ইমদাদুল হক মিলন
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৬, ২০০৮
হে অচিন পাখি
হাওয়ায় কী একটা ভাজা-পোড়ার গন্ধ ওঠে। ভারি মনোহর। সেই গন্ধে মাছচালার ধুলোবালি থেকে মুখ তোলে বাজারের নেড়িকুত্তাটা। তারপর প্রথমেই তার প্রভু পবন ঠাকুরকে খোঁজে। নেই। গন্ধ আর প্রভুর টানে কুত্তাটা তারপর ওঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে পুরনোকালের রোঁয়া ওঠা মদ্দা শরীরখান টানা দেয়। তখন দেখে দূরে খাদ্যি খাওয়ার দোকানটার সামনে প্রভু বসে আছে। গন্ধটাও সেদিক থেকেই আসছে।
কুত্তাটা তারপর কিছু না ভেবে গন্ধের দিকে, প্রভুর দিকে ছুটে যায়।
আমার বাপে আছিল ডাকাইত। বিকরামপুরের বুড়া মাইনষের মুখে হোনবেন কেষ্ট ঠাকুরের নামডাক। মাইনষে কইত কেষ্টা ডাকাইত। যাগ বয়েস পাঁচ কুড়ি-ছয় কুড়ি। আমার বাপের নামে হেই আমলে গেরস্তরা রাইত্রে গুমাইত না। রাইত্রে বিছানায় হুইয়া পোলাপান কানলে বউ-ঝিরা কইত, কেষ্টা আইল। কেষ্টার নামে পোলাপানেও ডরাইত। কান্দন থামাইত, গুমাইয়া পড়ত। গেরামে গেরামে মাইনষে চকি দিত। দল বাইন্দা। কেষ্টারে ঠেকাও। অইলে অইব কী, কাম অইত না। বাপে আমার ঠিকই মাইনষের মাতায় বাড়ি মারত। সব্বস্বান্ত করত। দিবেননি কত্তা একখান আমিত্তি? লতিফ ময়রা খুব মনোযোগ দিয়ে রসে ডোবা আমৃতি তুলে মাটির ঝাঁজরে রাখছিল। ঝাঁজরের নিচে বসানো একখান বালতি। আমৃতির রস চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে তাতে।
লতিফ বসে আছে মাটি থেকে হাতখানেক উঁচু একটা চৌকির ওপর। তার ডান দিকে দোকানের ভেতর মিষ্টির আলমারি। ওপরের দুটো রেকে সাজানো চমচম, বালুসাই, কালোজাম, সন্দেশ, আমৃতি ও গজা। আর নিচের রেকে পেতলের বিশাল গামলায় রসে ডোবা রসগোল্লা, লালমোহন ছানার আমৃতি। সারা দিনে সতেরো বার আলমারির কাচ মোছে লতিফ। পদ্মার জলের মতো ঘোলা কাচ। একটার এক কোনা ভাঙা। আর দুটোতে হিজিবিজি ফাটল। হলে হবে কী, কাচ পাল্টায় না লতিফ। অযথা পেচ্ছাব-পায়খানার মতো কিছু পয়সা বেরিয়ে যাবে। দরকার কী! ভাঙা আলমারি কি কম দেয়! লতিফের বাম দিকে দোকানের বাইরে পরপর সাজানো আঠালো মাটির তিনখান আলগা চুলা। একখান দু’মুখী আর একখান একমুখী। দু’মুখীটায় বিয়ানরাতে এসে তুলে দেয় পুরনোকালের বিশাল একটা কেটলি। হ্যান্ডেলে ছেঁড়াখোড়া কাপড় জড়ানো। তাপে তাপে পোড়া মাটির রং ধরেছে।
কেটলির মুখে পাতলা কাপড় দোপাল্লা করে বাঁধা। ছাঁকনি। রাত একপ্রহর অব্দি চায়ের জল ফোটে কেটলিতে। বিয়ানরাতে একবার মাত্র পদ্মার জল আর চা পাতা ছেড়ে চুলায় ওঠায়। তাতেই রাত একপ্রহর অব্দি চলে।
গাঁও-গ্রামের লোকে আর কত চা খায়। তবুও পুরো এক কেটলি চা শেষ হয় লতিফ ময়রার। আর তিন-চার সের দুধ।
দুধের কড়াইটা থাকে কেটলির পাশেই। দু’মুখী চুলার অন্যটায়। চায়ের গেলাস, চিনির টোফা থাকে লতিফের পায়ের কাছে। চুলার সঙ্গে। গাহাকরা চাওয়ামাত্রই কেটলিটা গেলাসের ওপর একটুখানি কাত করে লতিফ। তারপর গোল চামচে একচামচ দুধ, ছোট্ট চামচে দেড় চামচ চিনি। হাতের মাপ বটে লতিফের। একফোঁটা দুধ এদিক-ওদিক হয় না, এক রোঁয়া চিনি। এসবই অভ্যেস। বহুকালের।
লতিফের দোকানটা ছোট। দোকানের ভেতর মিষ্টির আলমারিটা, কিছু হাঁড়ি-পাতিল, বস্তা আর চৌকিটা ছাড়া অন্য কিছু থোয়ার জায়গা নেই লতিফের। গাহাকরা বসে সব বাইরে। বাইরে, লতিফের দোকানের সামনেটা খোলামেলা। একদিকে লতিফের চুলাচাক্কি আর অন্যদিকে লম্বা একখান টেবিল। পায়া নড়বড় করে তার। টেবিলের দু’পাশে লম্বা দুখানা বেঞ্চি। বেঞ্চির গা ঘেঁষে লতিফের দোকানের দুনম্বর ঝাঁপ ঠিকনা দেয়ার বাঁশটা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে। অন্যটা চুলার কাছে।
সবই অনেককালের পুরনো জিনিসপত্র। কিছুই বদলানো হয়নি লতিফের। পাই পাই হিসেব করে এই অব্দি এসেছে। সংসারটা ভারী লতিফের। সাতখানা পোলাপান। আর একখান আছে বউর পেটে। মাসদুয়েক বাদে নাজেল হবে। বুড়ি মা আছে। আর একটা ঢ্যাংগা বোন। কুড়ির ওপর বয়েস। বিয়ে দেওয়া হয়নি। টাকা-পয়সার অভাব। ভোর থেকে রাত দশটা অব্দি দোকান চালায় লতিফ। তারপর ক্যাশবাঙ্ খালি করে টাকা-কড়ি বাঁধে তফিলে। দোকানে ভারী চারখান তালা লাগায়। তারপর দেড় মাইল বিল পাড়ি দিয়ে বাড়ি যায়।
জশিলদিয়া থেকে মেদিনীমণ্ডল যেতে মাঝে একবিল। পাক্কা দেড় মাইল। চাঁদনি রাতে সেই বিল পাড়ি দিতে দিতে লতিফ কেবল একটা কথাই ভাবে, এইদিন থাকব না। দোকানের আয়-উন্নতি বাড়ব। টেকা-পয়সার অভাব মাইনষের চিরদিন থাকে না।
এই কথাটা লতিফ ভেবে আসছে, আজ সতেরো-আঠারো বছর। কিন্তু দিন বদলায়নি। আয়-উন্নতি বাড়েনি লতিফের। যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেছে সব। দোকানটা আর লতিফ নিজে। আসলে লতিফ তার জীবনের ঘোরপ্যাঁচটা বোঝে না। আয়-উন্নতি বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খরচটাও যে বেড়েছে লতিফ তা বোঝে না। এই দোকান দেওয়ার পরই বিয়ে করেছে লতিফ। মা-বোন ছাড়া আর একটা নতুন মানুষ এসেছে। তাই খাইখরচা। সাধ-আহ্লাদ। তারপর বছর পর বছর আর একজন করে। সাকল্যে মানুষ এখন এগারোজন। আর একজন নাজেল হওয়ার ফিকির করছে।
টাকা-পয়সার মারটা যে এইখানে তা লতিফ বোঝে না। এখনো আশায় আছে এইদিন থাকব না। আয়-উন্নতি বাড়ব। জীবন অন্য রকম অইয়া যাইব।
দু’একখানা বড় গাহাক পেলে ধারণাটা জোর পায় লতিফের। এই যেমন, আজ সকাল বেলা কান্দিপাড়ার মাজেদ খাঁ আধমণ আমৃতির অর্ডার দিয়ে গেছে। কাল সকালে নেবে বাপের চলি্লশার মেজবানি। গরু মারবে একখান। আর আগল আগল ভাত। পয়সা দিয়েছে আল্লায়। আত্মাটাও বড় মাজেদ খাঁর। মাংস ভাতের পর খাওয়াবে আমৃতি। আর অন্যদিকে, সত্তর-আশি টাকার কাজ হয়ে যাবে লতিফের। সেই সুখে বিভোর হয়েছিল লতিফ।
