদের চূর্নিখোলা হাইস্কুলের হেডমাস্টার, হরিদাস ভট্টাচার্য আমার বন্ধু রুনুর বাবা। রাতেরবেলা তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে ক্যাম্পে। খবর পেয়ে রুনুর বড়ভাই বেনু ছুটে গেছে। তাকেও আটক করেছে মিলিটারিরা। দুজনেই রাজি হয়ে গেছে মুসলমান হতে। বলেছে, পরিবারের অন্যান্যদেরকেও মুসলমান করে ফেলবে তারা। কেরামত আর আক্কাস দুইভাই ছিল সামনে। মিলিটারিদেরকে তারা বলল, হেডমাস্টার লোক ভালো না। যতই মৌলবি ডেকে তাকে মুসলমান করা হোক, এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েই সে ধর্মটা মানবে না, পরিবার নিয়ে রাতের অন্ধকারে উধাও হয়ে যাবে।