এই সেই রহমান!
এই সেই ছেলেটি, চাঁদের হাটের অনুষ্ঠানে যার সঙ্গে আমার পরিচয়। পরিচয়ের কয়েক মিনিটের মধ্যেই বন্ধুত্ব।
ভাবতে ভালো লাগছে, আমার প্রথম গল্পের নাম ‘বন্ধু’। সেই গল্পের সুবাদে চাঁদের হাটে গিয়ে আমি পেয়ে গেলাম আমার পরবর্তী পুরো জীবনের প্রিয় সব বন্ধুকে। প্রথম বন্ধু রহমান। রহমানের কল্যাণে অন্যরা।
রহমানের অন্যান্য কীর্তির কথা পরে বলি। আগে সেই প্রথম দিনটির কথা বলি। আফজালের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা বলি।
দাদুভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর রহমান আমাকে নিয়ে গেল গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়া কয়েকজন ছেলেমেয়ের সামনে। এই, এই যে দেখ। এ হচ্ছে বন্ধু।
মানে আমার গল্পের নাম দিয়েই রহমান আমাকে পরিচয় করাচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে চিনল অনেকে। একটি ছেলে কোমরে হাত দিয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু জোরে জোরে কথা বলার স্বভাব। রহমান পরিচয় করিয়ে দিল, ওর নাম গোলাম মাওলা শাহজাদা। ছড়া কবিতা গল্প সব লেখে। আমার গল্পটা সে পড়েছে। হৈ হৈ করে সেকথা বলল।
প্রিয় পাঠক, এই গোলাম মাওলা শাহজাদা কে জানেন? আজকের বাংলাদেশের, বাংলাভাষার বিখ্যাত কবি হাসান হাফিজ। বাংলা কবিতায় নিজের দক্ষতা পুরোপুরি প্রমাণ করেছেন তিনি। শিশুসাহিত্যে তাঁর অবদান যথেষ্ট। কৃতী সাংবাদিক হিসেবে তিনি শ্রদ্ধেয়। খেলাধুলায় আগ্রহী, পরিবেশ নিয়ে কাজ করেছেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে। বহু কাব্যগ্রন্থ এবং শিশুতোষগ্রন্থের পাশাপাশি ম্যারাডোনাকে নিয়ে বই লিখেছেন, পরিবেশ নিয়ে বেশ স্বাস্থ্যবান বই সম্পাদনা করেছেন। যেসব বন্ধুর পরিচয় দিতে আমি গৌরববোধ করি, শাহজাদা মানে হাসান হাফিজ তাদের একজন। সে নারায়ণগঞ্জের ছেলে। একবার মুন্সিগঞ্জের এক সাহিত্য সম্মেলনে গেছি তার সঙ্গে। উদ্যোক্তাদের একজনের বাড়িতে আমাদের দুজনকে রাতে থাকতে দেয়া হয়েছে। খেয়ে-দেয়ে শুয়েছি আমরা, শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বোধহয় তিরিশ সেকেন্ডও লাগেনি, ঘুমিয়ে গেল শাহজাদা। তাও হালকা পাতলা ঘুম না। গভীর ঘুম। মৃদু নাকও ডাকাচ্ছে।
আমি অবাক।
শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে এইভাবে ঘুমিয়ে পড়তে পারে মানুষ!
আমি পাতলা ঘুমের মানুষ। ছেলেবেলা থেকেই, বিছানায় শোয়ার অনেক পরে আমার ঘুম আসে। নতুন জায়গা হলে ঘুম সহজে আসতেই চায় না। একা রুমে থাকতে পারি না। আমার একটু ভূতের ভয়ও আছে। একা রুমে থাকলেই মনে হয়, ওই তো, কে একজন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটু যেন বেশিই লম্বা। মাথাটা ছাদের সিলিংয়ে গিয়ে ঠেকেছে না! কখনও মনে হয় নিঃশব্দ পায়ে কে যেন হাঁটছে রুমে। রবীন্দ্রনাথের গানের মতো, ‘প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে’। আমার মনে হয় ভূত এসেছে নিঃশব্দ চরণে।
পায়ের পাতা দুটো লেপ কম্বল কিংবা চাদরের বাইরে রেখে শোয়ার অভ্যাস আমার। কখনও কখনও মনে হয় পায়ের তলায় কে যেন সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
এইসব কারণে বিদেশে গেলে বেশ একটা ফাপরে পড়ি। হোটেলের রুমে ফকফকা লাইট জ্বালিয়ে রাখি। বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে থাকলেও একই কাজ। তারপরও ঘুম পুরোপুরি হয় না। রাত কাটে আধো ঘুমে আধো জাগরণে।
অথচ শোয়ার তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে গভীর ঘুমে ডুবে যায় শাহজাদা!