সকালবেলা পঞ্চাশ টাকা দিয়ে গেছে মাজেদ খাঁ। আগাম। টাকাটা হাতে পেয়েই জিনিসপত্র জোগাড় করেছে লতিফ। বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে রাতে ফিরবে না। একলা মানুষ পুষ্যি অনেক। সেই ভয়ে দোকানে কর্মচারী রাখে না লতিফ। একলাই আধমণ আমৃতি বানাতে হবে। আধমণ আমৃতি কি যা-তা কথা! রাত কাবার হয়ে যাবে। জিনিসপত্র জোগাড় করতেই দুপুর পার হয়ে গেছে লতিফের। তারপর একমুখী চুলো দুটো সাজিয়ে, একটায় চিনির সিরা তুলেছে। অন্যটায় তেলের কড়াই। পায়ের কাছে, ক্যাশবাঙ্রে সঙ্গে বড় একটা অ্যালুমিনিয়ামের ব্যাঁকা-ত্যাড়া গামলায় ময়দার পানি আর কলাই মিশিয়ে হাতে যখন নারকেলের তলা ফুটো আইচা নিয়ে বসেছে, তখন দুপুর পার। বাজার ভেঙে গেছে।
বাজারটা চালু থাকে দুপুর অব্দি। মানুষের হল্লাচিল্লা, দোকানিদের হাঁকডাক, আনাজপাতি, পেঁয়াজ, রসুনের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকে। আর পচা মাছের বোঁটকা একটা গন্ধ আসে মাছচালার দিক থেকে। এসবের ওপর আছে বাজারের সম্পূর্ণ আলাদা চিরকালীন গন্ধটা।
সকালের দিকে আজার পায় না লতিফ। বাজার করতে এসে গেরামের গণ্যমান্য লোকেরা লতিফের দোকানে আসে—চা খেতে। বরাত ভালো থাকলে মিষ্টিও খায়। এক-আধসের কিনেও নেয় কেউ কেউ। সেই আয়ে জীবন চলে যাচ্ছে লতিফের। আজ সতেরো-আঠারো বছর।
তারপর দুপুরবেলাটা সব ফাঁকা, নিটাল। জনাসাতেক স্থায়ী দোকানদার ছাড়া বাজারের নেড়িকুত্তাটা আর পবনা পাগলা, সারা জশিলদিয়া বাজারে কেবল এ ক’জনই। জেলেরা যে যার ঝাঁকা মাথায় ফিরে যায়। চারপাশের গেরাম থেকে যেসব গেরস্ত ক্ষেতের আনাজপাতি নিয়ে আসে, গোয়ালারা আসে দুধ নিয়ে, বিক্রি হলে ভালো, না হলে যে যার বস্তু নিয়ে দুপুরের মুখে মুখে ফিরে যায়। বাজারের খোলা চত্বরে তখন পবনা পাগলা, নেড়িকুত্তাটা আর দোকানের ভেতরে আজার দোকানিরা।
বাজারখোলার পাশেই বড় গাঙ, পদ্মা। দুপুরের পর পদ্মার হু হু হাওয়া এসে বাজারের ধুলোবালির সঙ্গে খেলা করে। বাজারখোলার চিরকালীন গন্ধটা একটুখানি উসকে দেয়। তখন বাড়ি থেকে আনা ভাত-পানি খায় লতিফ। তারপর খালি গায়ে, বাবুরহাটের লুঙ্গি পরা, মাজায় বাঁধা একটা লাল গামছা, ক্যাশবাঙ্রে সঙ্গে আয়েশ করে বসে বিড়ি টানে। আজ সেই আজারটা পায়নি লতিফ। ভাতটা এক ফাঁকে খেয়ে নিয়েছে। তারপর বিড়ি টানতে টানতে আধমণ আমৃতির মালসামান ঠিকঠাক করে যখন বসেছে তখন বিকাল হয় হয়।
চার-পাঁচ খোলা আমৃতি তুলে ঝাঁজরের ওপর রেখেছে লতিফ, তখন দু’তিনজন গাহাক এলো। গেরামের যুবক পোলাপান। তাই দেখে এক হাতে আমৃতি আর অন্য হাতে চা বানিয়ে ফেলে লতিফ। তারপর গাহাকদের টেবিলে দিয়ে যখন আবার এসে চুলার পাড়ে বসে তখন টের পায় আমৃতি ভাজার গন্ধে বাজারের হাজার বছরের পুরনো গন্ধটা বেপাত্তা। হু হু হাওয়া বাজারময় বয়ে বেড়াচ্ছে আমৃতি ভাজার মনোহর গন্ধ। সেই গন্ধে সতেরো-আঠারো বছরে যা হয়নি লতিফের আজ তাই হয়। পেটের ভেতরটা চনমন করে ওঠে। একখান আমৃতি খাওয়ার সাধ জাগে।
কিন্তু কাজটা করে না লতিফ। একখান আমৃতির দাম পড়ে এক সিকি। একদিন খেলে যদি লোভটা বেড়ে যায়। লোকসান। লোকসান হলে পুষ্যিরা খাবে কী!
এসব ভাবতে ভাবতে আরেক খোলা আমৃতি তোলে লতিফ। তখন দেখে চুলার ওপারে এসে দাঁড়িয়েছে পবন ঠাকুর। লোকে বলে পবনা পাগলা। চেহারা-সুরত কী—শালার! ধড়খান মরা গয়া গাছের মতো। মাথাভর্তি বাবরি চুল। মুখে কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ। চোখ দুটো গর্তে। তবুও ভাটার মতো দেখতে। হাত-পা মরা ডালপালার মতো পবনার। বুকের পাসলি গোনা যায়। পেটখান দেখলে মনে হয়, ফেন গালার মাইট্টা খাদা উল্টো করে বসানো। তার তলায় টুটাফাঁটা একখান ধুতি। জন্মের পর থেকেই যেন পরে আছে।
মাছচালার মাটিতে শোয় পবনা, মাটিতে বসে। ফলে ধুতিটার রং হয়েছে বাজারে বাইলা মাটির মতো। আর পবনার গায়ের গন্ধটা বটে, বাজারের হাজার বছরের পুরনো গন্ধটাও বাইসানরে বলে পালায়। পবনা হেঁটে গেলে মনে হয়, গেরস্তর আনাজপাতির ক্ষেত থেকে খড় আর বাঁশের মাথায় পোড়া মাটির মালসা বসানো তাড়ুয়াটা হেঁটে যাচ্ছে। গেরস্তর ক্ষেতখোলা পাহারা দেয়। ইঁদুর-বাঁদুড় তাড়ায়।
পবনাকে দেখলে বাজারের লোকজন যায় খেপে। কুত্তা-বেড়াল খেদানোর মতো দূর দূর করে। কিন্তু পবনাও, চিজ একখান। কারো দোকানের সামনে গেলে কিছু না কিছু আদায় করবেই। ঘেঙটি পাড়ার ওস্তাদ! দিনরাত বড়পেট খিদে নিয়ে ঘোরে। দোকানিদের কাছে যায়। এটা নেয়, ওটা নেয়। তারপর মাছচালার ওদিকে নিরালায় বসে আয়েশ করে খায়। সঙ্গে থাকে বাজারের নেড়িকুত্তাটা। জগৎ-সংসারে এই একটাই জীব পবনার বড় বাধুক। পবনা নিজে খাবে যা তার একটু-আধটু কুত্তাটাকেও দেয়। রাতের বেলা পবনা যখন ধুলোবালি গায়ে দিয়ে মাছচালায় শোয়, কুত্তাটাও থাকে পাশে। পাশাপাশি দুটো জীবকে একরকমই দেখায়। খোলাবাজারে যেসব গেরস্ত আনাজপাতি নিয়ে বসে, ভালো বেচাবিক্রি হলে খুশিমনে এক-আধ পয়সা দেয় পবনাকে, পবনা তখন অন্য দোকানিদের কাছ থেকে দু’পয়সায় দু’আনার জিনিস আদায় করে। কতকাল ধরে যে এটা চলে আসছে কেউ জানে না। লতিফও না।
লতিফ এই বাজারে আছে সতেরো-আঠারো বছর। তখন থেকে পবনাকে দেখে। একই রকম। ওই একখান ধুতি পরা, একরকমই চেহারা-সুরত। দিন এলো গেল, কাল বদলাল। পবন ঠাকুর বদলায়নি। আরো কতকাল যে এই সুরত আর ধুতিখান নিয়ে টিকে থাকবে, কে জানে!
