প্রথম যেদিন প্লেনে উঠলাম সেদিনও মনে হলো আমার বোধহয় শেষ। একবার যদি পাখায় আগুন লাগে তাহলে কী হবে? আমার আব্বা, আম্মু, ভাইবোন কারও সাথে কোনো কথা হলো না। কিন্তু ভাগ্য ভালো কিছুই হয়নি।
প্লেনে বসে যখন জানালা দিয়ে তাকালাম দেখি সাদা মেঘের ভেলা। কী অদ্ভুত কী সুন্দর সে দৃশ্য। মনে হতে লাগল একটু লাফ দিয়ে জায়গাটা যদি দেখে আসতে পারতাম? কিন্তু পারলাম না। মনে মনে ভাবি পাখি হলেই বোধহয় ভালো হতো। উড়ে উড়ে ভেসে যেতাম মেঘের দেশে। একটু সময় থেকে আবার চলে আসতাম নিজের বাড়িতে।
আমার শৈশব-কৈশোর সব কেটেছে বরগুনাতে। আমি প্রায়ই সেখানে যাই। খুব বেশি ঘোরাঘুরি করি না। কিছু বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেই আর বিকেল হলে নদীর পাড়ে ঘুরতে যাই। আমার ভীষণ ভালো লাগে। ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে আমার বউকে নিয়ে দু’বার গিয়েছি বিয়ের পর। আর বউ ছাড়া তিনবার। আমাকে আমার বউ জিজ্ঞেস করে আচ্ছা এই যে বরগুনাতে যাও বাবা, মা, ভাইবোন কেউ থাকে না। একা গিয়ে কী মজা পাও? আমি মুচকি হাসি দিয়ে চলে যাই, উত্তর দেই না। মনে মনে বলি ‘শেকড় বড় মারাত্মক’। এর টানে সব ভুলে যাই। আমি শিকড়ের টানে বরগুনাতে যাই। আমার বাচ্চা হবার পর এখনো ওকে নিয়ে যেতে পারিনি। আমি না যেতে পারলেও আমার বাচ্চা একদিন ঠিকই যাবে। কারণ শেকড় বড় বিস্ময়কর মায়া। আমি ঘ্রাণ নেই আমার হেঁটে যাওয়া সব রাস্তার ঘাসের উপর আমি মজা করে দেখি আমার প্রিয় সব জায়গাগুলো। বাতাসের কি অদ্ভুত চেনা ঘ্রাণ আমি পাই। সে ঘ্রাণ অনেক দামি ফরাসি পারফিউম-এ আমি পাই না। আমার বউকে এ কথাটি কে বোঝাবে বলুন? শুধু একটি কথা বলেছি- তোমার গ্রামে যখন যাও কেমন লাগে? একটু চোরা দৃষ্টি দিয়ে বলে ভালোই। আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়ে যাই।
একবার শমী কায়সার বরগুনাতে বেড়াতে গেলেন। খেলাঘর আসরের সম্মেলন উপলক্ষে। সম্ভবত ৮৯/৯০-এর দিকে। ‘যত দূরে যাই’ খ্যাত শমী কায়সার বরগুনাতে আসবেন, এক ধরনের উৎসব আমেজ। উনি লঞ্চে করে আসছেন। আমরা বিকেল ৩টা থেকে অপেক্ষা করছি শমী কায়সারকে দেখব বলে। দীর্ঘ লাইন হলো। পান্না কায়সার এবং শমী কায়সারকে ফুল ছেটানোর জন্য। আমি অনেক গাঁদা ফুলের পাপড়ি হাতের মুঠোয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। যাই হোক তারা পৌঁছানোর পর শমী কায়সারের ভক্তকুল তাকে একনজর দেখার জন্য পাগল হয়ে গেল। তাকে উৎসুক জনতার মাঝখান থেকে আমিও উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলাম। তারা বরগুনাতে ২ দিন ছিলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন। ঘুরলেন ফিরলেন এবং অবশেষে ঢাকায় ফিরে গেলেন।
