সাক্ষাৎকার গ্রহণ: জিনাত রিপা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো
মানুষ কেমন করে বদলায়
গল্পটা বলেছিল হাজামবাড়ির মজিদ।
গল্পকে সে বলত কিচ্ছা। আমার কিশোরবেলার কথা। গ্রামে নানির কাছে একা একা থাকি। সন্ধ্যাবেলা মজিদ মাঝে মাঝে আমাকে কিচ্ছা শোনাতে আসত। রাক্ষস খোক্ষস, জিন পরী, দেও দানব, ভুত পেতনি আর রাজরাজার কিচ্ছা।
এই কিচ্ছাটা ছিল ডাকাতের।
এক দুর্ধর্ষ ডাকাত রামদা হাতে বনোপথে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই পথে টাকা-পয়সা সোনাদানা নিয়ে যে যায় রামদায়ের এক কোপে ধর থেকে তার মুন্ডুটা আলগা করে দেয় সে। তারপর তার টাকা-পয়সা সোনাদানা নিয়ে বাড়ি যায়। সংসারে বউ ছেলেমেয়ে আছে। তারা খুবই আরাম আয়েশে জীবন কাটায়।
একদিন সেই বনোপথ ধরে এক সাধু আসছিল। ডাকাত তার সামনে রামদা উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধু বললেন, আমাকে তুমি খুন করতে চাও কেন?
তোমার কাছে যা আছে সেসব ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য।
সেটা তো তুমি আমাকে খুন না করেও নিতে পার?
তা পারি, কিন্তু মানুষ খুন করা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ১০০টি খুন করেছি, তোমাকে খুন করলে খুনের সংখ্যা দাঁড়াবে ১০১।
আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
পারো।
ডাকাতির টাকা-পয়সা সোনাদানা দিয়ে তুমি কী করো?
কী আর করব। সংসার চালাই। বউ-ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ করি।
কিন্তু ডাকাতি আর মানুষ খুন করে তুমি যে পাপ করছ এই পাপের দায়ভার কি তোমার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা নেবে?
ডাকাত একটু চিন্তিত হলো। তা তো জানি না।
কোনো দিন কি জানার চেষ্টা করেছ?
না।
এখন গিয়ে জেনে আসো।
আর তুমি?
আমি এখানে তোমার অপেক্ষায় বসে থাকব।
ডাকাত হাসল। তুমি কি আমাকে এতই বোকা মনে করো? আমি তোমাকে এখানে বসিয়ে রেখে ওসব কথা জানতে যাই আর সেই ফাঁকে তুমি পালাও। ওটি হবে না বাপধন।
তাহলে এক কাজ করো। আমাকে এই গাছের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখে যাও, যাতে আমি পালাতে না পারি।
হ্যাঁ, এটা হতে পারে।
তাহলে তা-ই করো।
সাধুকে একটি গাছের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে বাড়ি গেল ডাকাত। গিয়ে স্ত্রীকে প্রথমে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, এই যে আমি ডাকাতি করে, মানুষ খুন করে টাকা-পয়সা রোজগার করে তোমার ভরণপোষণ করি, তাতে যে আমার পাপ হয়, এই পাপের অর্ধেক দায়ভার কি তুমি নেবে?
স্ত্রী অবাক। কেন তোমার পাপের দায়ভার আমি নেব?
যেহেতু তুমি আমার স্ত্রী। আমার অর্ধাঙ্গিনী।
স্ত্রী, অর্ধাঙ্গিনী যা-ই বলো আমার ভরণপোষণ এবং সংসার পরিচালনার দায় তোমার। তুমি কীভাবে কোন পদ্ধতিতে রোজগার করে সংসার চালাচ্ছ সেটা আমার দেখার ব্যাপার না। আমি শুধু দেখব তুমি আমাকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারছ কি না। অন্য কিছুই আমার দেখার ব্যাপার না। রোজগার করতে গিয়ে তোমার যদি কোনো পাপ হয় সেই পাপের দায়ভার তোমার। পৃথিবীতে কারও পাপের দায়ভার অন্য কেউ নিতে পারে না।
ডাকাত চিন্তিত হলো।
গেল ছেলের কাছে। ছেলেও একই কথা বলল। পিতা হিসেবে আমাকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তোমার। সেই দায়িত্বের জন্য তুমি খুন করছ না ডাকাতি করছ তা আমি ভাবতে যাব কেন? তোমার পাপের ভার আমি নিতে যাব কেন? তোমার পাপ তোমার।
ডাকাত গেল মেয়ের কাছে। মেয়েরও একই কথা।
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ডাকাত ফিরে এল বনে। এসে দেখে যে গাছের সঙ্গে সাধুকে বেঁধে রেখে গিয়েছিল সাধু সেই গাছের তলায়ই বসে আছেন কিন্তু তাঁর শরীরে কোনো বাঁধন নেই। মোটা মোটা দড়ি পড়ে আছে সাধুর পায়ের কাছে।
ডাকাত হতভম্ব। এ কী করে সম্ভব? এত শক্ত বাঁধন তুমি কী করে খুলেছ?