পবনাকে দেখে এখন এই কথাটা মনে হলো লতিফের। তারপর একটু মায়া হয়। দূর দূর করে না তাড়িয়ে লতিফ বলল, কিরে পবনা কই আছিলি হারাদিন? আইজ দিহি তরে দেকলাম না?
এই কথায় পবনা খুব খুশি। কেউ নরম গলায় কথা বললে সেখানে লেগে যায় সে। এখনো তাই করে। লতিফের চুলার ওপারে ঝাঁপ ঠিকনা দেওয়ার ত্যাড়া হয়ে দাঁড়ানো বাঁশটার সঙ্গে মাটিতে আসন পিঁড়ি করে বসে। তারপর দাঁত কেলিয়ে হাসে। আপনারে তো হারাদিনঐ দেখলাম কত্তা। বহুৎ কাম করতাছেন।
হ। ম্যালা কাম পইরা গেছে আইজ। হারা রাইতঐ দোকানে থাকতে অইব।
ক্যা?
মাজেদ খাঁর বাপের চলি্লশা কাইল। আদামোণ আমিত্তি বানাইয়া দিতে অইব।
লোকের ভালো খবর শুনলে পবনা খুব খুশি হয়। যেন নিজেরই বিরাট একটা কিছু হয়ে যাচ্ছে এমন গলায় বলল, আ হা হা হা হা। ভালা কতা, বহুৎ ভালা কতা। ভগবান দেউক, আরো দেউক আপনেরে। ঠিক তখনি মাছচালার দিক থেকে ছুটে আসে নেড়িকুত্তাটা। পবনার দোসর।
লতিফের গাহাকরা ওঠে এসবের একটু পরে। পয়সা দিয়ে চলে যাওয়ার পর লতিফ দেখে গেলাসগুলো টেবিলের ওপর পড়ে আছে। তার হাত আজার না। একহাতে আমৃতি পেঁচিয়ে ছাড়ছে তেলের কড়াইয়ে আর অন্য হাতে রসের সিরা থেকে তুলে ঝাঁজরে রাখছে। টেবিল থেকে চায়ের গেলাস আনে কে?
লতিফ বলল, ওই পবনা, গেলাসটা আন।
কেউ কোনো কাজের কথা বললে পবনা খুব খুশি হয়। ছুটে গিয়ে গেলাস এনে দেয়। দুইয়া দিমু? লতিফ ভাবে, পবনার হাতে চা’গেলাস দোয়াইতে দেকলে বদনাম অইয়া যাইব। গেরামের গইণ্যমাইন্য মাইনষে তাইলে আর আমার দোকানে চা খাইতে আইব না। এগারোজন পুষ্যি লইয়া আমি কি তাইলে না খাইয়া মরুম! ইট্টুহানি আয়াশের লাইগা দোকানের বদনাম করুম! লতিফ ব্যবসায়ী মানুষ। মুখে এসব কথা বলে না। পবনা পাগল-ছাগল মানুষ। বাজারের নেড়িকুত্তা। তবুও।
লতিফ কায়দা করে বলল, না থাউক। থুইয়া দে। আইজ আর গাহাক আইব না। আজাইর পাইলে আমিঐ ধুমুনে!
গেলাস কটা লতিফের পায়ের কাছে রেখে দেয় পবনা। তারপর আবার মাটিতে আসন পিঁড়ি করে বসে। একখান আমিত্তি দিবেন কি কত্তা?
শুনে লতিফ একটু বিরক্ত হয়। নারকেলের আইচায় আমৃতির মসলা তেলের কড়াইয়ের ওপর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ছাড়ে। তুই হারাদিন খালি খাওনের প্যাঁচাইল পারচ ক্যা?
এ কথায় পবনা খিকখিক করে একটু হাসে। কী করুম কত্তা, পোড়া পেটখান খালি খাই খাই করে। আর আইজ আপনে যেই আমিত্তি ভাজতাছেন, ঘেরানে গাঙের মাছও উপরে উইট্টা যাইব! আমি তো মানুষঐ। গাঙপার বইয়া আছিলাম। তহন বাজার থনে একখান বাতাস গেল। হায় হায় বাতাসে খালি আমিত্তির ঘেরান, হেই ঘেরান পাইয়া আমি পাগলের লাহান দৌড়াইয়া আইলাম।
লতিফ কোনো কথা বলে না। হাসে। আর মনোযোগ দিয়ে তেলের কড়াইয়ে আমৃতি ছাড়ে, আমৃতি তোলে। পবনা বলল, দেন একখান আমিত্তি। ভগমান আপনের কিরপা করব।
শুনে লতিফ কেন যে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর উদাস গলায় বলে, পবনারে আইজ হারা রাইত আমার আমিত্তি ভাজন লাগব। তুই এই চুলার পারেঐ বইয়া থাকিচ। হারারাইত। বোজচ না, একলা মানুষ হারারাইত বইয়া আমিত্তি ভাজুম। আমার ডর করে। বাজানে কইত আমিত্তি ভাজনের ঘেরানে বলে পরিস্তান থনে জিন-পরিও আইয়া পড়ে।
পবনা বলল, এই যে আপনের এহেনে বইলাম কত্তা, আর উডুম না। তয় একখান কতা কই আপনেরে, আইজ এই বাজারে জিন-পরি আইবই। যেই ঘেরান বাইরাইছে। তামান দুনিয়াঐ এই ঘেরান পাইব!
লতিফ কোনো কথা বলে না। এক কড়াই আমৃতি ছেড়ে ওঠে। তারপর দোকানের ভেতর থেকে দুটো করে আটখান মাটির পাতিল এনে চৌকির কাছে মাটিতে সার করে রাখে। আড়াই সেরি পাতিল একেকখান। নবকুমারের দোকান থেকে দুপুরবেলাই এনে রেখেছে। দেখে পবনা বলল, কয় সেইরা পাইল্লা?
আড়াই সেইরা।
কয়খান?
আষ্টখান। তুই কি নিকাস বুজচ না বেডা? আড়াই সেইরা আষ্টখান পাইল্লা না অইলে আদমোণ আমৃত্তি আডেনি?
পবনা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। হ। তয় একখান কতা কই আপনেরে কত্তা, আমি কইলাম পুরা আড়াই সের আমিত্তি এক বহায় খাইতে পারুম। এক ঢোকও পানি খামু না। ইট্টু উডুম না।
শুনে ধমকে ওঠে লতিফ। বড়ো প্যাঁচাইল পারচ তুই। তর বাপেনি খাইছে কুনোদিন এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি?
মাছচালার দিক থেকে হেঁটে আসছিল আউয়াল। মুদি মনোহারির দোকান চালায়। সারা দিন দোকানে থাকে না আউয়াল। আগে থাকত। নতুন বিয়ে করছে, রাতেরবেলা বউর কাছে না থাকলেনি হয়!
বাড়ি যাওয়ার সময় লতিফের দোকানে একবার আসে আউয়াল। খানিকক্ষণ বসে যায়। গল্পগুজব করে। বেচাবিক্রির আলাপ। হাসি, বিড়ি খাওয়া।
আজ হাসতে হাসতেই আসে আউয়াল। তারপর লতিফের দিকে তাকিয়ে বলে, কী কয়, পাগলায়? লতিফও হাসে। কয় ও বলে এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি খাইতে পারব। এক ঢোকও পানি খাইব না, ইট্টু উডব না।
হালায় একটা পাগলঐ। বলে ট্যাঁক থেকে বিড়ি বের করে আউয়াল। লতিফকে দেয় একখান। নিজে নেয়। তারপর বিড়ি ধরিয়ে বেঞ্চে বসে। ওই পাগলার পো, তর বাপেনি খাইছে কুনোদিন এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি!
তারপর আবার হাসে।
আউয়াল মানুষটা মন্দ না। ঠাট্টামশকরা পছন্দ করে। আর হাসতে। এ জন্যে দোকানে গাহাক পড়ে বেশি আউয়ালের। দেখে অন্য দোকানিদের পোদ জ্বলে। হলে হবে কী, কেউ কিছু বলে না।
পবনা বলল, আমার বাপে পারত পাঁচ সের খাইতে। এক বহায়। আমি হেই বাপের পোলা, আড়াই সের পারুম না। দিয়া দেহেন কত্তা কেমনে খাই।
লতিফ বিরক্ত হয়ে বলল, আজাইরা প্যাঁচাইল পারিচ না পবনা। বয়। অন্য কথাবার্তা ক, আমার কাম আউগগাইব।
একথায় পবনা একটু উদাস হয়। ফাঁকা শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকায়। তাকিয়ে থাকে। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, আমার বাপে আছিল ডাকাইত। বিকরামপুরের বুড়া মাইনষের মুখে হোনবেন কেষ্ট ঠাকুরের নামডাক। মাইনষে কইত কেষ্টা ডাকাইত। যাগ বয়েস পাঁচ কুড়ি ছয় কুড়ি। আমার বাপের নামে হেই আমলে গেরস্তরা রাইত্রে গুমাইত না। রাইত্রে বিচনায় হুইয়া পোলাপান কানলে বউ-ঝিরা কইত, কেষ্টা আইল। কেষ্টার নামে পোলাপানেও ডরাইত। কান্দন থামাইত, গুমাইয়া পড়ত। গেরামে গেরামে মাইনষে চকি দিত। দল বাইন্দা। কেষ্টারে ঠেকাও। অইলে অইব কী, কাম অইত না। বাপে আমার ঠিকই মাইনষের মাতায় বাড়ি মারত। সব্বস্বান্ত করত। দিবেননি কত্তা একখান আমিত্তি?
