একবার হঠাৎ ইচ্ছে হলো বাঁশের বাঁশি বাজানো শিখব। সুর যে কীভাবে আমাকে টানে আমি জানি না। অনেক কষ্টে বাশি জোগাড় করলাম। বরগুনার মনোয়ার ভাই, মিঠুদা এদের কাছে বাঁশি বাজানো শিখতে শুরু করলাম। সেকি প্রাণান্ত চেষ্টা। আমার দাদা দেখেছে। কিন্তু আব্বা দেখেনি। কারণ আব্বা বাসায় থাকলে জীবনেও এ চেষ্টা আমি চালাইনি। কারণ বাঁশ আমার পিঠ ভেদ করে সুর হয়ে যেত। রক্তাক্ত সুর। আমার মা ‘নো প্রবলেম’ যত কিছুই করি কোনো কিছুই বলে না। শুধু বলত পড়াশোনাটা ঠিকমতো করো কারণ তাদের আশা আমি অনেক বড় ডাক্তার হব। কেননা আমি সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করি। আমার সায়েন্স যে কী সেটা তো কেবল আমিই জানতাম। সুর, গান, নাটক, কবিতা এই সায়েন্স ছাড়া কোনো কিছুই মাথায় ঢোকে না। আমি প্রতিদিন সকাল বিকাল চান্স পেলেই বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছি। ভাবখানা এমন আমার বাঁশির সুরে অনেক মেয়ে পাগল হয়ে আমার পেছনে ঘুরবে। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো অনেক ইঁদুর আমার পেছনে দৌড়াবে। আমার কত ভাব হবে। যাই হোক আমার দাদা একদিন এমন এক আশীর্বাদ দিলেন আমি ভড়কে গেলাম। দাদা বললেন, ‘তুমি যা বাজাইন্যার চেষ্টা করতে আছো হেইডা না বাজাইয়া চুঙ্গা ফুয়া। তাইলে তোর মার কষ্ট কোমবে। চুলায় ধারে যাইয়া চুঙ্গা ফুয়া।’
বাঁশি বাজানোর সমস্ত আশা-ভরসা মাটিতে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। অনেক কষ্টে আমি বাঁশি বাজানোর চেষ্টা কমিয়ে দিলাম। ওভাবে ফুঁ ফা করতাম না কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে চেষ্টা করতাম।
আজ আমার দাদা বেঁচে নেই। আমার অভিনয় তিনি দেখেননি। আমার টুকটাক বাঁশি বাজানোও তিনি দেখেননি। দেখতে পারলে আমার আজ অনেক ভালো লাগত। আনন্দে হয়তো চোখ ভিজে যেত। জীবনে প্রথম ঢাকায় যখন আসি বয়স তখন ৬/৭। দাদার হাত ধরেই এসেছিলাম। আরিচা ফেরিতে বসে দাদা আমাকে ৮টা ডিম খাইয়ে ছিলেন। ডাব খেয়েছি ৩/৪টা। যা খেতে চেয়েছি দাদা সব খাইয়েছেন। আরিচা ঘাট পার হলেই দাদার কথা মনে পড়ে। শিশুপার্কের সামনে গেলে দাদাকে মনে পড়ে। আজ আমার দাদা বেঁচে থাকলে তাকে নিয়ে গাড়িতে চড়ে ঘুরতে পারতাম। তার অজানা অনেক জায়গায় আমি নিয়ে যেতে পারতাম। তিনি যা খেতে চাইতেন তাই খাওয়াতাম। আসলে জীবন এটাই- যা ভাবি তা হয় না, যা ভাবি না তাই হয়।
আমার প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে ঠিক করলাম মালয়েশিয়া যাব। গেলাম মালয়েশিয়া। প্রায় ১৪ দিন আমরা ঘুরব বলে ঠিক করলাম। সময়মতো আমরা গেলাম, অনেক মজা করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলাম। কুয়ালালামপুর, বোনাং, লাংকাউ এরকম কয়েকটি জায়গায় আমরা ঘুরলাম। লাংকাউতে আমার অনেক ভালো লাগল কারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এত সুন্দর হতে পারে চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। অনেক বাংলাদেশী মানুষের সাথে দেখা হলো, কথা হলো। আমরা অজানা অচেনা অনেক মানুষের