এইসব লেখককে দাদুভাই সেদিন হাজির করেছিলেন আমাদের মতো যারা লেখালেখিতে আগ্রহী তাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য। সাহিত্য নিয়ে তাঁদের চিন্তা ভাবনা, তাঁদের পড়াশোনা কিংবা কীভাবে লেখালেখি করেন তাঁরা, তাঁদের মুখ থেকে এসব শোনাবার জন্য।
পাঁচজনের একজন মুনা মালতি। অসাধারণ সুন্দরী। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্সে পড়ে। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। ছোটদের লেখায় চমৎকার হাত। রেডিও টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করে। এত সুন্দর করে কথা বলল! মুনা কথা বলবার সময় কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। পিন পড়লে শব্দ হবে না, এমন নিঃশব্দ।
মুনার সঙ্গে সেদিনই রহমান আমার পরিচয় করিয়ে দিল। কিন্তু মুনা আমাকে তেমন পাত্তা দিল না। পাত্তা দেয়ার কোনও কারণও নেই। আমি তখন কে? অবশ্য সুন্দরী মেয়েদের একটা ভাবও থাকে। পরিচয়ের মুহূর্তে অনেকের দিকেই তারা এমন করে তাকায়, যেন খুবই দয়া করে তাকাচ্ছে।
মুনার সেদিনকার তাকানো অনেকটাই ওরকম।
ডালাসে গিয়েছি ফোবানা সম্মেলনে। ওই যে জুবায়েরের ওখানে যেবার দশদিন থাকলাম, সেবারের কথা। মুনা মালতির সঙ্গে দেখা হলো। সে আমেরিকাতেই থাকে। কোন স্টেটে থাকে মনে করতে পারছি না। আমেরিকার কোনো এক ইউনিভার্সিটির টিচার মুনা। মাইক্রোটেল ইন নামে এক হোটেলে উঠেছে। আমিও সেই হোটেলেই উঠেছি। পরে জুবায়ের আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। ওই হোটেল লাউঞ্জে বসে এক দুপুরে মুনার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়েছিলাম। প্রথম দিন মুনাকে দেখার স্মৃতিচারণ করলাম। মুনা যে আমার দিকে তাকায়নি বা পাত্তা দেয়নি, শুনে মুনা এত হাসলো!
বন্ধুদের মিষ্টি হাসির রেশ সবসময় আমার কানে লেগে থাকে। মুনার হাসির রেশও লেগে আছে।
যে মানুষটি আমাকে সেদিন সবচাইতে বেশি মুগ্ধ করেছিল তাঁর নাম আলী ইমাম। এত সুন্দর বক্তৃতা সেদিন দিলেন আলী ইমাম। শুধু আমাকে কেন, সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেললেন। আলী ইমাম লেখেন ভালো, তখন থেকেই ছোটদের খুবই প্রিয় লেখক তিনি। লেখা পড়ে আমিও তাঁর ভক্ত। সেদিন কথা শুনেও ভক্ত হয়ে গেলাম। যে মানুষ এত সুন্দর লেখেন সেই মানুষ এত সুন্দর কথাও বলেন!
বক্তৃতা শেষ করে বসতে পারেন না আলী ইমাম, ছেলেমেয়েরা ঝাঁপিয়ে পড়ল অটোগ্রাফের জন্য।
সেই প্রথম একজন লেখককে অটোগ্রাফ দিতে দেখলাম আমি।
আলী ইমামের ডাকনাম হেলাল। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আমার হেলাল ভাই হয়ে গেলেন। এখনও আমি তাঁকে হেলাল ভাই বলেই ডাকি।
ঠাঁটারি বাজারে হেলাল ভাইদের বাড়ি। অন্য একটি দিক দিয়েও তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। আমার বাবা চাকরি করতেন ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে। বাবা মারা গেছেন একাত্তর সালে। বাবাকে খুবই ভালো চিনতেন হেলাল ভাইয়ের বাবা। কারণ তিনিও মিউনিসিপ্যালিটিতে চাকরি করেন। বাবার জায়গায় চাকরি হয়েছে আমার বড়ভাইয়ের। হেলাল ভাইয়ের বাবা আমার বড়ভাইকেও চেনেন।
আমার সঙ্গেও একদিন পরিচয় হয়ে গেল।
শেকড়ের টান মীর সাব্বির
আমি এ লেখাটা যখন লিখতে শুরু করি তখন একটা নাটকে অন্ধের চরিত্রে অভিনয় করছিলাম। জীবনে প্রথম এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করছি। অন্ধ মানুষ কেমন হয় আমি জানি না। তারা কীভাবে কথা বলে, কীভাবে অনুভূতিগুলো শেয়ার করে কোনো ধারণাই আমার ছিল না। কিন্তু দীর্ঘসময় চোখ বন্ধ করে শুধু ফিল করার চেষ্টা করেছি। আমি দেখলাম সবকিছুই কেমন অন্ধকার আর সেই অন্ধকারের মাঝেই কেমন অদ্ভুত চিকচিক করছে আলো। আমি চোখ খুলে ফেলি। পাঁচ মিনিট অন্ধকার সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। মনে মনে ভাবলাম, অন্ধকার আসলে কী? অন্ধকারেই কী আলো থাকে? বিশ্বাস থেকে একটা জায়গায় নিজেকে স্থির করলাম সেটা হলো ‘চেনা পৃথিবীতে অচেনা মানুষ আমি’।
যখন আমার চোখ বন্ধ হয় সব অচেনা লাগে যখন আমার চোখ খুলে যায় সব চেনা মানুষদের ভিড়। হঠাৎ ভাবলাম তাহলে মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায়? যারা নেই পৃথিবীতে তাদের সাথে যদি ৫ মিনিট কথা বলতে পারতাম? আচ্ছা এমন কী হয় না যদি সৃষ্টিকর্তা মৃত্যুর ১ দিন পর ৫ মিনিট অথবা ১০ মিনিট সময় দিতেন তাহলে কত মজা হতো? সব মানুষগুলোকে কত রকমভাবে দেখা যেত। মৃত্যুর পর কে খুশি হলো কিংবা কে কষ্ট পেল অথবা মৃত্যুর কারণে কারো কিছু কী আসল? কী গেল? জানি না। কত কিছু দেখা যেত? চেনা পৃথিবীতে আবার কিছু অচেনা মানুষকে সুন্দরভাবে দেখা যেত তাই না?