সাধু বললেন, আমি খুলিনি। আপনা আপনিই খুলে গেছে।
ডাকাত বুঝে গেল সাধু ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই সাধু বললেন, এবার বলো যে কথা জানতে তুমি গিয়েছিলে সে কথা জেনেছ কি না?
ডাকাত মাথা নিচু করে বলল, জেনেছি।
তোমার স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে কী বলল? তারা কি নেবে তোমার পাপের দায়ভার?
না কেউ নেবে না। তিনজনই পরিষ্ককার বলে দিয়েছে আমার পাপের যাবতীয় দায়ভার আমার। আমার পাপ অন্য কেউ ভাগ করে নেবে না।
তাহলে বোঝো। যাদের ভরণপোষণের জন্য ডাকাতি করছ তুমি, মানুষ খুন করার মতো ভয়াবহ পাপ করছ তারা কেউ তোমার পাপের দায়ভার নেবে না। তোমার পাপ শুধুই তোমার। তাহলে কি লাভ এই পাপ করে?
ডাকাত হাতের রামদা ছুড়ে ফেলে দিল। তাই তো। তারপর সাধুর পা জড়িয়ে ধরল। সাধুবাবা, আমি এখন কী করব? এই ১০০টি খুনের পাপ আমি কীভাবে মোচন করব? ডাকাতি করে যে পাপ করেছি সেই পাপ কী করে মোচন করব?
সাধু বললেন, ওই যে মরা গাছটা দেখছ, এক্ষুনি গিয়ে ওই গাছের তলায় বসো। বসে ভগবানকে ডাকতে থাকো। ভগবান, আমার পাপ মোচন করো। আমার পাপ মোচন করো। যেদিন দেখবে মরা গাছে সবুজ পাতা গজিয়েছে সেদিন বুঝবে ভগবান তোমার পাপ মোচন করেছেন। তোমার জন্য স্বর্গের দরজা খুলে যাবে।
সাধুর কথায় ওই মুহুর্তেই বদলে গেল ডাকাত। জগৎ সংসার ভুলে, স্ত্রী-সন্তান ভুলে মরা গাছের তলায় গিয়ে বসল। ভগবানকে ডাকতে শুরু করল।
দিন যায়, রাত যায়। ডাকাত শুধু ভগবানকেই ডাকে।
মাস যায়, বছর যায়। ডাকাত শুধু ভগবানকেই ডাকে।
কিন্তু তার পাপ মোচন হয় না। মরা গাছে গজায় না সবুজ পাতা।
একদিন ডাকাত দেখে বনের ধারে একজন কাউকে কবর দিয়ে যাচ্ছে কিছু লোক। সন্ধ্যার দিকে তারা কাজ সেরে চলে যাওয়ার পর বিশাল চাঁদ উঠল আকাশে। ফুটফুটে জ্যোৎস্মায় ভরে গেল চারদিক। ডাকাত উদাস চোখে জ্যোৎস্মা দেখছে আর মনে মনে ভগবানকে ডাকছে। এ সময় দেখা গেল একটি লোক কোদাল হাতে সেই কবরটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কোদাল চালিয়ে মাটি খুঁড়ল সে, লাশ তুলে আনল। লাশের শরীর থেকে কাফনের কাপড় সরানোর পর এতটা দুর থেকেও ডাকাত দেখতে পেল, লাশটি খুব সুন্দরী একটি মেয়ের। লোকটি তারপর সেই লাশের ওপর নিজের বদমতলব হাসিল করার প্রস্তুতি নিল। এই দেখে ভগবানকে ডাকতে ভুলে গেল ডাকাত। তক্ষুনি ছুটে গেল সেখানে। কোদালের কোপে হত্যা করল লোকটিকে। মেয়েটির লাশ সসম্মানে, সযত্নে কবরে শুইয়ে দিল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে যতটা যত্ন সম্ভব ততটা যত্নে কবরের ওপর মাটিচাপা দিল। এসব কাজ শেষ করে সে যখন তার আগের জায়গায়, মরা গাছটির তলায় ফিরে এসেছে, এসে দ্যাখে চাঁদের আলোয় চকচক করছে মরা গাছের ডালপালা। সবুজ পাতায় ভরে গেছে মরাগাছ। অর্থাৎ ডাকাতের পাপ মোচন হয়েছে। ঈশ্বর তার পাপ ক্ষমা করেছেন।