পবনার শেষ কথাটা কেউ গায়ে মাখে না। লতিফ মনোযোগ দিয়ে ঝাঁজরের ওপর আমৃতি তোলে। আউয়াল বিড়ি টানতে টানতে বলে, তর বাপে আছিল ডাকাইত। মাইনষের মাতায় বাড়ি মাইরা টেকা-পয়সা, মাল-সামান লইত আর তুই নেচ বিক্কা কইরা। বলে আবার সেই গাহাক ভোলানো হাসিটা হাসে।
পবনা বলল, এইডা অইল গিয়া কত্তা বরাতের খেইল। ডাকের কথা আছে না, চোর-ডাকাতের গুষ্টির অন্ন জোডে না। আমার অইছে হেই দশা।
তারপর ফুরুক করে মুখের ভেতর লালা টানে পবনা। কত্তা, দিবেন নি একখান! পেট্টা পুইরা গেল!
লতিফ কথা বলে না। বলে আউয়াল, ওই পবনা পারবি তুই আড়াই সের আমিত্তি খাইতে? এক বহায়?
কন কী কত্তা? পারুম, হাচাঐ পারুম। দিয়া দেহেন না!
যুদি না পারচ?
না পারলে আপনেরা বিচার করবেন?
কী বিচার করুম?
যা আপনেগ মনে লয়।
আউয়াল মানুষটা আমুদে। পবনার কথায় হঠাৎ ভারি ফুর্তি হয় তার! যুদি তুই এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি খাইতে পারচ, আমিত্তির দাম তো আমি দিমুঐ আবার কাইল থনে আমার দোকানে তর খাওন-থাকন ফিরি। যতদিন তুই বাঁচবি। আর যুদি না পারচ তাইলে এই বাজারে থনে আইজঐ তরে বাইর কইরা দিমু। কুনুদিন এহেনে আর আইতে পারবি না। ক রাজি আছচ নি?
পবনা ফুর্তিতে গর্দান কাত হয়। ফুরুক করে মুখের ভেতর লালা টেনে নেয় আবার। এক বহায় তো খামুঐ। এক ঢোকও পানি খামু না। উডুমও না।
লতিফ এসব কথা খেয়াল করছিল না। আধমণ মিষ্টির অর্ডার, ষাট-সত্তর টাকার কাজ। ওই একটা চিন্তায়ই সে মগ্ন। দিন বুঝি তার বদলায়।
আউয়াল বলল, হুনছনি লতিফ?
লতিফ আনমনে বলল, কী? পবনা যদি এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি খাইতে পারে তয় আমিত্তির দাম তো আমি দিমুঐ। আবার কাইল থনে আমার দোকানে অর থাকন-খাওনও ফিরি।
আউয়াল মৃদু হেসে বলল, কী কচ পবনা?
হাচাঐ কই কত্তা। দিয়া দেহেন না।
আউয়ালের কেন যে এত উৎসাহ। বলল, খাড়া মানুষজন ডাক দেই। বলেই চেঁচিয়ে আশপাশের দোকানিদের ডাকে। ও মিয়ারা, আহেন ইদিকে। কাম আছে।
শুনে লতিফ হাসে। আর ভেতরে ভেতরে খুশি হয়। আরো আড়াই সের আমৃত্তি বুঝি বিক্রি হয়ে গেল তার। আরো দশ-বারো টাকার বুঝি কাজ হয়।
আউয়ালের হাঁকডাকে দু’তিনজন আজার দোকানদার এসে জোটে। কী অইল আউয়াল মিয়া? আউয়াল মহা ফুর্তিতে ঘটনাটা বলে, শুনে কাশেম বলল, কী কচ পবনা? হাচাঐ পারবি? নাইলে বুজিচ বাজার ছাড়তে অইব। এহেনে আর কুনুদিন আইতে পারবি না।
পবনা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। কত্তারা আমি কি আপনেগ লগে মশকরা করতাছি নি? এবার কথা বলে লতিফ। বুইজ্জা দেক পবনা, আড়াই সের আমিত্তি এক বহায় খাওন খেলা কতা না।
লতিফ বলল, আবার বোজ?
বুজছি বুজছি, দিয়া দেহেন।
এবার উত্তেজনা বেড়ে যায় আউয়ালের। লতিফ। টেকা আমি দিমু।
লতিফ তো মহাখুশি। তবুও মুখে কিছু একটা বলতে যাবে, তাকে থামায় কাশেম। তোমার কী লতিফ বাই, দেও। ইট্টু কষ্ট কইরা আড়াই সের আমিত্তি বেশি বানাইবা! দাঁড়িপাল্লা হাতে নিয়ে লতিফ বলল, আমার অসুবিদা নাই। মাল-সামান আছে। আদা ঘণ্টার খাটনি। আমি চিন্তা করি পাগলার লেইগা।
পবনা বলল, আমার লেইগা আপনের কুন চিন্তা নাই কত্তা। আপনে আমিত্তি বানান আর দেহেন, পাগলায় কেমনে বেবাকটি খায়।
দু’পাল্লায় সোয়া সের করে গরম আমৃতি মেপে একটা মাটির খাদায় ঢেলে পবনাকে দেয় লতিফ। তারপর হাসে। অহনও টাইম আছে পবনা, বুইজ্জা দেক।
পবনার তখন দিকবিদিকের খেয়াল নেই। হাতের সামনে গরম গরম আড়াই সের আমৃতি। সবই তার। একলা খাবে। কতকালের সাধ। খাওয়ার সাধ পূরণের যে কী সুখ, পবনা ছাড়া পৃথিবীর আর কে তা এই মুহূর্তে জানে!
প্রথম আমৃতিটা মুখে দিয়ে পবনা বলল, আহা কী সোয়াদ গো কত্তা। আইজ রাইতে আপনের দোকানে জিন-পরি আইবঐ।
এ কথায় লতিফ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। বাপের মুখে শুনেছিল, খাঁটি মিষ্টি নিতে পরিস্তান থেকে জিন-পরি আসে গভীর রাতে। দোকানের বেবাক মিষ্টি নিয়ে যায়। যত হাঁড়ি মিষ্টি নেয় টাকা দেয় তত হাঁড়ি। ভাগ্যকুলের কালচাঁদ একরাতে সাত হাঁড়ি টাকা পেয়েছিল। সেই টাকায় কালচাঁদ এখন মহা ধনী। কলিকাতায় শয়ে শয়ে মিষ্টির দোকান তার। বাড়ি, গাড়ি।
লতিফ ভাবে, আইজ রাতে যদি হাচাঐ জিন-পরি আহে আমার দোকানে! যুদি আধামণ আমৃতি লইয়া আধামণ টাকা দেয়! ইস্ তাইলে আর কথা নাই। এই দিন থাকব না। বদলাইয়া যাইব।
গপাগপ দশটা আমৃতি খেয়ে পবনা বলল, বেশি খাওন সামনে থাকলে আমার আবার ইট্টু প্যাঁচাল পারতে অয়, বুজলেননি কত্তারা। আপনেরা আইজ্ঞা করলে কই।
আউয়াল বিড়ি ধরিয়ে বলল, ক। তয় বুজিচ, বেবাক কইলাম খাইতে অইব। ওকাল পাকাল করতে পারবি না।
পবনা হাসে। দেহেন না কত্তা কেমনে খাই।
তারপর আর একটা আমৃতি মুখে দেয়। একবার আমার বাপে গেছে চরে ডাকাতি করতে। আমি তহন পোলাপান। সাত-আষ্ট বচ্ছর বয়েস। আমাগ বাড়ি আছিল কোরাটি গেরামে। পদ্মার পারে। অহন আর কোরাটির নামগন্ধ নাই। পদ্মায় ভাইঙা গেছে। তয় আমি করতাম কী, হারাদিন গাঙপার পইড়া থাকতাম। মায় আমারে গাঙপার থনে দইরা আইন্না বাতপানি খাওয়ায়।
পবনা আর একটি আমৃতি মুখে দেয়।
ততক্ষণে আরো দু’চারজন দোকানদার এসে ভিড় করছে লতিফের দোকানের সামনে। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বেঞ্চে বসে। সবাই হাঁ করে দেখছে পবনাকে। পবনার পাশে কুত্তাটা। আমৃতির লোভ তারও আছে। এর মধ্যেই বার দুয়েক ঘেউ দিয়ে ফেলেছে সে। কী ঠাকুর, আমারে ইট্টু দিবা না! নাকি একলা-একলাই খাইবা! আ? পবনা খেয়াল করেনি। সুখের সময় কে কার কথা মনে রাখে!