আচ্ছা এই প্রশ্ন যে করছি আমি, কাকে করছি? সত্যিই কাকে করলাম? নিজেই নিজের প্রশ্নকর্তা আবার নিজেই উত্তরদাতা। মনে হচ্ছে আমি কোনো এক স্কুলের শিক্ষানবিশ শিক্ষক। শিক্ষকের কথাই যখন এলো তাহলে একটা ঘটনা বলি- আমি যে স্কুলে ছোটবেলায় পড়াশোনা করেছি হঠাৎ করেই সেই স্কুলে বেড়াতে গেলাম। বরগুনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা রাজিয়া আপা তিনি আমাকে দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে গেলেন। আমরা ছোটবেলায় দেখতাম বিভাগীয় কমিশনার কিংবা ডিসি সাহেব শিক্ষকদের নিয়ে যেভাবে রুমে রুমে ঘুরতেন, প্রশ্ন করতেন ঠিক সেভাবে রাজিয়া আপা আমাকে নিয়ে প্রতিটি ক্লাসে ঘুরলেন কিন্তু রাজিয়া আপাকে কেউ মানছে না। সবাই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। সব ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা এক হয়ে হলরুমে গেল, কারণ বিভাগীয় কমিশনারদের মতো ঘোরার কোনো উপায় আমার নেই। কী আর করা। রাজিয়া আপা আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে আর আমি মনে মনে ভাবছি আপা কত যে কাঠের স্কেলের মার আমাকে দিয়েছেন বৃত্তি পরীক্ষার আগে। আপার প্রতিটি স্কেলের মার এক একটা আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিয়েছিল যখন ক্লাস ফাইভে আমি বৃত্তি পেলাম। সব কৃতিত্ব রাজিয়া আপার। এখন আমি সেই আপার পাশে দাঁড়িয়ে। আমার চেনা সেই স্কুলের হলরুমের ভেতর কয়েকশ ছাত্রছাত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে আমি কত কিছু ভাবনার ভেতর চলে গেলাম। আমার কানে ভাসছে বাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচি, শোরগোলের শব্দ আর মনে ভাসছে এই স্কুলে আসার প্রথমদিনের রাস্তার কথা। স্কুলের সামনে সেই দোকানটার কথা যেখানে আটআনা দিয়ে চৌকা বিস্কুট খেতাম, স্কুলের পেছনে ছোট রাস্তার কথা, যেখান থেকে অনেকদিন স্কুল ফাঁকি দিয়েছিলাম। সেই জায়গাগুলো নেই ঠিক সেইমতো কিন্তু স্মৃতিগুলো সবই আছে। স্মৃতি ভেঙে গেল একজনের প্রশ্নে আচ্ছা আপনি অভিনয়ে ঢুকলেন কীভাবে? আমি বললাম লঞ্চে করে সোজা ঢাকা গেলাম তারপর স্কুটারে করে গেলাম বিটিভিতে। তারপর কত মানুষের সঙ্গে পরিচয়। কত মানুষের ভিড়, কত পরিচালক, প্রযোজক, নায়ক, নায়িকা। আস্তে আস্তে এরাই সবাই আমার কেমন যেন আপন হয়ে গেল। কিন্তু স্কুলের সেই মানুষগুলো, রাস্তাঘাটগুলো, সবাই কেমন যেন অচেনা হয়ে গেল। জীবন কী এরকমই? একদল মানুষ হারিয়ে যায় আর আরেকদল মানুষ আপন হয়। কিন্তু সবকিছু কী হারিয়ে যায়?