আরে শুশু এত সুন্দর করে কথা বলতে শিখল কবে? কোথাও কোনও জড়তা নেই, কোনও দ্বিধা নেই। যা বিশ্বাস করে তাই স্পষ্ট উচ্চারণে বলে!
সাগর বলল, মিডিলইস্টে থাকার সময় শুশু নিয়মিত রেডিও প্রোগ্রাম করত।
শুনে এত ভালো লাগল। তার মানে আমার বন্ধুরা যে যেখানে আছে সেটুকু জায়গা আলোকিত করেই আছে!
শুশু তিয়াত্তর সালের সেই দিনটির কথা কি তোমার মনে আছে? আমার একদম পরিষ্কার মনে আছে। ওই একটি দিনেই জীবনের অনেক বন্ধুকে আমি একত্রে পেয়েছিলাম। আমার জীবনের সবচাইতে বড় অর্জনের দিন সেটি।
‘তৃতীয় মাত্রা’ নিয়ে আর একটা মজার স্মৃতি আছে। রবীন্দ্র জন্মদিবস। সাগর প্ল্যান করল আমরা তিন বন্ধু মিলে অনুষ্ঠান করব। সাগর উপস্থাপক, আমি আর আফজাল আলোচক। যথাসময়ে সেটে হাজির আমরা। সাগর মাঝখানে আমি আর আফজাল দুইপাশে। সাগর শুরু করল মজাদার এক চমক দিয়ে। ‘আমরা তিন বন্ধু আজ একত্রিত হয়েছি আমাদের আরেকজন বন্ধু সম্পর্কে কথা বলার জন্য। প্রিয়দর্শক, আমাদের সেই বন্ধুর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’।
আমি আর আফজাল চমকিত।
আবার ফিরি উনিশশ’ তিয়াত্তরের সেই দিনে।
অনুষ্ঠান শুরুর সময় ঘনিয়ে আসছে। কখন কোন ফাঁকে ভরে গেছে হল। এই ভিড়ের একপাশে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর পোস্টার পেপার ফেলে খুবই মনোযোগ দিয়ে কী কী লিখছে এক যুবক। লম্বা টিং টিংয়ে। খয়েরি রংয়ের প্যান্টের ওপর গেরুয়া খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা। দেখে মনে হচ্ছে একটি বাঁশের গায়ে প্যান্ট পাঞ্জাবি পরানো হয়েছে। যুবকের মাথার চুল ঘাড় ছাড়িয়ে নেমেছে। গায়ের রং মাজা মাজা। মুখের প্যাটার্ন রেডইন্ডিয়ানদের মতো। চোখ দুটো বড় বড়। চোখে এক ধরনের নিরীহ এবং কৌতূহলী দৃষ্টি।
রহমান আমাকে সেই যুবকের কাছে নিয়ে গেল। পরিচয় করিয়ে দিল। আজকের বিখ্যাত আফজাল হোসেনের সঙ্গে এই আমার পরিচয়। সাতক্ষীরার ছেলে। আমার দুবছরের সিনিয়র। আর্ট কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। তখন কে জানত এই নরম নিরীহ যুবকটি শিল্পের যে শাখায় হাত দেবে সেখানেই সোনা ফলবে! তার একার আলোয় অনেকখানি আলোকিত হবে আমাদের সময়।
চাঁদের হাটের সেদিনকার সেই অনুষ্ঠানে তখনকার পাঁচজন বিখ্যাত তরুণ লেখককে দেখলাম। আলী ইমাম, সালেহ আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম, মুনা মালতি এবং ফিউরি খোন্দকার। সালেহ আহমেদ শুধুই ছোটদের লেখা লেখেন। চাঁদের হাট, কচিকাঁচার মেলা, সাতভাই চম্পা, এসব পাতায় তো তাঁর লেখাই বেরোয়ই, এখলাসউদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ‘টাপুর টুপুর’ পত্রিকাতেও বেরোয়। রহমানকে দেখলাম লেখক হিসেবে খুবই সমীহ করে তাঁকে।