মানুষ আসলে এভাবে বদলায়। বদলের মন্ত্রটা তাকে দিয়ে দিতে হয়। তার প্রাণে গেঁথে দিতে হয়, তুমি এইভাবে বদলাও। আমাদের মায়েরা, স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা, সন্তানেরা চিরকাল খারাপ পথ থেকে প্রিয় মানুষটিকে ফেরানোর মন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে খুবই সহজ একটা অস্ত্র। ছেলে খারাপ কাজ করছে, খারাপ পথে চলছে, মা ছেলেকে শপথ করিয়েছেন, আমার মাথায় হাত দিয়ে বল, খারাপ কাজ তুই আর করবি না। খারাপ পথে তুই আর চলবি না।
মায়ের মাথায় হাত দিয়ে শপথ করা ছেলে খারাপ কাজটি আর করতে পারেনি। খারাপ পথে আর চলতে পারেনি। মায়ের সঙ্গে করা প্রতিজ্ঞা সে ভাঙবে না। ভাঙলে যদি মায়ের কোনো অনিষ্ট হয়? মায়ের মরা মুখ যদি দেখতে হয়?
প্রিয়তমা স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা নেশাভাঙ করা প্রিয় মানুষটিকেও ওই একই কায়দায় ফিরিয়েছে। প্রতিজ্ঞা করো আর নেশা করবে না। করলে আমার মরা মুখ দেখবে।
নেশার সোনালি জগৎ থেকে ফিরে এসেছে মানুষটি।
কিছুতেই সিগারেট ছাড়তে পারছে না সংসারের কর্তা। তার আদরের সন্তানটি বলল, তুমি সিগারেট না ছাড়লে আমি তোমার সামনে যাব না, তোমার সঙ্গে কথা বলব না। যদি আমার চেয়ে সিগারেট তোমার বেশি প্রিয় হয় তাহলে তুমি সিগারেট নিয়েই থাক।
ভদ্রলোক সিগারেট ছেড়ে দিলেন।
আমি এক ভদ্রলোককে চিনি। এমন একটা জায়গায় চাকরি করেন, প্রতিদিন ১০-২০ হাজার টাকা ঘুষ খাওয়া তাঁর জন্য কোনো ব্যাপারই না। ভদ্রলোক একটি পয়সাও ছুঁয়ে দেখেন না। বেতনের টাকায় অতিকষ্টে ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার চালান। তাঁর সহকর্মীরা সবাই বাড়িগাড়ি করে ফেলেছে।
ভদ্রলোক কেন ঘুষ খান না?
চাকরিতে ঢোকার আগে বাবা তাঁকে শপথ করিয়েছিলেন, কোনো দিন একটি পয়সাও ঘুষ খাবে না। সেই শপথ মেনে চলছেন তিনি। সত্যিকার শপথের এমন এক শক্তি থাকে, পৃথিবীর কোনো প্রলোভনই সেই শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠে না।
মানুষ বদলায় নিজের শপথে। অন্যকে বদলে দেয় তার ভেতরে শপথের শক্তি তৈরি করে। বিবেককে জাগ্রত করিয়ে।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মিষ্টি পছন্দ করতেন। মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস ছিল তাঁর। একদিন এক সাহাবি আসছেন তাঁর কাছে। হুজুর, আমার খুবই মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস। আমি মিষ্টি খাওয়া ছাড়তে চাই। আপনি আমাকে পথ দেখান।
মহানবী (সা.) বললেন, আপনি সাত দিন পর আসবেন। তখন আমি আপনাকে বলব কীভাবে মিষ্টি ছাড়বেন।
সাহাবি সাত দিন পর এলেন। মহানবী (সা.) তাঁকে পথ দেখালেন। আপনি যদি প্রতিদিন চারটি মিষ্টি খান, তাহলে আজ খাবেন তিনটি। কাল খাবেন দুটো। তারপর দিন একটি। এভাবে চেষ্টা করলে অল্প দিনের মধ্যেই আপনি মিষ্টি ছাড়তে পারবেন।
সাহাবি খুব খুশি। জি হুজুর। আমি এভাবেই চেষ্টা করব। কিন্তু হুজুর, এই পরামর্শ দেওয়ার জন্য আপনি সাত দিন সময় নিলেন কেন? কারণটা জানার খুব কৌতুহল হচ্ছে।
মহানবী (সা.) বললেন, আমার নিজেরও মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস ছিল। এই সাত দিনে সেই অভ্যাস আমি পরিত্যাগ করতে পেরেছি। নিজের অভ্যাস না বদলে সেই বিষয়ে আপনাকে আমি কী করে পরামর্শ দেব?
এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না। এই ঘটনার অর্থই হচ্ছে, বদলে যাও বদলে দাও। আগে নিজে বদলাও, তারপর অন্যকে বদলে দাও।
যেভাবে বেড়ে উঠি
জীবনের শুরুতে কারা আপনার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিলেন ?
জীবনের শুরুর প্রভাবটা ফেলেছিলেন আমার বাবা৷ বাবাকে আমি খুবই ভালোবাসতাম৷ সবসময় মনে হতো যে আমার বাবার মতো এরকম মানুষ বোধহয় আমার চারপাশে আর কেউ নেই৷ আমি বিক্রমপুর, গ্রামে নানীর কাছে থাকতাম৷ বাবা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন৷ আমাক দেখতে যেতেন৷ বাবা মারা গেলেন চুয়ালি শ বছর বয়সে একাত্তর সালে৷ তারপর প্রভাব ফেলেছিলেন আমার নানী৷ পরবতর্ীতে আমার মা৷ আরও অনেকেই৷
জীবনের কোন্ ঘটনা আপনার বিশ্বাস গঠনে প্রভাব ফেলেছে?
একাত্তর সালে আমার এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের জন্য পরীক্ষাটা পরের বছর হল৷ আমরা গেন্ডারিয়ায় থাকতাম৷ আর্থিক অবস্থা অসচ্ছল ছিল আমাদের৷ তার মধ্যে বাবা মারা গেলেন৷ আমরা একেবারেই অসহায় হয়ে গেলাম৷ একদিকে দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে৷ দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করছে মুক্তিযোদ্ধারা৷ অন্যদিকে আমার ‘মা’ এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে আরেক রকম একটা যুদ্ধ করছে৷
একদিন দুপুরে নির্জন বিশাল ধূপখোলা মাঠের এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালাম৷ মুক্তিযুদ্ধ চলছে৷ আর্মিদের ভয়ে অনেক মানুষ শহর ছেড়ে চলে গেছে৷ দেখলাম দেশটা যেন কেমন হয়ে গেছে৷ পুরো অঞ্চলটাই ফাঁকা হয়ে গেছে৷ আব্বার মৃতু্যর ফলে আমাদের সংসার বা জীবনটা যেন ফাঁকা হয়ে গেছে৷ কিন্তু এই নির্জনতা নিশ্চয়ই একদিন কেটে যাবে৷ নিশ্চয়ই আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব৷ পরিবারটিকে রক্ষা করতে পারব৷
আমি ওই নির্জনতার মধ্যে আবিষ্কার করলাম যে এই অসময় কেটে যাবে৷ সুসময়ে সামনে আসবে৷ নিশ্চয়ই জীবন অন্য রকম হবে৷ বাসায় ফিরে আসতে আসতে আমি আমার মনের একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম৷ খুব সচেতনভাবে৷ মুক্তিযুদ্ধ বাবার মৃতু্য এবং ওই নির্জনতা আমার বিশ্বাস গঠনে প্রভাব ফেলেছিল৷
জীবিত অথবা মৃত কোন ব্যক্তিকে আপনি বেশি পছন্দ করেন এবং কেন?
আমার বাবাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতাম৷ তারপর নানী এবং ‘মা’কে৷ তিনজনের ভূমিকা তিন রকম৷ আসলে প্রত্যেক মানুষের জীবনেই বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন রকমের ভূমিকা পালন করে৷ শুধু একজন মানুষের ভূমিকায় একজন মানুষের জীবন দাঁড়ায় না৷ জীবিতদের মধ্যে আমার স্ত্রী৷ আমার মেয়ে দুটির ভূমিকা অনেক৷ ওরা আমাকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করে৷
কোন কোন বই, কোন কোন লেখক আপনার বিশ্বাসকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে, কেন?
এই মুহূর্তে ‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে’ এই রবীন্দ্র সঙ্গীতটি৷ চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী৷ নাটক সেলিম আল-দীনের বিনোদিনী৷ উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ এবং তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি৷’
একটি গান, একটি চলচ্চিত্র, একটি নাটক, একটি বই অথবা তার অংশ বিশেষের উলে খ করুন- যা আপনি অন্যকে শুনতে, দেখতে বা পড়তে উত্সাহিত করবেন?
