পেটপুরে জাউ খাওয়ার ফলে শরীরের শক্তিটা আমার ফিরে এসেছিল। মাও বেশ শক্ত সামর্থ্য মহিলা। সারাদিন খেটেখুটে মা আর আমি মিলে আক্কাসের বাড়ি থেকে আনা ছয়টা টিন দিয়ে রোদ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার মতো একটা চালা মতো করে ফেললাম। বাঁশের খুঁটিখাঁটি দিয়ে একেবারেই যেনতেন একটা ব্যবস্থা। দুজন মানুষ কোনওরকমে ঘুমাতে পারে এইটুকু মাত্র জায়গা।
আহা রে, কত জৌলুশ একদিন এই বাড়ির ছিল। আর আজ?
চালাটার দিকে যতবার তাকাই, আমার চোখ ভরে আসে জলে। বুকটা হু হু করে। আমাদের বাড়ি লুট করেছিল কেরামতের ভাই আক্কাস। আক্কাসের কথা ভেবে বুকের ভেতর হুঙ্কার ছেড়ে জেগে উঠতে চায় এক ঘুমন্ত সিংহ।
আক্কাস শুয়োরের বাচ্চাকে আমি দেখে নেবো। কোনও না কোনওদিন প্রতিশোধ ওর ওপর আমি নেবোই।
এলাকার তরুণ যুবকরা তখন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া শুরু করেছে। আগে থেকেই যাচ্ছিল। ঈশ্বরগঞ্জে মিলিটারি আসার পর গোপনে গোপনে যাওয়া বেড়ে গেল। আমার বয়সী আমার বন্ধুরাও কেউ কেউ চলে গেল। যারা যায়, তারা কেউ কেউ গোপনে গোপনে আমার সঙ্গে দেখা করে। দেখা করে বলে, কী রে ধলা, যাবি? চল যাইগা।
মার সামনেই কেউ কেউ এরকম কথা বলে। মা তাদেরকে বলে, তোরা যা বাজান, ধলা পরে যাইবো।
কেন যে মা আমাকে এভাবে ফিরিয়ে রাখছিল আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সবাই জানে আমাদের বাড়ি লুট হয়ে গেছে। কোনও রকমে তৈরি করা একটা টিনের চালায় মা আর আমি থাকি। ধার উধার করে মা কিছু চাল জোগাড় করে কিছু আনাজপাতি ডাল মাছ জোগাড় করে। ওই খেয়ে কোনও রকমে আমরা বাঁচি। কেরামত আলীর শত্রুতায় এই অবস্থা আমাদের। ভাইকে দিয়ে সে আমাদের বাড়ি লুট করিয়েছে। ওই যে আমার বোনকে পাঁচ নম্বর বউ বানাতে চেয়েছিল। মা রাজি হয়নি দেখে এইভাবে সে আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছিল।
কেরামতের কথা ভাবলে আমার কখনও কখনও মনে হয় বাংলাদেশে জন্মে, বাঙালির ঘরে জন্মে, বাঙালি হয়েও কোনও কোনও মানুষ ছিল পাকিচ্চানী মিলিটারির নরপশুগুলোর চেয়েও নিকৃষ্ট।
আমার বুকটা তখন ক্রোধে জ্বলে। আমার ইচ্ছে করে মুক্তিযুদ্ধে চলে যাই। ট্রেনিং নিয়ে অস্র হাতে ফিরে আসি। পাকিস্তানী মিলিটারিগুলোর সঙ্গে গুলি করে মারি কেরামত আর আক্কাসের মতো বাংলাভাষায় কথা বলা নিকৃষ্টতম জীবগুলোকে।
মাকে বলি এইসব কথা। মা আমি মুক্তিযুদ্ধে যাই। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে এসে এইসব অনাচারের প্রতিশোধ নিই।
মা বলে সেই এক কথা। ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর।
হাসিবুজি তখন পুম্বাইলে, মার সইয়ের বাড়িতে। ছোটবোন রাশেদা ঢাকায় বড় ভাইয়ের কাছে। মেজোভাইয়ের খবর নেই। কোথায় আছে কে জানে! শুনেছি বড় ভাইয়ের একটা ছেলে হয়েছে। ছেলের নাম রেখেছে মামুন। ভাই ভাবী আর তাদের একমাত্র সন্তান , সঙ্গে আছে রাশেদা, আমার ছোটবোন। কারও কোনও খবর নেই। বেঁচে আছে না মরে গেছে জানি না। শুধু তিনজন মানুষের ব্যাপারে নিশ্চিত। যে হ্যাঁ, এই তিনজন মানুষ আমরা বেঁচে আছি। মা হাসিবুজি আর আমি।