সাথে কথা বললাম। দাওয়াত খেলাম। বিদেশে বসে দেশী মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম আমরা। আমার বউ আমাকে বলল, নাটক করে যে অনেক মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায় সেটা তোমার সাথে ঘুরতে না আসলে বুঝতাম না। অপরিচিত জায়গা অনেক পরিচিত হয়ে গেল দেশী মানুষের সহযোগিতায়। বাসে ঘুরলাম, ট্রেনে ঘুরলাম, কত কম টাকায় যা এই সহযোগিতা ছাড়া হতো না। একদিন আমরা কয়েকটি দ্বীপ ঘোরার জন্য মনস্থির করলাম। ৫ ঘণ্টার ঘোরাঘুরি। প্রতিটি দ্বীপে ঘুরেফিরে বিশ্রাম নিয়ে বেশ মজাতেই দিনটা কাটছিল। সুন্দর একটা দ্বীপে ঘুরছি, তখন চুমকি বলল চলো কোক খাই। দ্বীপের মাঝখানে ছোট্ট একটি দোকান। সবাই ভিড় করে খাবার দাবার কিনছে। আমরাও কোক কিনে যখন দাম দিতে যাব তখন তামিল চেহারার একজন মানুষ যিনি বিক্রি করছিলেন তিনি টাকাটা না নিয়ে ইশারায় বললেন একটা জায়গায় গিয়ে বসতে। একটু অবাকই হলাম। সবাই টাকা দিচ্ছে লোকটি নিচ্ছে কিন্তু আমরা দিলাম আমাদেরটা নিল না। আমরা কি কোনো অপরাধ করলাম?
কিছুক্ষণ পর লোকটি এলো। অবাক বিস্ময় নিয়ে লোকটির দিকে তাকালাম কারণ লোকটি বাংলায় আমাদেরকে বলল, সাব্বির ভাই কেমন আছেন? আমরা অবাক হলাম, বিস্মিত হলাম কারণ লোকটি অবিকল শ্রীলংকানদের মতো দেখতে। ১০ মিনিটের মাথায় লোকটির সাথে খুব খাতির হলো এবং তিনি বললেন, দেশী মানুষের কাছ থেকে কী করে টাকা নেই বলেন? আপনিতো অতিথি। আমি একটু লজ্জাই পেলাম কারণ লোকটি অনেক বিনয়ী, ভদ্র এবং আবেগপ্রবণ। লোকটিকে বললাম, ভাই দেশে যাবেন কবে? বলল যেতে তো চাই কিন্তু অনেক খরচ। সবাই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে আমার তো অনেক টাকা। কিন্তু এই দেশে অনেক খরচ। দেশে ২ মাস অন্তর টাকা পাঠাই। একবার ঘুরতে গেলে অনেক খরচ হয়। ৫ বছর হয় দেশে যাই না। তারপর যে ঘটনাটি ঘটল সেটি একদমই অপ্রত্যাশিত। লোকটি হাউমাউ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। বলল, ভাই মাকে খুব মনে পড়ে। কতদিন মাকে দেখি না। আমাকে জড়িয়ে ধরল। তখন আমার চোখ জলে ভিজে উঠল। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। আড়চোখে দেখি চুমকি ওর আইলেশ ঠিক করছে। আমি ভাবি, ও কি আসলে আইলেশ ঠিক করছিল নাকি আমার মতোই চোখের পানি সরিয়ে দিচ্ছিল? প্রশ্নটা কোনোদিন ওকে করিনি।
লাংকাউয়ের একটা ছোট্ট দ্বীপ সেদিনের সেই স্মৃতি আজও আমাকে ভাবায়। মনে করিয়ে দেয় অজানা অচেনা জায়গায় একজন মানুষের সাথে পরিচয়ের পরও লোকটিকে অচেনা মনে হয়নি। মানুষ পৃথিবীতে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি যে কাজটি পারে সেটা হলো ভুলে যেতে। আমিও ভুলে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। কারণ মাকে ভুলে যাওয়া যায় না। অচেনা অনেক মানুষের ভিড়ে একজন মানুষকে ঠিকই চেনা যায়। মাকে চেনা যায়। আমি লেখার শুরুতে বলেছিলাম মৃত্যুর ১ দিন পর যদি বিধাতা ৫ মিনিট সময় দিত তাহলে কত মজা হতো? আমি মজা করতে চাই না আমি ৫ মিনিট কথা বলতে চাই। আমার মায়ের সাথে কথা বলতে চাই।