সালেহ আহমেদ বক্তৃতা করলেন। সাহিত্য নিয়ে ভালো ভালো কথা বললেন। তারপর বক্তৃতা দিল সিরাজুল ইসলাম। সিরাজ তখন বড়দের গল্পও লেখে। দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীব সিরাজের লেখা খুবই পছন্দ করেন। সিরাজ তখন বুয়েটের ছাত্র। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। পুরনো ঢাকার বেগমগঞ্জের ছেলে। আমাদের গেণ্ডারিয়ার কাছে বেগমগঞ্জ। গেণ্ডারিয়া এবং বেগমগঞ্জের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে ধোলাইখাল। সিরাজ ছোটখাটো মানুষ, রহমান আকৃতির। অতি রোগা। পরনে ঢলঢলে শার্টপ্যান্ট, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, চোখে মোটা কাচের চশমা। কথা খুবই কম বলে, হাসে বেশি। ঘন ঘন সিগ্রেট খায়।
সিরাজের সঙ্গে পরে গভীর বন্ধুত্ব হয় আমার।
জীবনের অনেকগুলো বছর প্রতিটা দিন আমার সিরাজের সঙ্গে কেটেছে। চাঁদের হাটের বাইরে আমাদের পাঁচ বন্ধুর একটা দল হয়েছিল। কাজী হাসান হাবিব, সিরাজুল ইসলাম, মুহম্মদ জুবায়ের, ফিরোজ সারোয়ার এবং আমি। কী যে উন্মাদনার দিন আমাদের তখন। প্রতিদিনই পাঁচজন একসঙ্গে হচ্ছি। তুমুল আড্ডা, হৈ চৈ। একত্রে রাত্রিযাপন। আমাদের মধ্যে তখন শুধুমাত্র হাবিবই বিবাহিত।
তেরো বছর আগে হাবিব আমাদের দলটা ভেঙে দিল।
চার বন্ধুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল হাবিব। সিরাজ আমি জুবায়ের সারোয়ার চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিলাম হাবিবকে। হাবিব কোনও কিছুই তোয়াক্কা করল না, চারজনের মাঝখান থেকে উধাও হয়ে গেল। হাবিবকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল ক্যান্সার।
হাবিবের কথা ভাবলেই ছেলেবেলার একটা খেলার কথা মনে পড়ে আমার। পাঁচজনের খেলা। হাতে হাত ধরে চারজন ঘেরাও করে রাখবে একজনকে। চারজনেরই চোখ বন্ধ থাকবে। মাঝখানের খেলোয়াড় এই চারজনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যাবে। এমন ভাবে বেরুবে, কারও গায়ে ছোঁয়া লাগতে পারবে না। কেউ টের পাবে না কোনদিক দিয়ে বেরিয়েছে। তারপর সে প্রশ্ন করবে, বলো তো আমি কোনদিক দিয়ে বেরিয়েছি? যার উত্তর সঠিক হবে সে জিতবে খেলায়।
হাবিব ছিল আমাদের চারজনের মাঝখানকার সেই খেলোয়াড়।
হাবিব বেঁচে থাকতেই জুবায়ের চলে গিয়েছিল আমেরিকায়। স্ত্রী শাহিন, দুই সন্তান ডোরা এবং অর্নবকে নিয়ে তার সংসার। ডালাসের এলেন এলাকায় সুন্দর বাড়ি জুবায়েরের। বছর পাঁচেক আগে জুবায়েরের কাছে গিয়ে আমি দশদিন ছিলাম। কী যে আনন্দের দিন সেসব, কী যে ভালোবাসার দিন।
জুবায়েরের ছেলে অর্নব তখন বেশ ছোট। তার একমাত্র নেশা ডাইনোসর। যত রকমের পুতুল ডাইনোসর পাওয়া যায় সব তার আছে। অর্নবের এইম ইন লাইফ হচ্ছে, বড় হয়ে সে ডাইনোসর হবে।
ফিউরি খোন্দকার তখন দুহাতে লেখে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। যেমন ছোটদের গল্প, তেমন বড়দের গল্প। সাহিত্য মহলে ফিউরি তখন বেশ পরিচিত। সিরাজের সঙ্গে তার স্বভাবের খুব মিল। সেও কথা বলে কম, হাসে বেশি। ফিউরির হাসি একটু লাজুক টাইপের, মিষ্টি। কথা বলতে গিয়ে সামান্য তোতলায়।