আমার স্ত্রীর, দুই কন্যা এবং আমার বন্ধুর৷ তার মধ্যে কেউ কেউ অত্যন্ত প্রিয়৷ সেই বন্ধুটির কাছে আমি নানা রকমভাবে কৃতজ্ঞ৷ আমাকে সে এ জায়গাটায় আসতে সাহায্য করেছে৷ তার প্রত্যেকটা মতামতই আমার কাছে গুরুপূর্ণ৷ আমার জীবনে তার বিশাল প্রভাব আছে৷ আমার পরিবারের যে রকম ভূমিকা, তার ভূমিকাও আমার জীবনের আমার পরিবারের চেয়ে কোন অংশে কম নয়৷ আমার, বন্ধুর এবং পরিবারের মতামতের ভিত্তিতেই একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি আমার, কাজটি করি৷
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে আপনি নিজের মত ছাড়া অন্য কার মতামতকে গুরুত্ব দেন?
প্রিয় উদ্ধৃতি ‘জীবন এত ছোট কেন?’ এবং রবীন্দ্রনাথর গানের মতো ‘জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ৷’ আমি মনে করি যে মানুষ যতদিন বেঁচে থাকবে, যতটা সময় বেঁচে থাকবে, সে যেন গভীর আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকে৷
আপনার পছন্দের প্রিয় উদ্ধৃতি কোনটি?
ব্যক্তির স্বাধীনতা ব্যক্তি নিজে কিছুটা অর্জন করে নেয়৷ রাষ্ট্র তাকে কিছুটা সহায়তা করে৷ আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণে ব্যক্তি স্বাধীনতা অনেক ক্ষেত্রেই খর্ব হয়৷ স্বাধীনতাটা মানুষ উপভোগ করতে পারে না৷ অথচ মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন৷ স্বাধীনভাবে চলার স্বাধীনতাটা মানুষের আছে৷
মানুষের মুক্তির পথটা হচ্ছে তার নিজের কাছে৷ একজন মানুষ যদি মনে করে যে, বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে, কর্মের মধ্য দিয়ে আমি আমার মুক্তির পথ খুঁজছি৷ স্বাধীনতার পথ খুঁজছি৷ মানুষ তার কাজের মধ্য দিয়ে তার মনের স্বাধীনতা তৈরি করে যতক্ষণ বেঁচে থাকবে ততক্ষণ সে মুক্তির স্বাদ পাবে৷ বেঁচে থাকার স্বাদ পাবে৷
আপনার মতে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্তির পথে সবচেয়ে বড় বাধা কোনটি?
আমার নিজে আইন প্রণয়ন করার মতো সাধ্য, যোগ্যতা নেই৷ দেশের যে প্রচলিত আইন আছে সেগুলো মানুষের কল্যাণের জন্য তৈরি করা হয়েছে৷ আমরা যদি সে আইনগুলো মেনে চলি তাহলে দেশ একটি কল্যাণমুখী দেশ হবে৷ মানুষ কল্যাণকর জীবনের দিকে যেতে পারবে৷ দেশের প্রচলিত আইনগুলোর প্রতি আমি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল৷ আমি চাই প্রচলিত আইনগুলো দেশের মানুষও মেনে চলুক৷
আপনি যদি একজন আইনপ্রণেতা হতেন তাহলে সবার আগে কোন আইনটি প্রণয়ন করতেন?
প্রথমতো জন্ম শাসনটা করা উচিত্ গভীরভাবে৷ আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধিটা আমাদের চূড়ান্ত ক্ষতির দিকে নিয়ে যাবে! মানুষের স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষাটা অত্যন্ত জরুরি৷ এই তিনটি কাজ যদি আমরা করতে পারি তাহলে দেশটিকে আমরা একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারব৷ আমরা যদি আমাদের এক কোটি মানুষকে বিভিন্ন কাজের জন্য ট্রেন্ড করে বিদেশে পাঠাতে পারি তাহলে এ দেশের চেহারাটা ঘুরে যাবে৷
আপনার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় বছর কোনটি? কেন সেটা স্মরণীয়?
