তখন এতটা বুঝিনি।
এখন ভাবলে মনে হয়, কী দুর্দান্ত আইডিয়ার গল্প। হয়তো কাঁচা হাতে লিখেছিল সাগর। কিন্তু আইডিয়াটা অসাধারণ। ওই বয়সে এরকম একটা গল্পের আইডিয়া যার মাথায় আসে সে যে বড় ক্রিয়েটার তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
সাগরের পরবর্তী জীবনের দিকে তাকালে তার বহু ক্রিয়েটিভিটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হই। যেমন ‘খাবার দাবার পিঠাঘর’। যেমন ‘চ্যানেল আই’। সাগর যেখানে হাত দিয়েছে, অতিযতেœ সেখানে সোনা ফলিয়েছে। এমন কি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের চেহারাটাও সে বদলে দিয়েছে। আর শিশুসাহিত্যে সাগর যোগ করেছে এক দুর্দান্ত চরিত্র ‘ছোটকাকু’।
একজন মানুষ কোন মন্ত্রবলে, মাত্র দুটো হাত নিয়ে এত কাজ করতে পারে ঠিক বুঝতে পারি না। সাগরকে দেখে আমি বিস্মিত হই, আফজালকে দেখে আমি বিস্মিত হই। এদের দুজনের কাউকেই আমার একজন মানুষ মনে হয় না। মনে হয় ফরিদুর রেজা সাগর নামে আট-দশজন অতি মেধাবী মানুষ কাজ করছে, আফজাল হোসেন নামে আট-দশজন অতি মেধাবী মানুষ কাজ করছে। কোথায় সেদিনকার সেই সাগর, আর কোথায় আজকের সাগর। মেধা এবং শ্রম একজন মানুষকে কোথায় নিয়ে আসতে পারে সাগর এবং আফজাল তার প্রমাণ।
প্রথম দিনই সাগরকে আমার খুব ভালো লেগেছিল।
রহমান পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর সাগর তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে দুয়েকটা কথা বলেছিল। সে তো বরাবরই কথা বলে কম। অতি মেধাবী কাজের মানুষরা কথায় বিশ্বাসী নন, বিশ্বাসী কাজে। শুরু থেকেই সাগরের মধ্যে এই ব্যাপারটা ছিল।
সাগরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল শাহানা বেগম। নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছে। গল্প লেখে। স্মার্ট সুন্দর মেয়ে। পরবর্তীকালে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পাবলিক এডমিনিসট্রেশনে, নাকি কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করল। বিখ্যাত সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর সঙ্গে বিয়ে হলো। আমাদের খুবই প্রিয়বন্ধু।
শাহানা এখন কানাডায়। কিছুদিন আগে দেশে এসেছিল মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করতে। আমার সঙ্গে দেখা হয়নি।
এই লেখা লিখতে বসে কত প্রিয়বন্ধুর কথা যে মনে পড়ছে।
সাগরকে ঘিরেই সেদিন মেয়েদের ভিড়।
লিজি নামে ছবির মতো সুন্দর এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাগর আর শাহানার মাঝখানে। একটু ডাকাবুকো টাইপের একটা মেয়ে প্রায় ভিড় ঠেলে ঢুকে গেল। কী কথায় খিলখিল করে হাসতে লাগল।
রহমান বলল, ওর নাম শুশুমণি। কাদের সিদ্দিকীর ছোটবোন।
শুনেই আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কাদের সিদ্দিকীর বোন!
কাদের সিদ্দিকী তখন আমাদের হিরো। বিশাল মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অতুলনীয়। তাঁর কাদেরীয়া বাহিনী পাকিস্তান আর্মির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন বহুবার তাঁর নাম এবং কৃতিত্বের কথা প্রচারিত হতো। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক কিংবদন্তির নাম কাদের সিদ্দিকী। তাঁকে প্রথম দেখেছি আমাদের জগন্নাথ কলেজে। কলেজের কোনও একটা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা, লম্বা ি ম একজন বাঙালি। মুখভর্তি দাড়ি। কলেজের মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলছিলেন তিনি। হাজার হাজার ছাত্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি তাঁকে দেখছিলাম। সেদিনের পর, বেশ অনেক বছর পর তাঁর দুখণ্ডে লেখা বই ‘স্বাধীনতা ’৭১’ হাতে এলো। কলকাতার ‘দে’জ’ প্রকাশন সংস্থা বের করেছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়লাম সেই বই। দুয়েকটি অনুষ্ঠানে এই মহান বীরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। এত সুন্দর করে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেন। ভাবতে ভালো লাগে, গৌরববোধ করি। কাদের সিদ্দিকীর ছোটবোন আমার বন্ধু।
সেই বন্ধুকে প্রথম চিনিয়েছিল রহমান।
কাদের সিদ্দিকীর ছোটবোন শুনে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সরাসরি তাকানো যাবে তো এই মেয়ের দিকে? রেগে যাবে না তো? ভাইয়ের কাছে গিয়ে বিচার দেবে না তো?
শুশুর দিকে আমি খুবই সমীহের চোখে তাকিয়েছিলাম।
চাঁদের হাটের দিনগুলোতে শুশুর সঙ্গে আমার তেমন দেখা হয়নি। দু চার বার যাও দেখা হয়েছে তেমন কথাবার্তা হয়নি। দেখেছি শুশু তুমুল আড্ডা দেয় বন্ধুদের সঙ্গে। হৈ হল্লা হাসি আনন্দে মেতে থাকা অতি প্রাণবন্ত মেয়ে। খুবই ঠাট্টাপ্রিয়, শুশুর রসবোধ তীব্র।
শুশুর সঙ্গে বহু বহু বছর পর দেখা হলো চ্যানেল আইতে, সাগরের রুমে। শুশুর চেহারা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। সাগর বলল, দেখো তো চেন কি না!
চিনতে পারিনি।
সেই কিশোর বয়সের মতো শুশু আমার বাহুর কাছে একটা ধাক্কা দিল। বড় লেখক হয়ে গেছ! বন্ধুদের চিনতে পারো না। আমি শুশু।
শুশুর এই আচরণে আমি মুহূর্তে ফিরে গেলাম তিয়াত্তর সালের সেই দিনে।
আহা রে! কত কতগুলো দিন চলে গেছে আমাদের জীবন থেকে। সেই দিনকার বন্ধুদের মুখ দেখলে দিনগুলো ফিরে পাই।
শুশুকে পেয়ে সাগর খুব উচ্ছ্বসিত। তৃতীয় মাত্রার জিল্লুরকে বলল, শুশু আর মিলনকে তৃতীয় মাত্রায় আনো। ওরা বন্ধুত্ব ইত্যাদি নিয়ে কথা বলবে, দুজনেই প্রবাসে জীবন কাটিয়েছে, প্রবাস জীবন নিয়ে কথা বলবে।
মিডিলইস্টের অনেক দেশ ঘুরে শুশু এখন কানাডায় সেটেলড। আর আমি বহু বছর আগে দুবছর জার্মানিতে ছিলাম।
আমরা দুই বন্ধু তারপর তৃতীয় মাত্রায় হাজির হলাম। শুশু কথা বলতে শুরু করল। শুশুর কথাবার্তা শুনে আমি মুগ্ধ। কী সুন্দর উচ্চারণ, কী সুন্দর বাচনভঙ্গি, কী সুন্দর যুক্তি দিয়ে কথা বলে।
আমি শুশুর কাছে ম্লান হয়ে গেলাম।