মনে আছে আফজালের কথা।
তার আগে আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়েছে চাঁদের হাটের পাতায়। গল্পের নাম ‘বন্ধু’। ডাকে পাঠিয়েছিলাম। যে সপ্তাহে পাঠিয়েছি তার পরের সপ্তাহেই ছাপা হয়ে গেছে। গল্পের ইলাসট্রেশন করেছিলেন কাজী হাসান হাবিব। পরবর্তীকালে হাবিবের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয় আমার। কিন্তু আমার নামের বানানটা ভুল করেছিল হাবিব। ই এর পরে ম এর জায়গায় হাবিব লিখেছিল ক।
তাতে কী!
গল্প ছাপা হয়েছে, এই খুশিতে আমি পাগল। অন্যান্য পত্রিকার ছোটদের পাতা দেখি বা না দেখি পূর্বদেশের ‘চাঁদের হাট’ দেখিই। এই পাতায় সাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠানের সংবাদটা বেরিয়েছিল। চাঁদের হাটে যাঁরা লেখালেখি করেন সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি তখন থাকি গেণ্ডারিয়াতে। গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডের একটা বাড়িতে। সেখান থেকে সদরঘাট গিয়ে বাসে চড়লাম। গুলিস্থানে নেমে হেঁটে গেলাম অবজারভার হাউসে।
কিন্তু আমাকে কেউ চেনে না।
লম্বা মতন এক ভদ্র্রলোককে ঘিরে আমার বয়সী বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে। ভদ্রলোকের মাথায় লম্বা চুল। পরনে কালো প্যান্ট আর সাদা ফুলহাতা শার্ট। মুখে পান আছে। পান চিবাতে চিবাতে তিনি ছেলেমেয়েগুলোকে নানা রকম কাজের অর্ডার দিচ্ছিলেন। তাঁর অর্ডারে বর্তে যাচ্ছিল সবাই। যেন তাঁকে খুশি করতে পারলেই হলো।
এদের মধ্যে ছোটখাটো একজন আমাকে খেয়াল করল। আমার বয়সী অথবা আমার চেয়ে বছর খানেকের ছোট হবে। আকৃতিতে ছোট কিন্তু তার গলার আওয়াজ বেশ ভারি, চালচলনে কেউকেটা ভাব। গায়ের রং শ্যামলা। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা। মাথায় অতি ঘন চুল। জিজ্ঞেস করল, তুমি কোত্থেকে আসছ?
বললাম।
নাম কী?
বললাম।
নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে সে আমাকে চিনল। ও তোমার গল্প তো চাঁদের হাটে ছাপা হয়েছে। ‘বন্ধু’ না গল্পের নাম?
হ্যাঁ।
আরে আসো আসো।
প্রথমে সে আমাকে নিয়ে গেল পান চিবানো ভদ্রলোকের কাছে। দাদুভাই, এ হচ্ছে বন্ধু।
অনুষ্ঠানের কাজে মহাব্যস্ত ভদ্রলোক। তবু আমার দিকে তাকালেন। বন্ধু মানে?