আমৃতি চিবাতে চিবাতে পবনা বলল, বাজানে গেছে চরে ডাকাতি করতে। সাত দিন চইলা যায়, ফিরে না। কুনো সম্বাদ নাই। গাঙপার আটতে আটতে আমার খালি বাজানের কথা মনে অয়। কাসার বাসনে বাত বাইরা দিলে মারে আমি জিগাই, বাজানে আহে না ক্যা মা?
মায় কয়, আইব, বড় কামে গেছে।
তয় বাজানে কুনওদিন ডাকাতি করতে গিয়া দুই দিনের বেশি দেরি করত না। হেই কথা ভাইবা মনডা কেমুন করে আমার। অইলে অইব কি, পোলাপান মানুষ, মারে বেশি কতা জিগাইতে পারি না। রাইত-বিরাইত জাইগা হুনি আন্দার গরে মায় জানি কার লগে কতাবার্তা কয়। বিয়ানে কেঐরে দেহি না। মারে জিগাইলে কয়, আমি গুমের তালে কথা কই।
আবার তিন-চারটা আমৃতি খায় পবনা। ততক্ষণে বিকেল ফুরিয়ে গেছে। পদ্মার হাওয়ার সঙ্গে কাশরেণুর মতো উড়ে উড়ে আসছে অন্ধকার। দোকানে দোকানে জ্বলে উঠেছে হারিকেন, হ্যাজাগবাতি। লতিফ ময়রাও যে কোন ফাঁকে পুরনোকালের জংধরা হ্যাজাগটা পাম্প করে, তেল ভরে কাচ পরিষ্কার করে ম্যানটেলে আগুন দিয়েছে, কেউ খেয়াল করেনি। হ্যাজাগটা এখন মিষ্টির আলমারির সঙ্গে বসে জ্বলছে। কী আওয়াজ তার। শোঁ শোঁ। সেই আওয়াজের সঙ্গে মিলেমিশে আসছে আগরবাতির গন্ধ। সন্ধেবেলা দোকানে আগরবাতি জ্বালায় লতিফ। আজ সতেরো-আঠারো বছর। যে ধর্মের যে রীতি। হিন্দুরা দেয় ধূপ, মুসলমানরা আগরবাতি। যাবতীয় সুগন্ধই বুঝি পবিত্র।
হ্যাজাগ জ্বালিয়ে লতিফ আবার বসেছে চুলার পাড়ে। মনোযোগ দিয়ে আমৃতি তুলছে। পবনার চারপাশের ভিড়টা একটুও নড়েনি। দোকানিদের কত কাজ থাকে সন্ধেবেলা, আজ সেসব কাজের কথা কারো মনে নেই।
হ্যাজাগের দিকে তাকিয়ে আবার দু’খান আমৃতি খায় পবনা। ছয় দিনের দিন নিশি রাইতে গুমের তালে আমি হুনি কি, কই জানি বহুৎ দূরে কী একখান পইক ডাকতাছে। কু কু। হুইনা আমার বুকের বিতরে কেমুন জানি করে। পোলাপান মানুষ তো, কিচ্ছু বুঝি না। বিয়ানে উইট্টা দেহি মনে নাই কিছু। পরদিন দুইফর বেলা, আমি আর মায় বইয়া রইছি দাওয়ায়, এমুন টাইমে একজন অচিন মানুষ আইল। মাতায় তার আড়াই সেইরা একখান মাইট্টা পাইলা। নতুন। মুখখান আবার বাঁশকাগজ দিয়া বান্দা। দেকলে মনে হয়, মিষ্টি মাতায় লইয়া বিয়ার চলনে যাইতাছে। আমি চাইয়া চাইয়া মানুষটারে দেহি। হেয় দেহি আমাগ বাইতঐ আহে। দেইক্কা আমি আর আমুদে বাঁচি না। আমাগ কুনো সজন আইলনি। মেলাদিন বাদে আইল দেইক্কা বুঝি মিষ্টি লইয়া আইছে। মিষ্টির মইদ্যে আমিত্তি অইল আমার জানপরান। পাইলা দেইখা আমার লোভ পইরা যায়। আহা আইজ পেট বইরা আমিত্তি খামু। কুনোদিন তো ভরপেট আমিত্তি খাই নাই। দুই চাইরখান খাইছি। পেডের কোনাও ভরে নাই।
আউয়াল বলল, ওই পবনা খাচ না? অহনো তো এক সেরও খাইতে পারচ নাই। বেবাকটি যুদি না পারচ তাইলে বুজিচ। আইজঐ পিডাইয়া বাজার থেকে খেদামু।
লোকে বোঝে, আড়াই সের আমৃতির দাম দিতে অইব। আবার কাইল থনে পবনার থাকন-খাওন। জেদের চোটে কাজটি করেছে আউয়াল। সেই রাগে ভেতরে ভেতরে গজরাচ্ছে এখন। দেখে অন্য দোকানিরা খুশি হয়। ভালা হোগামারানি খাইছে হালায়। পয়সার গরম, বোঝ অহন!
লতিফও মনে মনে হাসে। হোগায় গুঁড়া কিরমি অইলে এমনুঐ অয়।
কথা বলতে বলতে পবনা একটু আনমনা হয়েছিল। আউয়ালের খ্যাঁকানিতে আমৃতির কথা মনে পড়ে। আবার নতুন করে খাওয়ার লোভটা হয়। এক থাবায় দু’তিনটে আমৃতি তোলে পবনা। মুখে দেয়। এইভাবে চার-পাঁচবার। দেখে ভিড়টা হুল্লাচল্লা করে ওঠে। এইবার পবনা ওকাল করব।
শুনে গর্জে ওঠে আউয়াল। লতিফের দোকানের ঝাঁপ ঠিকনা দেওয়ার বাঁশটা আঁকড়ে ধরে। ওকাল করলেই পিডান আরম্ভ করুম।
পবনা সেসব খেয়াল করে না। আমৃতির স্বাদ মুখে নিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। চেইতেন না কত্তা। বহেন আর দেহেন। তয় আমারে ইট্টু কতাবার্তা কওনের টেইম দিতে অইব।
পবনা আবার দুটো আমৃতি খায়। মানুষডা করল কী, বুজলেননি কত্তারা, পাইল্লাখান মার পার সামনে নামাইয়া ইট্টু খাড়ায়। খরালিকাল আছিল। কত্তার চুলার লাহান গরম অইয়া গেছে দুনিয়া। মানুষডা গাইম্মা চুইম্মা সারা। মাজায় বান্দা আছিল লাল একখান গামছা। খুইল্লা মোক পোছে। চেহারাখান কী তার, দেকলে ডর করে। মাথায় বাবরি চুল। মোকে খাশির লাহান কালা মোচ, দাড়ি। চক্কু দুইখান শোল মাচের পোনার লাহান লাল। কইল, ওস্তাদ আপনেগ লেইগা মিষ্টি পাডাইছে। হেয় আইব সাত দিন বাদে। হুইনা মায় আমার কুনো কতা কয় না। মানুষডা কুন দিকে যে চইলা যায়, আর দেহি না। তয় আমার তহন কুনওদিকে খেল নাই। মায় যেমুন বইয়া রইছিল, তেমুনঐ বইয়া থাকে দেইখা আমার পরানডা আইঢাই করে। পাইল্লাডা খোলে না ক্যান মায়। বইয়া রইছে ক্যা? মোক দিয়া আবার লোল পড়ে আমার। সইতে না পাইরা কাগজ ছেদা কইরা পাইল্লার ভেতর আত দেই আমি। হায় হায়, আত দিয়া দেহি মিষ্টি কৈ! আতে দেহি বেতকাডার লাহান কী বিন্দে! উক্কি দিয়া দেহি কি, হায় হায় মিষ্টির নামে হারে বাইশ, পাইল্লার মইদ্যে বাজানের কল্লাডা। বাজানের মাথার চুল আছিল কুডিকুডি। বেতকাডার লাহান খাড়াখাড়া। মোক ভরা মোচ, দাড়ি। গায়ের রংখান আছিল চুলার ছাইয়ের লাহান। আন্দারে বাজানের চক্কু দুইডা ছাড়া আর কিছু দেহা যাইত না। পাইল্লার মইদ্যে বাজানের কল্লাডা দেইক্কা, পোলাপান মানুষ কিচ্ছু বুঝি না আমি। কই, মাগো, দেহ পাইল্লাডার মইদ্যে দিহি বাজানের মাতাডা।
কী কচ? মায় আমার পাইল্লার মইধ্যে ফালাইয়া পড়ে। তার বাদে চিক্কার মাইরা অজ্ঞেন। বুঝলেননি কত্তারা, মায় অজ্ঞেন হইয়া গেল। হেয়া দেইক্কা আমি চিক্কইর আরম্ভ করি। আমার চিক্কইরে পশ্বিরা দরাইয়া আহে। ওই পবনা কী অইছে রে? আ?