১৯৭১ সাল৷ সে বছর মুক্তিযুদ্ধ হল৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হল৷ সে বছরেই আমি বাবাকে হারালাম এবং এক দুপুরে, আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম যে, আমাকে এখন থেকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনটার দিকে তাকাতে হবে৷ নিজের জীবনটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে চাই৷ এই সিদ্ধান্তটার কারণে, দেশের স্বাধীনতার কারণে, বাবার মৃতু্যর কারণে_ সব মিলিয়ে ১৯৭১ আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্মরণীয় বছর৷
আপনার জীবনদর্শন কি? সংক্ষেপে বলুন৷
আমার জীবনদর্শন হচ্ছে আমি মানুষ ভালোবাসি৷ মানুষের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, স্নেহ, মমত্ববোধ আছে৷ অর্থাত্ যতগুলো মৌলিক বিষয় মানুষের মধ্যে থাকে মানুষ সংক্রান্ত, আমি সেই বিষয়গুলো মানুষের উপর প্রয়োগ করি৷ আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে জয় করতে চাই৷ মানুষকে ভালো রাখতে চাই৷
সকালবেলার আলো
রবিকে দেখে আমার খুব ভালো লাগল।
উঠোনের কোণে মাঝারি সাইজের মাদুর বিছিয়েছে। মাদুরের ওপর রেখেছে একটা জলচৌকি। জলচৌকিতে বই রেখে দুলে দুলে পড়ছে। মাদুরে বেশ গুছিয়ে রাখা তার অন্যান্য বই-খাতা। সকালবেলার রোদ পড়েছে রবির পিঠের দিকে।
নভেম্বর মাস। গ্রাম এলাকায় বেশ শীত। রবিদের বাড়ির পশ্চিম দিকে বিশাল পুকুর। পুকুরের ওপার থেকে শুরু হয়েছে শস্যের মাঠ। কিছুক্ষণ আগেও চারদিকে ছড়িয়ে ছিল ধোঁয়ার মতো হালকা কুয়াশা। রোদ ওঠার ফলে কুয়াশা কাটতে শুরু করেছে।
রবি আমার মামাতো ভাইয়ের ছেলে। দুই দিন আগে তার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এবার ক্লাস টেনে উঠবে। পরীক্ষার দুই দিন পর অনেক ছেলেমেয়েই বই নিয়ে বসে না। রেস্ট নেয়, খেলাধুলা করে, বেড়াতে যায়। অনেকে অযথাই ঘুরে বেড়ায়, ঘুমায়। রবি একেবারেই সে রকম না।
গতকাল বিকেলে আমি এ বাড়িতে এসেছি। গ্রামে এলে শৈশব-কৈশোরের অনেক কথা মনে পড়ে। অনেক স্নৃতি, অনেক ভালো লাগা, অনেক দৃশ্য ভেসে ওঠে চোখে। শীতের সকালে উঠোনের রোদে মাদুর বিছিয়ে, মাদুরের ওপর জলচৌকি নিয়ে পড়তে বসা রবির মতো করে আমিও তো বসেছি একদিন।
হাঁটতে হাঁটতে রবির কাছে গিয়েছি। পড়তে পড়তে রবি এক পলক আমার দিকে তাকাল, মিষ্টি করে হাসল কিন্তু কথা বলল না। বিড়বিড় করে পড়া মুখস্থ করছে। রবির পাশে বসে আমি তার বইপত্র ঘাঁটতে লাগলাম। মাধ্যমিক সাধারণ বিজ্ঞান বইটা হাতে নিয়েছি। নরম ধরনের কাগজে ছাপা বই। কাভার ছিঁড়ে গেছে, পেছন দিককার কয়েকটা পৃষ্ঠা খুলে গেছে। মোটা সুতো দিয়ে এই বই সেলাই করে নিয়েছে রবি। কারণ, বইটা তাকে আরও এক বছর দু-তিন মাস পড়তে হবে। তত দিনে বইটির যে কী অবস্থা হবে! যে বই যত বেশি পড়া হয় সেই বই তত বেশি নড়বড়ে হয়। সাধারণ বিজ্ঞান বইটির অনেক চ্যাপ্টারের অনেক লাইন মার্কার দিয়ে দাগিয়ে রেখেছে রবি। আমাদের ছেলেবেলায় মার্কারের নামই আমরা শুনিনি। ইমপরট্যান্ট লাইনের তলায় কাঠপেনসিল দিয়ে দাগ দিয়ে রাখতাম। আমাদের সময়ের সঙ্গে রবিদের সময়ের কত ব্যবধান!