মা আর আমি দুজন অসহায় মানুষ কী যে হতাশা নিয়ে বেঁচে আছি তখন। এই হতাশা সহ্য হয় না। এই হতাশা নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না।
মাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ভোররাতের দিকে একদিন আমি একা একা রওনা দিলাম। মুক্তিযুদ্ধে যাবো। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে আসবো।
মোচ্চফা আর আবুল খায়ের আগেই চলে গিয়েছিল। গিয়ে কী যেন কী কারণে আবার ফিরে এসেছে। ওদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। শুনেছি ফিরে এসেছে কিন্তু কোথায় আছে জানি না।
আমারও শেষপর্যন্ত যাওয়া হলো না। কাঁচামাটিয়া নদী পার হয়ে আটদশ মাইল হেঁটে গিয়েছিলাম। যেতে যেতে মনে হয়েছিল, এ আমি কী করছি? আমার অসহায় মাকে আমি কার কাছে ফেলে যাচ্ছি? আমি চলে গেলে মার আর থাকলো কে?
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে আক্কাস আলীর বাড়ি থেকে পাওয়া ছয়খানা টিনের নড়বড়ে চালার তলায় কুপি জ্বালিয়ে আমার আশায় বসেছিল মা। বসে বসে কোরআন শরীফ পড়ছিল। ছায়ার মতো নিঃশব্দে মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। কুপির আলোয় দেখি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মা আমার কোরআন শরীফ পড়ছে।
ঈশ্বরগঞ্জে ঢুকেই মিলিটারিরা ক্যাম্প করেছিল সরকারি ডাকবাংলোয়। আমাদের বাড়ি থেকে বেশ কাছে সেই ডাকবাংলো। দিনেরবেলায় এদিক ওদিক ছাড়িয়ে যায় পাকিচ্চান আর্মি। চারপাশের গ্রাম থেকে ধরে আনে অসহায় নিরীহ মানুষ। হিন্দুপাড়াগুলো খালি হয়েছিল আগেই। একেবারেই দরিদ্র যেসব হিন্দুপরিবার, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই যাদের, সেইসব পরিবারের ছেলে বুড়ো যুবতী বউঝি কিশোরী মেয়ে যাকে পায় ধরে ডাকবাংলোর ক্যাম্পে নিয়ে আসে। পুরুষগুলোকে রাইফেল দিয়ে বেদম মারে। বুট দিয়ে এমন এক একটা লাথি, মাটিতে ফেলে বুটের তলায় চেপে ধরে গলা। আহা রে, সেইসব মানুষের প্রাণ ফাটানো চিৎকার। ঝোঁপজঙ্গলে আর বাঁশবনে লুকিয়ে থেকে সেইসব মানুষের মরণ চিৎকার শুনি আমি। রাগে ক্রোধে বুক জ্বলে। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।
ক্যাম্পের কাছেই আমাদের পাড়াটা বলেই কী না কে জানে, এদিকটায় মিলিটারিরা আসেনি। তাদের ধারণা এইপাড়ার সবগুলি বাড়িই বুঝি ফাঁকা। কোনও বাড়িতেই বুঝি কোনও মানুষ নেই। মানুষ ধরতে তারা চলে যায় অন্যদিককার পাড়ায়, অন্যদিককার গ্রামে। রাতেরবেলা গভীর অন্ধকারে মায়ের পাশে শুয়ে থেকে থেকে নারীকণ্ঠের চিৎকার শুনতে পাই। ডাকবাংলো থেকে ভেসে আসে সেই চিৎকার। ওই যে রামগোপালপুর জমিদার বাড়ির কাছে একবার গিয়েছিলাম তবলার আওয়াজ আর নারীকণ্ঠের চিৎকার শোনার জন্য। এই চিৎকারও সেই চিৎকারের মতোই। যন্ত্রণায় যেন জীবনের শেষ চিৎকারটি দিচ্ছে কোনও নারী। বাবা বাবা, তুমি আমার বাবা। ছাইড়া দাও আমারে, ছাইড়া দাও।