মা বলল, রাতটা আমরা ওই গর্তে কাটামু।
শুনে আমি চমকে উঠলাম। কও কী তুমি?
হ।
ওই রকম জায়গায় সারারাত বইসা থাকতে পারবা?
পারুম। তুই পারবি কী না সেইটা ক?
তুমি পারলে আমিও পারুম।
তয় আর চিন্তা নাই।
কিন্তু খাইবা কী? খাওনের তো কোনও পথ দেখতাছি না।
কাইল সকাল পর্যন্ত না খাইয়া থাকন লাগবো। পারবি না?
আমি কাতর গলায় বললাম, আমার তো অহনই খিদায় পেট জ্বইলা যাইতাছে।
মা বলল, ধৈর্য ধর বাজান, ধৈর্য ধর। একটামাত্র রাইত। পেটের খিদা চাইপা রাখি। কাইল আল্লাহপাক কোনও না কোনও ব্যবস্থা করবোই। খিদা সহ্য করতে না পারলে চাপকল থিকা পানি খাইয়া আয়।
আমাদের বাড়িতে পুরনো একটা চাপকল ছিল। সবই লুট হয়ে গেছে, চাপকলটা লুট হয়নি। আক্কাসের চোখে চাপকলটা বোধহয় পড়েইনি। পড়লে মাটির তলার পাইপ পর্যন্ত টেনে তুলে নিয়ে যেত।
মার কথায় চাপকলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একহাতে চাপকল টিপে, অন্যহাতে অনেকক্ষণ ধরে পানি খেলাম। গাল মুখ চটচটে হয়েছিল চোখের পানিতে। চাপকলের ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখটা খুব ভালো করে ধুয়ে ফেললাম। ময়লা স্যান্ডোগেঞ্জি মুখের কাছে তুলে মুখ মুছতে মুছতে এলাম মার কাছে।
মার বুকে তখনও কোরআন শরীফ। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাচ্ছে চারদিকে। মার হাত ধরে ট্রেঞ্চে গিয়ে নামলাম। প্রথমে নামালাম মাকে। তারপর নিজে নেমে আলগা ঝাপটা টেনে দিলাম ট্রেঞ্চের মুখে। মুহূর্তে গভীর গভীরতর এক অন্ধকার জগতে চলে গেলাম।
মৃত্যুর জগৎ কী ঠিক এই রকম না?
কবর কী ঠিক এই রকম না?
এই রকম অন্ধকার আর নির্জন?
জীবিত মানুষের কবরবাসের অভিজ্ঞতা কী রকম কেউ তা জানে কী না জানি না। আমি আমার কবরবাসের অভিজ্ঞতা টের পেলাম সেই রাতে।
ট্রেঞ্চের এককোণে বুকে কোরআন শরীফ জড়িয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে মা। মাঝখানে বিঘত পরিমাণ ব্যবধান, আমি বসে আছি। দুজন মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ টের পাই দুজনে। কিন্তু কেউ কোনও কথা বলি না।
কবরে থাকা মানুষ কী কথা বলে?
মা সবসময় দোয়া পড়েন একটু শব্দ করে। সেই রাতে সেই কবরের অন্ধকারে বসে মা কোনও শব্দ করছিল না। বুকে জড়ানো কোরআন শরীফ নিয়ে আল্লাহকে মা ডাকছিল নিঃশব্দে। ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিল।
আল্লাহকে ডাকছিলাম আমিও। মায়ের মতো নিঃশব্দেই ছিল সেই ডাক। এই করে করে ঘুম এবং জাগরণের মাঝখানকার একটা অবস্থা তৈরি হলো দুজনেরই। নাকি ওই অবস্থাটাকে বলে জীবন এবং মৃত্যুর মাঝখানকার অবস্থা?