রবির সাধারণ বিজ্ঞান বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎই মনে হলো মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রমে এইচআইভি এইডস বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেখি তো কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হচ্ছে। ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘দুরারোগ্য রোগ’ শিরোনামে শুরু হয়েছে বিষয়টি। বেশ সহজ-সরল ভঙ্গিতেই লেখা হয়েছে। ১৬ নম্বর পৃষ্ঠার পর বাকি অংশ জাম্প করে গেছে ২৫৭ নম্বর পৃষ্ঠায়। কেন, বুঝতেই পারলাম না। [পুনর্মুদ্রণ: ডিসেম্বর ২০০৬] যা-ই হোক, এ চ্যাপ্টারেও অনেক লাইন মার্কার দিয়ে দাগিয়ে রেখেছে রবি। যেমন, “এইচআইভি এইডস প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ‘না’ বলা একটি বড় কৌশল। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা প্রায়ই আবেগ দ্বারা চালিত হয়, যুক্তি দ্বারা নয়। জীবনের সমস্যা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে অনেক সময় অনেককেই ‘না’ বলার প্রয়োজন হয় এবং নিজমত প্রতিষ্ঠা করতে হয়, যা অল্প বয়সীদের জন্য অত্যন্ত কঠিন কাজ।
এমন হতে পারে যে একজন শিক্ষার্থী তার সহপাঠী বা প্রিয়বন্ধুর একটি প্রস্তাব পেল, যা তাকে যৌন আচরণ করতে প্ররোচিত অথবা মাদকে আসক্ত হতে প্রভাবিত করতে পারে। শিক্ষার্থী কিছুতেই এই প্রস্তাব মানতে চায় না। এমন ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে ‘না’ বলতেই হবে। একবার এবং বারবার। সহপাঠী বন্ধুটি এবং অন্যরা তাকে জোর করতে পারে। এ ক্ষেত্রে দৃঢ়চেতা হতে হবে।”
তারপর আমি বিষয়টি নিয়ে রবির সঙ্গে কিছু কথা বললাম। রবি, এই লাইনগুলো কি তুমি দাগিয়ে রেখেছ, নাকি তোমার টিচার বলেছেন?
রবি হাসল। আমিই দাগিয়েছি। বিজ্ঞান স্যার তো এই চ্যাপ্টারটা পড়ানই না।
কেন, পড়ান না কেন? এই চ্যাপ্টার থেকে প্রশ্ন আসে না?
হ্যাঁ আসে। কিন্তু স্যার পড়ান না। আমাদের বলে দিয়েছেন, এই চ্যাপ্টারটা তোমরা নিজেরা পড়ে নেবে!
কারণ কী?
তা জানি না।
আমার তারপর ইচ্ছে হলো রবিদের বিজ্ঞান টিচারের সঙ্গে কথা বলি। রবিকে বললাম, তোমাদের বিজ্ঞান টিচারের সঙ্গে কথা বলা যাবে রবি?
বলা যাবে। বিজ্ঞান স্যারের বাড়ি আমাদের গ্রামেই। আমি তোমাকে স্যারের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি।
বিকেলবেলা রবির সঙ্গে তার বিজ্ঞান স্যারের বাড়িতে গেলাম। ভদ্রলোকের নাম নজরুল ইসলাম। মধ্যবয়সী বিনয়ী ধরনের মানুষ। আমার পরিচয় পেয়ে তিনি একটু ব্যস্তই হলেন। এ কথা সে কথার পর আসল প্রসঙ্গটা তুললাম। ‘স্যার, শুনলাম রবিদের বিজ্ঞান বইয়ের প্রতিটি চ্যাপ্টারই আপনি পড়ান শুধু এইচআইভি এইডস চ্যাপ্টারটা পড়ান না। কারণ কী বলুন তো?’
এইচআইভি এইডস শব্দটি শুনেই ভদ্রলোকের চেহারা কেমন পাল্টে গেল। যেন খুবই অশোভন, অশ্লীল কোনো শব্দ তিনি শুনছেন এমনভাবে একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন, তারপর মুখ নিচু করে বললেন, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের এসব পড়ানো যায় নাকি, বলুন? কেন যে পাঠ্য বইয়ে এসব ছাপা হয়? ক্লাস সিক্সের বই থেকেই শুরু হয়েছে। এসব জানা উচিত প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর।
ভদ্রলোকের কথাবার্তা শুনে আমি বিস্িনত। কী বলছেন স্যার? আজকের পৃথিবী ভয়ঙ্করভাবে আক্রান্ত হচ্ছে এইচআইভি এইডসে। পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ আছে ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। ১৫ থেকে ২৫ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এইচআইভি এইডস আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। সারা পৃথিবী এ বিষয়টি নিয়ে সচেতন। পৃথিবীজুড়ে প্রচার-প্রচারণা চলছে, এ বিষয়ে মানুষকে শিক্ষিত এবং সচেতন করার কাজ চলছে। ক্লাস সিক্স থেকে পাঠ্যপুস্তকে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কিশোর বয়স থেকেই ছেলেমেয়েরা যাতে বিষয়টি নিয়ে ভাবে, জানে এবং সচেতন হয়। আপনি নিশ্চয় জানেন, এইডস এক ভয়ঙ্কর ব্যাধি। এইডস প্রতিরোধের জন্য সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ, শিক্ষক মানুষ, আপনার দায়িত্ব হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের বিষয়টি নিয়ে সচেতন করা। ছাত্রছাত্রীদের কাছে শিক্ষকদের কথা বেদবাক্যের মতো। আপনিই যদি বিষয়টি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকেন, তাহলে?