আমি কিচ্ছু বুঝি না। কী কমু। পশ্বিরা বাজানের কল্লাডা বাইর করে। তার বাদে হারা গেরামের মানুষ আইয়া ওডে আমাগ বাইত। আসলে অইছিল কী, বুজলেননি কত্তারা, চরে ডাকাতি করতে গিয়া ডাকাতির মাল-সামান লইয়া সাকরিদগ লগে কাইজ্জা লাগে বাজানের। হের লগের মাইনষেঐ হেরে মারে। তার বাদে কল্লাডা কাইট্টা আত্মীয় বাইত মিষ্টি পাডানের লাহান আমাগ বাইত পাডাইয়া দেয়।
পবনা আর দু’তিনটে আমৃতি খায়। লোকজন নিজেদের মধ্যে কী কী সব কথাবার্তা কয়, পবনার কথা শোনে কি শোনে, বোঝা যায় না। কেবল পবনা আড়াই সের আমৃতি খেতে পারবে কি, পারবে না, তাই নিয়ে কথা।
আউয়াল দেখে অর্ধেকের বেশি আমৃতি খেয়ে ফেলেছে পবনা। বাকি অর্ধেকও বুঝি খেয়ে ফেলবে! যেভাবে কথা বলে আর খায়, বেজায় লোকসান হয়ে গেল আউয়ালের। কেন যে চালাকি করে আগে সময় বেঁধে দেয়নি। এখন পবনা যদি সারা রাত বসে আস্তে ধীরে খায় আর কথা বলে! এ কথা ভেবে ভাবনায় পড়ে যায় আউয়াল। পবনা যদি সারা রাত বসে খায়, তাহলে তো তারও সারা রাত বসে থাকতে হবে। ওদিকে নতুন বউ বিছানায় শুয়ে সারা রাত এপাশ-ওপাশ করবে। সকালবেলাও বাড়ি ফেরা যাবে না। দোকানে যেতে যেতে কাল সন্ধ্যা। তখন বউ থাকবে মুখ ভার করে। কথাই বলবে না। তার ওপর নতুন শরীরের স্বাদ। আহা দুনিয়ার যাবতীয় মিষ্টিদ্রব্যের চেয়েও মিষ্টি। সেই কথা ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যায় আউয়ালের।
খেঁকিয়ে বলে ওই পবনা হবিরে কর। তর লেইগা কি হারা রাত বইয়া থাকুমনি?
এ কথায় পবনা একটু বেজার হয়। এমুন কলাম কতা নাই কত্তা। আমি কইছি এক বহায় খামু। বান্দা টেইম দেই নাই। আপনি খালি দেকবেন আমি না খাইয়া উডিনি। তাইলে যা মনে লয় করবেন।
লতিফ ততক্ষণে ছয়-সাত সের আমৃতি ভেজে শেষ করেছে। মাটির ঝাঁজরটা এখন আমৃতিতে ভরা। না সরালে খোলা নামাবে কোথায়। এই ভেবে লতিফ তার টিনের দাঁড়িপাল্লা টেনে নেয়। গামছা দিয়ে মোছে। তারপর সোয়া সের ওজনের দু’খান বাটখারা এক পাল্লায়, আরেক পাল্লায় আমৃতি মেপে নতুন পাতিলে রাখতে থাকে। এক-একটায় দু’পাল্লা করে। মাপতে মাপতে বাইরেও চোখ রাখে। বাইরে আড়াই সেরের কারবার। আট ন’টাকার কাজ। কথাটা ভেবে ভেতরে ভেতরে খুশিতে মরে যায় লতিফ। আইজ সব কিছু কেমুন জানি লাগে! বিয়ানে পাইলাম আদামোণ আমিত্তির গাহাক। বিয়ালে আড়াই সের। নিশি রাইতে ভাইগ্যাকুলের কালাচান্দের দোকানের লাহান আমার দোকানে আইজ জিন-পরি আইব নাত! আদামোণ আমিত্তি লইয়া আদামোণ টাকা যুদি দেয়! হায় হায়রে, তাইলে আর কতা নাই। দিন বদলাইয়া যাইব। দিন বদলের চিন্তায় মগ্ন থাকে লতিফ। বাইরে কে কী বলে, পবনা কতটা আমৃতি খায় না খায় খেয়াল করে না।
পবনার কথায় চুপ করে থাকে আউয়াল। নিজের দোষে নিজে ফেঁসেছে। কিছুই বলার নেই। তবুও তেজি গলায় বলে, বাইত যামু না বেডা!
পবনা হাসে। যাইয়েন নে। বহেন, হপায় তো হাজ অইল। তারপর আবার আমৃতি মুখে দেয়। ঘজ ঘজ করে আমৃতি চিবায় আর কথা বলে। বাজানে তো মরল। হেই দুঃখে আমি আর বাইত থনে বাইর অই না। খালি চিন্তা করি, মাইনষে মইরা যায় কই। ফিরত আহে না ক্যা! তয় একখান কতা কী, মারে দেহি আগের চাইয়া যেমন বেশি আশিখুশি। পোলাপান মানুষ তো, বুঝি না, ক্যান! রাইতে আন্দার গরে হুইয়া ফুসুর-ফাসুর মানুষের কতা হুনি। বেডা মাইনষের গলা। কেডা আহে রাইতে আন্দার ঘরে! মায় তার লগে কী এত কতা কয়? অইলে অইব কী, বেছি পুচপাচ করন যায় না। আমি পোলাপান মানুষ জিগাইলে মা কয়, তুই সপন দেহচ। আর নাইলে আমি যে গুমের তালে কতা কই, হেই হুনচ। হায় ভগমান! তার বাদে অইল কী, বুজলেননি কত্তারা। একদিন নিশিরাইতে অইছে কী, আমি গুমের মইদ্যে হুনি কই জানি বহুত দূরে হেই পইকডা আবার ডাকতাছে। কুকু। হেই ডাকে আমার নিদ ছুইটা যায়। ডর করে। আন্দারে আইত্তাই, মা মাগো। মার কুনো হদিস পাই না। এই ঘুডঘুইট্টা আন্দারে মায় গেল কই! তার বাদে মালুম করি পেশাব-পাইখানা ফিরতে গেছে। আইবোনে। আবার গুমাইয়া যাই। এক গুমে রাইত পার। মাইনষে কয় না কালগুম, বুজলেননি কত্তারা। বিয়ানে উইট্টা দেহি মায় তো আমার কুনোহানে নাই। পাড়া বইরা বিচরাই, গেরাম নাই। মায় আমার কুনো হানে নাই। হেষমেশ যাই দাইমার বাড়ি। হেয়ও আমার লগে মারে বিচরায়। নাই। মায় আমার নাই।
দাইমার আছিল এক মাইয়া, হরিদাসী। আমার লাহান বয়েস। দাইমার পতি চিতায় গেছে একখান ঘোড়া রাইখা। সেই ঘোড়াখান বেলদারগ কাছে বর্গা দিয়া, মাইয়া লইয়া দুইবেলার অন্ন জোটে দাইমার। এমুন মানুষ হেয়। আমি আর হরিদাসী মিইল্লা বেবাক জায়গায় মারে বিচরাই। সম্বাত নাই। আমি পোলাপান মানুষ, বিয়াল অইয়া যায়, মারে না দেইক্কা আমি চিক্কইর পারি। হেই দেইক্কা দাইমায় আমারে তাগ বাড়ি লইয়া গেল। বুজলেননি কত্তারা, তার বাদে কতদিন গেল, আইল, মায় আমার আর আইল না। বয়েসকালে বুজি মা’র একখান পিরিতের মানুষ আছিল। রাইতে বাজান থাকত না বাইত, হেই মানুষখান আইয়া মার লগে কতাবাত্তা কইত। বাজানে বাইচা থাকতে হের ডরে নাগরের আত ধইরা পলাইতে পারে নাই মায়। কেষ্টা ডাকাতের গরের বউ লইয়া পালাইব, এমুন ক্ষেমতা কুন মাইনষের আছে! তয় পালাইল, বাজানে মইরা যাওনের পর। আমারে একলা থুইয়া।
পবনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর আস্ত একখান আমৃতি মুখে দিয়ে উদাস হয়ে চিবায়। কুত্তাটা কুত্তাদের চিরকালীন ভঙ্গিতে তখনো পবনার পাশে বসা। অবাক হয়ে প্রভুকে দেখছে। প্রভু যে আজ তাকে না দিয়ে একলাই খায়! কী কারণ? মানুষের সব আচরণ বোঝে না সে। মানুষ জাতটা বড় অদ্ভুত। কুত্তাদের মতো না। কুত্তাটা কেবল এই কথা ভাবে।
ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। বাজারের ঠিক ওপরে ফুটে উঠেছে কাটা বাঙির মতো চাঁদ। তার ম্লান একটা জ্যোৎস্না এসে পড়েছে বাজারের সাদা মাটিতে। পদ্মার হাওয়াটা আছেই। বাজারের ওপর ঘুরে ঘুরে আমৃতি ভাজার গন্ধ আর চাঁদের আলোর মিশেল দিচ্ছে এখন।
আমৃতি চিবাইতে চিবাইতে গলা খাঁকারি দেয় পবনা। বুজলেননি কত্তারা, আমি তার বাদে দাইমার বাইতেঐ থাকি। নিজের মাইয়ারে আর আমারে এক রহমঐ সোয়াগ আল্লাদ করে দাইমায়। রাইতে হোয়ায় তার লগে। অইলে অইব কী, মা’র কতা কলাম আমি ভুলি না। যহন তহন মনডা কান্দে। পরানডা কান্দে। আর দিন যায়। শইলখান আমার বাজানের লাহানঐ জুয়ান তাগড়া অইতে থাকে। হেই দেইখা দাইমায় একদিন কয়, অই পবনা জুয়ান মদ্দ তো অইয়া গেলি কামকাইজ কর। বিয়াশাদি কর। আমি আর কয়দিন। আপনা পেডেরডা তো আছেই, তুইও অহন আপনাঐ। তগ বেবস্তা না কইরা চিতায় উডুম কেমনে?