কিন্তু আমার মনে শমী কায়সার হয়ে রইলেন স্বপ্নের দেবী। উনি চলে আসার পর আমি শয়নে-স্বপনে শমী কায়সারকে দেখি। তার ভিউকার্ড জোগাড় করি, তার নাটক থাকলে সন্ধ্যার পড়াশোনা বন্ধ করি। মোটামুটি উন্মাদ হয়ে গেলাম। খেলাঘরের সেক্রেটারি চিত্তদার কাছ থেকে পান্না কায়সারের বাসার ঠিকানা জোগাড় করলাম। তারপর যেটা করলাম সেটা একেবারেই সিনেমা। চার পাতার একটি চিঠি লিখলাম শমী কায়সারকে। শুরুটা ছিল এমন-
শ্রদ্ধেয় শমী আপু, পত্রে আমার সালাম নিবেন। আশাকরি আম্মুকে নিয়ে ভালোই আছেন। আমার নাম সাব্বির। ঐ যে টাউন হলের নিচে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে কথা হয়েছিল। আমার গায়ে নীল রঙের শার্ট পরা ছিল। আপনি বলছিলেন ঢাকায় এসে যোগাযোগ করতে…
শেষটা যতদূর মনে পড়ে…
আপু আমি আপনার ছোট ভাই। যদি আমাকে আপনি ছোটভাই হিসেবে গ্রহণ করেন তাহলে ১ পাতার একটা চিঠির উত্তর দিয়েন। আমি সারাজীবন আপনার কথা মনে রাখব। আমি আপনার উত্তরের আশায় আগামী তিনদিন পর থেকে পোস্ট অফিসে যোগাযোগ করতে শুরু করব। ইতি আপনার প্রাণপ্রিয় ছোটভাই খেলাঘরের বন্ধু সাব্বির।
এরপর থেকে স্কুলে যাওয়া আসার পথে আমাদের পোস্ট অফিসে পোস্টমাস্টার কালাম ভাইকে বললাম ঢাকা থেকে শমী কায়সারের চিঠি আসবে। আমি বাসায় না থাকলে আপনার কাছে রেখে দিয়েন। বাসার মুরব্বিদের কাছে আবার দিয়েন না, একটু সমস্যা আছে। কালাম ভাই বলল ঠিক আছে। দিন যায় মাস যায় বছর যায় ইস্কাটন থেকে কোনো চিঠি আর আসেনি। শমী কায়সার বুকের গহীনেই রয়ে গেল। মাঝে মাঝে এখনও ভাবি শমী কায়সার যদি ২ লাইনের কোনো একটি চিঠিও দিত খুব ভালো লাগত।
কত চেনা কত কাছের একজন মানুষ শমী কায়সার। কতবার তার সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে কিন্তু কথাগুলো বলা হয়নি। চেনা মানুষ আপন মানুষ অথচ অচেনা কত দূরের। মাঝে মাঝে ভাবি একটা নাটকে যদি একসাথে কাজ করতে পারতাম? তাহলে ২০ বছর পর আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে আনন্দ আলোতে আর একটা লেখা লিখতে পারতাম।
সবাই বলে জীবন খুব অল্প সময়ের। এই এক জীবনে দেখার কত কী আছে। আবার অনেকে বলে কিছুই দেখতে পারলাম না। কত কিছুই করার ছিল? শুধু পাওয়া আর না পাওয়ার দোলাচল। আমি বাস্তববাদী, আবার অনেকটা স্মৃতিকাতর। চলার পথে কত স্মৃতি যে মাথায় ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। ভাবি যেটা মনে পড়বে সেটাই লিখে ফেলব। অনেক উদ্যম, অনেক উৎসাহ নিয়ে ভাবি কিছু একটা করব। কিন্তু কিসের কি? সব ভুলে যাই। জীবন বোধহয় এমনই, ভুলে যাওয়া আবার মনে পড়া।
যেমন এখন আমার খুব দাদা-দাদীর কথা মনে পড়ছে। আমার বটগাছ ছিল আমার দাদা দাদী। কত মার যে খেয়েছি আমার বাবার। সব দাদা উদ্ধার করত। এমনও হয়েছে দাদা পারলে আমার আব্বাকে মারে। আমার আব্বার অনেক রাগ ছিল। এখন নেই। এখন মাঝে মাঝে আব্বাকে দেখে মনে হয় আমার দাদা। আমার ছেলেকে আমি মারব না কখনও কিন্তু আমার বাবা কেন জানি মনে হয় আমার সন্তানকে সবসময় আগলে রাখবে, উদ্ধার করবে ভালোবাসা দিয়ে। দান প্রতিদানের মতো।