কিছুদিন আগে নতুন একটা ছেলের গল্প ছাপলেন না! গল্পের নাম ছিল…
বুঝেছি বুঝেছি।
শুধু ওটুকুই। ব্যস্তভঙ্গিতে অন্যদিকে চলে গেলেন তিনি।
ছেলেটি আমাকে বলল, ইনিই চাঁদের হাট পাতা দেখেন। বিরাট ছড়াকার। নাম রফিকুল হক। আমরা সবাই দাদুভাই ডাকি। ইত্তেফাকের ‘কচিকাঁচা’র পাতা চালান আরেক ছড়াকার, রোকনুজ্জামান খান। তাঁকে সবাই দাদাভাই ডাকে। তিনি দাদাভাই, আর ইনি দাদুভাই।
বলে মিষ্টি করে হাসল।
টের পেয়ে গেলাম ছেলেটির কথায়, আচরণে মজার একটা ভঙ্গি আছে। তার রসবোধ চমৎকার।
কিন্তু তখনও পর্যন্ত তার নাম আমি জানি না।
আমি জগন্নাথ কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। চেহারা সুবিধার না। গুণ্ডা গুণ্ডাভাব আছে। শিল্পসাহিত্যের সঙ্গে আমার চেহারাটা ঠিক যায় না। দাদুভাই বোধহয় এজন্য আমাকে তেমন পাত্তা দিলেন না। আমার অবশ্য ওসব তখন খেয়াল করার সময় নেই। ছেলেটির আচরণ আমার ভালো লাগছে। খুবই আন্তরিকভাবে কথা বলছে। খানিক আগেই যে পরিচয় হয়েছে মনেই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে আমার বহুদিনের পরিচিত। বহুদিনের পুরনো বন্ধু।
এই ছেলেটির নাম আবদুর রহমান।
আজকের বিখ্যাত আবদুর রহমান। অসাধারণ ছড়া লিখত, মুখে মুখে দুর্দান্ত সব ছড়া বানাত। কিন্তু তার কোনও বই নেই। এত ভালো লেখে, কিন্তু লেখালেখিতে আগ্রহ নেই। ওই বয়সেই চমৎকার বক্তৃতা দিত রহমান, সাংগঠনিক দক্ষতা অতুলনীয়। পরবর্তী জীবনে অনেক কিছু করেছে। মতিঝিলে নার্সারি এবং বীজের দোকান রহমানদের। ঢাকা সীড স্টোর। দৈনিক বাংলা থেকে গভর্নর হাউসে যাওয়ার রাস্তায়। সেই দোকানের জায়গায় এখন চৌদ্দতলা বিল্ডিং রহমানদের। কিন্তু নিচতলায় দোকানটা আছে। রহমানের বাবা বসেন। আমাদের খুবই প্রিয় মানুষ তিনি।
এই দোকানের পাশে ছোট্ট একটা দোকান নিল রহমান। সাতাত্তর আটাত্তর সালের কথা। তাজাফুলের দোকান দিল। ঢাকায় তখনও ফুলের দোকানের কনসেপসান আসেনি। রহমানের মাথা থেকে এলো। উৎসব আনন্দ বিয়ে এবং জন্মদিনে তাজাফুল কিনে নিয়ে উপহার দেবে লোকে। আমরা রহমানের দোকানে বসে তুমুল আড্ডা দেই। চা সিঙারা খাই। রহমান সারাদিনে যত টাকার ফুল বিক্রি করে তার চেয়ে অনেক বেশি খেয়ে ফেলি। বাকি টাকা বাবার কাছ থেকে নিয়ে আসে রহমান। বন্ধুদের জন্য ভর্তুকি দেয়।
কিন্তু কতদিন?
নির্বিকার ভঙ্গিতে রহমান একদিন দোকানে তালা ঝুলিয়ে দিল। কত টাকা লস হলো কোনও হিসাবই নেই। আমার ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ উপন্যাসে এই দোকানের কথা আছে।
তারপর রহমান হয়ে গেল চিত্রসাংবাদিক, চলচ্চিত্র সাংবাদিক। অবজারভার হাউসের বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘চিত্রালী’। রহমান কন্ট্রিবিউটর হিসেবে ‘চিত্রালী’তে ববিতা শাবানা এইসব বিখ্যাত নায়িকাদের নিয়ে লেখে। ববিতার বোন চম্পার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব। চম্পা তখনও নায়িকা হয়নি। রোজিনা নামে একজন নায়িকা এসেছে তখন, রহমানের সঙ্গে তাঁরও বন্ধুত্ব। আমরা তখন যাদের কাছে পৌঁছাবার কথা ভাবতেই পারি না, রহমান কেমন কেমন করে তাদের কাছে পৌঁছে যায়, বন্ধুত্ব করে ফেলে। বিরাট বিরাট নায়িকাদের তুই-তোকারি করে। ঘরের মানুষের মতো কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলে। আমরা জুল জুল করে রহমানের দিকে তাকিয়ে থাকি।