তারপর তাকালো আমার দিকে।
একহাতে বুকে ধরা কোরআন শরীফ, অন্যহাত রাখল আমার মাথায়। কান্দিস না বাজান, কান্দিস না। ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর।
মাকে দেখে আমার কান্না আরও বেড়ে গেছে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমগ কিছু নাই মা। আমরা পথের ফকির হইয়া গেছি।
মা আবার সেই কথা বলল, ধৈর্য ধর।
পথে আসতে আসতে মা বোধহয় খবর পেয়ে গিয়েছিল কে লুট করেছে আমাদের বাড়ি।
সেই বদমাশ কেরামত আলীর ভাই। লোকটার নাম আক্কাস আলী।
কোরআন শরীফ বুকে নিয়ে আক্কাসের বাড়িতে গেল মা। গিয়ে দেখে আমাদের বাড়ির টিন কাঠ খাট চৌকি চেয়ার টেবিল এমনকি হাঁড়িপাতিল থালাবাসন পর্যন্ত আক্কাসের বাড়ির উঠানে। আক্কাস আর তার বড়ভাই কেরামত দুজনে আমাদের দুটো চেয়ার নিয়ে বসে আছে।
মা গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়াল। আক্কাস এইটা তুমি কি করছ? আমার বাড়ির ঘরদুয়ার সব লুট করলা?
আক্কাস না, কেরামত কেলানো একটা হাসি হাসল। আমরা তো লুট করি নাই। লুটের হাত থিকা বাঁচাইছি।
কেমনে বাঁচাইলা? আমার বাড়ির সব জিনিস দেখি তোমগ উঠানে পইড়া রইছে।
সব আপনের না মামানী।
তয় কার?
এই উঠানে যেইসব জিনিস দেখতাছেন, এইসব জিনিস এই পাড়ার আরও কয়েকজন মাইনষের। যাগো যাগো বাড়ি লুট হইতেছিল, সেইসব বাড়িতে গিয়া লুটতরাজ করা মানুষগ আমরা ঠেকাইছি। তাগো হাত থিকা জিনিসপত্র যতটা রক্ষা করতে পারছি, সব এই বাড়িতে লইয়া আইছি।
কও কী?
এবার কথা বলল, আক্কাস। হ মামানী, আমার আপনের লগে মিছাকথা কই না।
মা চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছে আমাদের বাড়ির সব জিনিস আক্কাসের বাড়ির উঠানে। তারপরও তারা বলে ওইসব জিনিস নাকি আমাদের না!
মা অনেকক্ষণ তর্ক বিতর্ক করল তাদের সঙ্গে। কাজ হলো না, মার কথা ওরা পাত্তাই দিল না।
শেষপর্যন্ত মা বলল, তোমরা কী কইতে চাও উঠানের এইসব জিনিসের মধ্যে কিছুই নাই আমার?
কেরামত বলল, আছে।
কী আছে?
আপনের বাড়ির ছয়খান টিন আছে।
মাত্র ছয়খান টিন?
হ। লুটতরাজকারীদের হাত থিকা আপনের বাড়ির মাত্র ছয়খান টিনই আমরা বাঁচাইতে পারছিলাম। আপনের ছয়খান টিন আপনে লইয়া যান।
মা আর কোনও কথা বলল না, বাড়িতে এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। মা আর আমি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে ধরাধরি করে ছয়টা টিন নিয়ে এলাম বাড়িতে। ওই ছয়খানা টিনই তখন আমাদের সম্বল, আর কিচ্ছু নেই। মার পরনে প্রিন্টের সচ্চা একটা শাড়ি। আমার পরনে হাঁটুর কাছে ছেঁড়া ফুলপ্যান্ট, আর কোড়া রঙের অতি পুরনো একটা স্যান্ডোগেঞ্জি।
মনে আছে, ছেঁড়া প্যান্টটার রঙ ছিল খয়রি।
ততোক্ষণে বিকেল হয়ে গেছে।
আমাদের খাওয়া হয়নি কিছুই। কোত্থেকে হবে, বাড়ির কোথাও তো কিছু নেই। সবই তো লুট হয়ে গেছে। আমার চোখের পানি আর ফুরায়ই না, শুধু ভাইয়ের কথা মনে হয়। কোথায় আছে আমার বড় ভাই, ভাবী আর ছোটবোন? কোথায় আছে আমার সেই বাউণ্ডুলে মেজোভাই, কে জানে? বেঁচে আছে , না মরে গেছে সবাই তাই বা কে জানে? যে বাড়িতে, যে ঘরের চার দেয়ালের মাঝখানে, মাথার ওপর রোদ বৃষ্টি ঠেকাবার চালা ছিল যে ঘরে, সেই ঘরের ভিতর জড়াজড়ি করে বড় হওয়া, জড়াজড়ি করে বেঁচে থাকা মানুষগুলো আজ কে কোথায়? পাকিস্তানী জন্তুগুলো হামলার পর হামলা চালিয়ে কোথায় কীভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে আমাদেরকে। তাদের হামলার সুযোগে আমাদের কিছু নিজস্ব মানুষও নিঃস্ব করে দিয়েছে আপনজনকে।
অন্যদের কথা আমি তখন ভাবতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম শুধু আমার আর আমার ওই দুঃখিনী মায়ের কথা।
এই দুজন মানুষ আমরা বাঁচবো কী করে?