ভদ্রলোকে ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর নড়েচড়ে উঠলেন। ঠিকই তো বলেছেন! আমি তো এত দিন ভুল ধারণা নিয়ে ছিলাম। আমার মতো অনেক শিক্ষকই এ রকম ভুল ধারণা নিয়ে আছেন। এ ধারণা ভাঙতে হবে। শুধু ছাত্রছাত্রী কেন, সমাজের প্রতিটি স্তরের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে এইচআইভি এইডস নিয়ে কথা বলতে হবে। রোগটির ভয়াবহতা তুলে ধরতে হবে, মানুষকে সচেতন করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে যত কথা বলা হবে ততই মানুষ জানবে, ততই সচেতন হবে। এত সহজে ভদ্রলোককে বোঝাতে পেরেছি ভেবে আমার খুব ভালো লাগল।
রবিদের বাড়ির পাশে মসজিদ। মসজিদের ইমাম হাফিজুল ইসলাম সাহেবের বয়স চল্লিশের কোঠায়। মানুষটিকে দেখলেই ভালো লাগে। সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগে আছে। আমার খুব ইচ্ছে হলো ইমাম সাহেবের সঙ্গে একটু কথা বলি। এইচআইভি এইডস বিষয়টিকে তিনি কীভাবে দেখছেন একটু বোঝার চেষ্টা করি। আবার একটু ভয়ও লাগল। এসব নিয়ে কথা বললে তিনি আবার কিছু মনে করেন কি না!
আশ্চর্য ব্যাপার, ইমাম সাহেবকে দেখলাম এইচআইভি এইডস নিয়ে বেশ ভালো খোঁজখবর রাখেন। অনেকক্ষণ ধরে বিষয়টি নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বললেন। ধর্মীয় অনুশাসনের কথা বললেন, মানুষকে সচেতন করার কথা বললেন। জুমার নামাজের আগে খুতবার সময় তিনি নিয়মিত এইচআইভি এইডস নিয়ে কথা বলেন। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির কাজটি করেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। তাঁর সচেতনতা সৃষ্টির একটি পদ্ধতি আমার খুব ভালো লাগল। তিনি প্রত্যেক মানুষকে বলে দিচ্ছেন, আপনার চারপাশের প্রতিটি পরিচিত মানুষকে এইচআইভি এইডস সম্পর্কে সচেতন করুন এবং প্রত্যেককে বলে দিন, তারা যেন প্রত্যেকে অন্তত একজন মানুষকে সচেতন করে এবং সেই মানুষকে অনুরোধ করে তার পরিচিত আরেকজনকে সচেতন করতে। এভাবে একজন থেকে আরেকজনে, আরেকজন থেকে আরেকজনে ছড়িয়ে যাবে সচেতনতা। এ পদ্ধতিতে এগোলে অতি অল্পসময়ের মধ্যে দেখা যাবে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ এইচআইভি এইডস সম্পর্কে জানছে এবং সচেতন হচ্ছে। জাতি সচেতন হলে এই ভয়ঙ্কর ব্যাধি কিছুতেই আমাদের আক্রমণ করতে পারবে না।
ইমাম সাহেবের কথা শুনে আমি মুগ্ধ। বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষকদের কথা শোনে, বাংলাদেশের মানুষ ইমাম সাহেবদের কথা শোনে। এই দুই শ্রেণীর শ্রদ্ধেয়জনেরা যদি এইচআইভি এইডস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার ব্রত গ্রহণ করেন, তাহলে সকালবেলার আলোয় যেভাবে কেটে যায় শীতের কুয়াশা, ঠিক সেভাবে আমাদের চারপাশ থেকে কেটে যাবে যাবতীয় অকল্যাণের ছায়া।