কামকাইজের কতাডা ভালাই, বিয়াশাদির কতা, বুজলেন না কত্তারা, হুইনা আমার লাজ করে। কই, কী করুম? বাজানের লাহান চুরি-ডাকাতি?
হেই হুইনা দাইমায় আমারে মুইরা পিছা লইয়াহে পিডাইতে। চুরি-ডাকাতি করনের লাইগা তরে পালছি, এ্যাঁ গোলামের পো।
দাইমারে আমি বহুত ডরাইতাম। কই, তয় তুমি কও কী কাম করুম।
দাইমায় আর কতা কয় না। পরদিন বেলদারগ থনে ঘোড়াডা ফিরাইয়া আনে। ঘোড়াডার নাম আছিল পঙ্খিরাজ। আইনা দাইমায় কয়, ল এই ঘোড়াডা দিলাম। এইডা লইয়া আডবার গোয়ালীমান্দ্রা যাবি, দিগলী যাবি। ধানচাইল টানবি, গেরস্তর সবজি টানবি। আমরা তিনজন মানুষ, দিন চইলা যাইব। হরিদাসী তহন ডাঙর অইয়া গেছে। জোলাগ কাপড় পিন্দা চলে। আর খালি আসে, খালি আসে। আমারে দেইখাও লাজ করে। হেই দেইকা, বুজলেননি কত্তারা দাইমায় হরিদাসীর লগেঐ আমারে—
কথাটা শেষ করে না পবনা। পাগল-ছাগল মানুষ, তবুও লাজলজ্জা আছে। তাই দেখে লোকজন হাসে। আমৃতি ভাজতে ভাজতে লতিফ বলে, কইয়া হালা পবনা, হরিদাসীর লগে আদম খেলা খেলনের বেবস্তা কইরা দিল।
শুনে হাসির রোল পড়ে যায়। পবনা কথা বলে না। আমৃতির খাদার দিকে তাকায়। তাকিয়ে খুশি হয়। পেরায় খতম অইয়া আইছে। আর তিন সাড়ে তিন গণ্ডা অইব আছে। পেডের তো অহনও কিছু অয় নাই আমার। আহা কী সুখ গো! আউয়াল কত্তায় কইছে কাইল থনে হের দোকানে থাকন-খাওন ফিরি। আমারে আর পায় কোন হালায়! সুখের কথা ভাবে, আর গপাগপ আমৃতি মুখে দেয় পবনা। পঙ্খিরাজ আছিল হরিদাসীর বাপের আমলের। বেলদারগ কাছে বর্গা আছিল। হালায় বেলদারের পোরা জবর খাটাইত পঙ্খিরাজরে। ধানচাইল টানাইতে টানাইতে আমরক্ত বাইর কইরা হালাইত। পঙ্খিরাজরে পয়লা দিন দেইক্কাঐ আমার এমুন মায়া লাগল, কী কমু কত্তারা। বিলে ছাইরা আইট কইরা খাওয়াইলাম কয়দিন। দেহি, হ পঙ্খিরাজ ঝাড়া দিয়া উড়ছে। তার বাদে শুরু করলাম কাম। গোয়ালীমান্দ্রার আডে যাই, দিগলীর আডে যাই। আডবার না থাকলে যাই অইলদার বাজারে, শিমইল্লার বাজারে। আয়-বরকত ভালোই অয়। দিন চইলা যায়। তয় আমি কইলাম কত্তারা, পঙ্খিরাজরে জবর সোয়াগ করতাম। হারাদিন কাম কইরা রাইতে দিতাম বিলে ছাইরা। পঙ্খিরাজ আছিল আমার খুব বাদুক। বিয়ানে রইদ উডনের আগেঐ বাইত আইয়া পড়ত। আবার কামে যাও। পেডের ধান্দা অইল বড় ধান্দা। তয় পঙ্খিরাজরে কলাম হরিদাসী দেখতে পারত না। কইত, এইডা অইল আমার হতিন। এই ফাঁকে আরেকখান কতা কই কত্তারা, যেদিনঐ আডেবাজারে যাইতাম, বাইত আহনের টেইমে আমি কলাম একখান দুইখান আমিত্তি কিন্না খাইতাম। আমিত্তি খাওনের লোবটা আমারে যে কেমুন হেইডা আপনেরা বুজবেন না। বাজানের কল্লাডা যেদিন মিষ্টির পাইল্লার লাহান আমাগো বাইত আইল, ওই দিন যে লোবটা অইছিল, আহা আইজ পেড বইরা আমিত্তি খামু—হেই লোবটা আর যায় নাই। অহনও আছে। মাইনষে কয় না, ভগমান মানুষের বেবাক আশা পূরণ না করলেও দুই-একখান করে। আমার আমিত্তি খাওনের আশাডা কইলাম পূরণ অইয়া গেল। এই যে আইজ। ইচ্ছামতন খাইতাছি। পেড বইরা। বলেই পবনা আবার আমৃতি মুখে দেয়। তাই দেখে আউয়ালের মুখে মরা বটপাতার রং ধরে। আদতেই তো হালায় বেবাকটি খাইয়া হালাইব। আর তো আছে পাঁচ-ছয়খান। ইসরে কী কামডা করলাম। কতডি টেকা লোকসান। আবার কাইল থনে পাগলার থাকন-খাওন দিতে অইব। ঘাইরামি করলে বদনাম।
নিজের ওপর রাগে জ্বলে যায় আউয়াল।
কাশেম বলে, হ বুজছি, বেবাকটিঐ খাইব হালায়।
তারপর পবনাকে বলে, একটানে খাইয়া হালা পবনা। দেইক্যা দোকানে যাই। লতিফ বলে, আর কী দেকবা, যাও। ঐত আর কয়খান।
ধীরেসুস্থে খাউক।
আউয়াল মনে মনে বলে, তোমার কি চোদানির পো। খালি মাইনষের হোগা মারনের তালে থাক।
মুখে এসব কথা বলা যায় না। আউয়াল আবার বিড়ি ধরায়। তারপর চাঁদের ম্লান আলো আর পদ্মার হাওয়ার ওপর ধোঁয়া ছাড়তে শোনে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হরিদাসী গেল পোয়াতী অইয়া। হেই দেইক্কা আমি হারাদিন পঙ্খিরাজরে লইয়া আডবাজারে পইরা থাকি। আমিত্তি খাওন ছাইরা দেই। খাওনের মুখ বাড়তাছে। আয় না বাড়লে কেমনে চলব। দাইমায়ও হেই কতাঐ কয়। ভালা কইরা কামকাইজ কর। পোলাপান অইলে খরচা আছে। খালি হরিদাসী কয়, এত কাম কইর না। নিজের জানপরানডার খেল রাইখ। পবনা আবার একটা আমৃতি মুখে দেয়। মুখে দিয়েই টের পায়, পেটটা কেমন করে। বুকটা কেমন করে। হায় হায় ওকাল পাকাল অইব না তো! তাইলে সব্বনাশ অইয়া যাইব। আউয়াল কত্তায় অহনঐ বাঁশ দিয়া পিডাইব। কাইল থনে এই বাজারে আর থাকন যাইব না। তাইলে আমি যামু কই। যাওনের একখান জাগা আছিল দাইমা। হেয় চিতায় উটছে একযোগে বারো বচ্ছর।
পবনা একটু নড়েচড়ে বসে। তাতে পেটটা একটু আরাম পায়। বুকটা একটু আরাম পায়। একদিন রাইতে হরিদাসীর বেদনা উঠল। বাইত আছিল একখান গর। দাইমায় কইল, ওই পবনা তুই গিয়া গাছতলায় ব। এই টেইমে মরদরা গরে থাকে না।