আফজালের স্বভাবও এই রকম। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে তো বটেই, যখন চাইবে তখনই ঘুমাতে পারবে সে। আবার তিন চার রাত একনাগাড়ে জেগেও থাকতে পারবে। মুখ দেখে বোঝা যাবে না তিন চার রাত ঘুমায়নি সে।
এ এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা।
শাহজাদার পাশে সেদিন দাঁড়িয়ে ছিল তেল চকচকে এক যুবক। উত্তম কুমার টাইপের ব্যাক ব্রাশ করা চুল। শ্যামলা রঙের মুখে আমার মতোই মোচ রেখেছে। পরনে কালো প্যান্ট আর নীল রঙের শার্ট। ফুলি ভ শার্টের হাতা তখন অনেকেই গুটিয়ে রাখে। সে রাখেনি। কব্জির বোতাম লাগানো। পায়ে স্যান্ডেল। অর্থাৎ নিপাট ভদ্রলোক।
রহমান পরিচয় করিয়ে দিল। আলীমুজ্জামান হারু।
আমরা খুব কাছের বন্ধু যারা তারা ছাড়া হারুকে কেউ আর এখন হারু ডাকে না। জুনিয়ররা ডাকে জামানভাই, কলিগরা ডাকে আলীমুজ্জামান সাহেব। হারু সাংবাদিকতা করে। যুগান্তর পত্রিকার সঙ্গে আছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে বাংলায় মাস্টার্স করেছে। দিদার, স্বপন, হারু ওরা একই ব্যাচের।
সেদিনকার সেই অনুষ্ঠানে দিদার ছিল না। দিদারের সঙ্গে আমার পরিচয় আরও পরে। দিদারের পুরো নাম দিদারুল আলম। এখন শিক্ষাভবনের ঊর্ধ্বতন একজন। খুবই প্রিয়বন্ধু আমার। দিদারের সঙ্গে অনেক ঘটনা, অনেক মধুর স্মৃতি। সেইসব স্মৃতির কথা অবশ্যই এই লেখায় লিখব। পর্যায়ক্রমে লিখব। আগে সেই প্রথম দিনটির কথা বলি।
ফরিদুর রেজা সাগরের মা যে বাংলাভাষার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক রাবেয়া খাতুন এই তথ্য আমি জেনেছি সাগরের সঙ্গে পরিচয়ের অনেক পরে। সাগরের বাবা ফজলুল হক সাহেব প্রথম চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা বের করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে। সমগ্র পাকিস্তানের প্রথম ছোটদের চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’ তৈরি করেছিলেন, যে ছবির নায়ক কিশোর ফরিদুর রেজা সাগর।
সাগর যে দেখতে কী সুন্দর ছিল!
টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ। গোলগাল মিষ্টিমুখ। একটু মোটা ধাঁচের শরীর। তখনও সাদা পাঞ্জাবি পাজামা ধরেনি সাগর। সুন্দর হাওয়াই শার্ট আর প্যান্ট পরা। পায়ে স্যান্ডেল সু। চেহারায় আশ্চর্য রকমের বনেদিআনা। নিচুগলায় সুন্দর করে কথা বলে। লেখে খুব ভালো। চাঁদের হাটের পাতায় সাগরের লেখা আমি পড়েছি। ছোটদের উপযোগী একটা মুক্তিযুদ্ধের গল্পের কথা আমার এখনও মনে আছে। সাগরের হয়তো নিজেরও মনে নেই সেই গল্পের কথা। কোনও বইতেও দেয়নি। কোথায় হারিয়ে গেছে সাগর জানেও না। ছোট্ট একটা রাখাল ছেলে গ্রামের বিলবাওড়ে গরু চড়ায়। দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে সে খবর রাখে না। একদিন নির্জন বিলে চার মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তার দেখা। মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে রাইফেল, মাথায় চুল লম্বা, চোখ লাল। বালক বিস্ময়ভরা চোখে তাঁদেরকে দেখে। গভীর কৌতূহল নিয়ে জানতে চায় তাঁরা কারা। এই বালকের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধারা। অতিসরল ভাষায় কেন তাঁরা যুদ্ধ করছেন, কেন তারা এই দেশটিকে স্বাধীন করতে চান সেই বালককে তা বোঝান। সব শুনে বুঝে সেই বালকের ভেতর তৈরি হয় গভীর দেশাত্মবোধ। সেও তৈরি হয় শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য। তার ছোট্ট শরীর এবং হাতের লাঠিটি নিয়ে তৈরি হয়।