এই অবস্থা কাটলো ভোররাতের দিকে।
সারারাত আমাদের চারপাশে কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। ছিল মাটির তলার নৈঃশব্দ। সেই প্রথম আমি আবিষ্কার করেছিলাম নৈঃশব্দের ভিতরেও থাকে এক রকম শব্দ। সেই শব্দ জীবনের শব্দ না, সেই শব্দ মৃত্যুর শব্দ।
মৃত্যুর শব্দ থেকে জীবনের শব্দে ফিরলাম ভোররাতে। বহুদূর থেকে ভোরবেলার পবিত্র হাওয়ায় আমাদের মা ছেলের কবরের ভিতরে মিহিন সুরে ভেসে এলো ফজরের আজানের শব্দ। সেই শব্দে মৃত্যুর জগৎ থেকে ফিরে এলাম আমরা। মা একটু নড়েচড়ে উঠল। আজানের শব্দ পাছ ধলা?
আমিও একটু নড়ে উঠলাম। হ মা পাই।
তয় তো ফজর হইছে?
হ।
ল তয় অহন বাইর হই।
লও।
মা ছেলে তখন আমরা কবর থেকে বেরিয়ে এলাম। খোলা জায়গায় দাঁড়াবার পর আশ্চর্য এক অনুভূতি হলো আমার। ভোরবেলার হাওয়া, পাখির ডাক আর গাছপালার গন্ধে, পায়ের তলার ঘাস মাটির গন্ধে মনে হলো এই প্রথম পৃথিবীর মাটি হাওয়াতে, ঘাসের বনে আর গাছগাছালির শীতলতায় বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের অন্যকোনও গ্রহ থেকে পৃথিবীতে এসে যেন পা দিয়েছি আমি। অথবা মৃত্যুর জগৎ থেকে এইমাত্র ফিরেছি জীবনে। সঙ্গে সঙ্গে পেটের ভিতর মুচড়ে উঠল তীব্র ক্ষুধা। কাল থেকে কিছ্ইু যে খাওয়া হয়নি, কবরের অন্ধকারে একবারও টের পাইনি সেই অনুভূতি। এখন পেলাম।
মাকে বললাম, মা আমি খিদায় মইরা যাইতাছি। যেমনে পারো আমারে কিছু খাওয়াও।
মা বলল, আমি বন্দোবস্ত করতাছি। তুই কোনও চিন্তা করিস না।
কোরআন শরীফ বুকে নিয়েই বাঁশবাগানের ওদিককার রাস্তা দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেল মা। কোথায় গেল জানি না। আমি বসে রইলাম কাল সারাদিন যেখানটায় বসেছিলাম, বাড়ির আঙিনার ঠিক সেই জায়গাটাতে। আমার তখন মাথা কাজ করছে না। চিন্তা চেতনা অনুভূতি সব লোপ পেয়ে গেছে খিদায়। ট্রেঞ্চে রাত কাটিয়েছি বলে হাত পা মুখ মাথা সব ভরে আছে ধুলোতে। নিজেকে মনে হচ্ছে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা খিদার কষ্টে ধুকতে থাকা মৃতপ্রায় কোনও শেয়াল।
মা ফিরে এলো বেশ তাড়াতাড়ি।
হাতে একটা এলুমিনিয়ামের হাঁড়ি। হাঁড়িতে কিছু চাল। এসেই কোরআন শরীফটা রাখল রেহালের ওপর। রেহালটা ঠিক সেই আগের জায়গাতেই ছিল।
মা তারপর চাপকলটার কাছে গিয়ে হাঁড়ির চালগুলো ধুঁয়ে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে নিয়ে এলো। আমাদের রান্নাচালার ওদিকটাও ফাঁকা। শুধু মাটির চুলা দুটো আছে। লাকড়ি খড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারপাশে। চুলার একপাশে ছোট্ট ন্যাকডায় জড়ানো থাকে ম্যাচ। ম্যাচটা সেভাবেই আছে। সেই ম্যাচ জ্বেলে চুলায় আগুন জ্বাললো মা।
এলুমিনিয়ামের হাঁড়িতে টগবগ করে ফুটতে লাগল চাল। জাউ রান্না করল মা। পাতলা জাউ না, থকথকে। থালা বাসন কিচ্ছু নেই। কেমন করে খাবো এই জিনিস?
একটা সময়ে দেখি নিজের অজান্তেই আমি এবং আমার মা মুঠো করে হাঁড়ি থেকে সেই থকথকে জাউ তুলছি আর পাগলের মতো খাচ্ছি। কোনও দিকেই খেয়াল নেই আমাদের।