মাথা গুঁজবো কোথায়?
খাবো কী?
পরবো কী?
বুকে কোরআন শরীফটা মা ধরেই রেখেছেন। এই অবস্থায় আমাদের একমাত্র অবলম্বন ওই পবিত্র গ্রন্থ। যেন এই গ্রন্থই যাবতীয় বিপদ আপদ থেকে, ঝড়ঝঞ্জা থেকে রক্ষা করবে অসহায় মা এবং ছেলেকে।
আমার কান্না থামে না দেখে মা আমাকে বুঝাতে লাগল, এইভাবে কান্দিস না। কান্দন থামা। এইটাও আল্লাহর একটা পরীক্ষা। আল্লাহপাক বিপদ আপদ দিয়া তার বান্দাগো পরীক্ষা করে। ধৈর্য ধর, আল্লাই পথ দেখাইবো।
ওদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
কোথায় রাত কাটাবো আমরা?
চারপাশের যেকোনও বাড়িতে গিয়েই রাত কাটাতে পারি। কোনও বাড়িতেই সেভাবে লোকজন কেউ নেই। বেশির ভাগ বাড়িই খালি পড়ে আছে। যেকোনও একটাতে গিয়ে উঠলেই হয়।
মা বলল, নিজের বাড়ি ছাইড়া আমি কোনখানে যামু না।
আমি অবাক! তাইলে থাকবা কই?
এই বাড়িতেই থাকুম।
এই বাড়িতে তো ঘরদুয়ার কিচ্ছু নাই?
তারপরও এই বাড়িতেই থাকুম।
গ্রামে যখন তখন আসতে পারে মিলিটারি। গুলি করে আর বাড়িঘরে আগুন দিয়ে মারতে পারে সবাইকে। এসব শোনার পর থেকে প্রত্যেক বাড়িতেই বড় বড় গর্ত করা হয়েছিল, অর্থাৎ ট্রেঞ্চ করা হয়েছিল। থানাঅলারা আর গ্রামের নেতৃস্থানীয় লোকের বুদ্ধি পরামর্শে প্রত্যেক বাড়িতে ট্রেঞ্চ করেছিল লোকে। আমাদের বাড়িতে বড় একটা ট্রেঞ্চ করেছিলাম আমি। অনেকটা কবরের আকৃতি। বাড়ির পিছন দিকটায়। ভিতরে বসে থাকলে বাইরে থেকে দেখে মিলিটারিরা যেন কিছু অনুমান করতে না পারে এইভাবে করেছিলাম ট্রেঞ্চটা। ঝোঁপঝাড়ের ভিতরে ট্রেঞ্চ করে তার ওপর আড়াআড়ি করে বাঁশ ফেলে বাঁশের ওপর চালার মতো করে দিয়েছিলাম বাঁশের তৈরি একটা বেড়া, তার ওপর কয়েক ঝুড়ি মাটি আর মাটির ওপর কিছু ঝোঁপঝাড়। একদিককার মুখ ফাঁকা। সেই দিক দিয়ে ট্রেঞ্চে নামা যাবে। ওই মুখটার ওপর ফেলে রেখেছিলাম আলগা একটা বেড়া। ট্রেঞ্চে নেমে সেই বেড়া টেনে দিলে বোঝা যাবে না এর ভেতর মানুষ আছে কী না?