উডানে আছিল একখান রোয়াইল গাছ। আমি হেই গাছের লগে ঢেলান দিয়া বহি। নিশি রাইত। পঙ্খিরাজ গেছে বিলে। আসমানে চুনাকুমড়ার লাগান গোল একখান চান। চান্নী কী! ফক ফক করে। মাইত্তে ফুঁ দিলে ধুলাবালি উড়তে দেহা যায় এমুন। আমি গাছতলায় বইয়া বইয়া বিড়ি টানি আর হুনি গরের মইদ্যে হরিদাসী আহুইজ্জা বেদনায় কোঁকায়। আমার কেন জানি পরানডা কান্দে। কেমুন যানি লাগে। এমনু টেইমে হুনি কী, বুজলেন নি কত্তারা, কই জানি বহুত দূরে হেই পইকখান ডাকতাছে। কু কু। হুইনা আমার পরানডা কান্দে। কেমুন যানি লাগে। বিয়ান অয় নায়, তখন দাইমায় চিক্কইর দিয়া উঠল। হায় হায় রে, কী সব্বনাশ অইল গো। আমি দউর পাইরা গরে যাই। গিয়া দেহি হরিদাসী নিজে গেছে, পেডেরডাও লইয়া গেছে। দেইক্কা আমার যে মাতার মইদ্যে একখান চক্কর মারল, হেই চক্করডা আর কুনদিন গেল না। অহনও আছে।
পবনা তারপর আর কোনো কথা বলে না। উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী যে দেখে, কী যে ভাবে, কেউ জানে না।
খাদায় তখন একটা মাত্র আমৃতি। দেখে আউয়াল উঠে দাঁড়ায়। মরা বটপাতার মতো মুখটা নিয়ে বলে, খাইয়া হালা পবনা। বাইত যামু।
ম্যালা রাইত অইল।
কাশেম বলল, দেরি করচ ক্যা পবনা? খাইয়া হালা।
পবনার তখন পেটটা কেমন করে, বুকটা কেমন করে। এতকালের পুরনো শরীরটা আর নিজের মনে হয় না। ভাবটা চেপে থাকে পবনা। মুখে খুব বিনীতভাবে বলে, কত্তারা, এইডা না খাইলাম। কুত্তাডা হারাদিন বইয়া রইল, এইডা অরে দেই।
শুনে গর্জে ওঠে আউয়াল। বানড়ামি পাইছ বেডা হালা। খাও। নাইলে অহনঐ পিডামু। পবনার আর কথা বলার মুখ থাকে না। মনে মনে কুত্তাটার কাছে ক্ষমা চায় সে। ভাইরে ক্ষমা কইর।
তারপর শেষ আমৃতিটা মুখে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় পবনা। দাঁড়িয়ে টের পায় এতকালের পুরনো শরীরটা আর তার হাতের মধ্যে নেই। অচেনা হয়ে গেছে।
তখন ভিড়টা ভাঙছে। দোকানিরা পবনার গর্বে বুক ফুলিয়ে ফিরে যাচ্ছে। কত পদের কথা তাদের। সাব্বাস পবনা, বাপের নাম রাখছচ।
পবনা এসবের কিছুই শোনে না। অচিন শরীরখান টেনে টেনে, চাঁদের ম্লান আলো মাথায়, নদীর দিকে হেঁটে যায়। পৃথিবীর দূর কোনো প্রান্তে বসে কি সেই পাখিটা তখন ডাকছিল। কু কু?
পরদিন সকালে মাছচালায় ধুলোবালি থেকে মুখ তুলে নেড়িকুত্তাটা তার প্রভু পবন ঠাকুরকে খোঁজে। নেই।
কুত্তাটা তারপর ওঠে। উঠে বাজারময় চক্কর খায়। প্রভুকে খোঁজে। নেই, প্রভু কোথাও নেই।
কুত্তাটা তারপর মন খারাপ করে নদী তীরে যায়। সেখানে জেলেদের দু’তিনখান নাও ডাঙায় উপুর করে রাখা। মেরামত হবে। আলকাতরা মাইটা তেল খেয়ে আবার জলে নামবে।
কুত্তাটা দেখে দু’খান নাওয়ের মাঝখানে মাটিতে তার প্রভু পবন ঠাকুর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। দেখে কুত্তাটা দু’তিনখান ঘেউ দেয়। পবন ঠাকুর নড়ে না। কুত্তাটা কী বোঝে কে জানে, সে আর ঘেউ দেয় না। একটা নাওয়ের সামনে পা তুলে পেচ্ছাব করে।
ছেলেবেলার গল্প
দশ এগারো বছর বয়সে বয়রা হয়ে গেলেন হাফেজমামা। কানে একদমই শোনেন না। তবু তাঁর দুরন্তপনায় বাড়ির লোক অতিষ্ঠ। মেজোনানা জাহাজের সারেঙ। বাড়িতে পুরুষ বলতে কেউ নেই। হাফেজমামাকে শাসন করার কেউ নেই। তিনি তাঁর মতো দুরন্তপনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মেজোনানা বাড়ি এলেন। ছেলের লক্ষণ দেখে বিরক্ত। এসময় ফকির ফাকরা টাইপের কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করল, এই ছেলের মুসলমানি করানো যাবে না। মুসলমানি করালে ছেলের অনিষ্ট হবে। সে জানে বাঁচবে না।
বয়রা কান নিয়েও কথাটা শুনতে পেলেন হাফেজমামা। ভিতরে ভিতরে রাগে ক্রোধে ফেটে পড়লেন। কিয়ের ঘোড়ার আণ্ডা অনিষ্ট হইব আমার? মোসলমানি না হইলে মাইনষে আমারে কইবো কী? আমি কি হিন্দু হইয়া থাকুমনি?
কোত্থেকে গোপনে একটা ব্লেড জোগাড় করলেন। পায়খানা ঘরে ঢুকে সেই ব্লেড দিয়ে নিজের মুসলমানি নিজে করে ফেললেন।
তখনকার দিনে হাফপ্যান্ট পরার রেওয়াজ ছিল না। বাচ্চা ছেলেরাও লুঙ্গি পরতো। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল হাফেজমামার লুঙ্গি। ওই অবস্থায় পায়খানা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। রক্ত মাখা লুঙ্গি দেখে হৈ চৈ পড়ে গেল বাড়িতে। কী হইছে? ও হাফেজ, কী হইছে?
হাফেজমামা কথা বলেন না। মুখ চোখ কঠিন করে রেখেছেন। বাবা এবং সৎমা নানারকমভাবে প্রশ্ন করেন, হাফেজমামা কথা বলেন না। আমার বুজি হচ্ছে তাঁর সবচাইতে প্রিয় মানুষ। শেষ পর্যন্ত বুজি তাঁকে ধরলেন। কথা কছ না ক্যা? ও হাফেজ, কী হইছে? এত রক্ত কিয়ের? অহনও তো রক্ত পড়তাছে!
বুজির কাছে গলা খুললেন হাফেজমামা। চাচী, নিজের মোসলমানি আমি নিজে কইরা হালাইছি।
শুনে মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা বুজির। বললেন, কী করছস? মোসলমানি? নিজের মোসলমানি নিজে করছস? সব্বনাশ! তুই তো মইরা যাবি।
বাড়িতে হাহাকার পড়ে গেল। মেজোনানা কান্নাকাটি শুরু করলেন। হায় হায় আমার এই পোলা তো আর বাচপো না! ফকিরে কইছিল মোসলমানি করাইলে অর অনিষ্ট হইব। সব জাইন্না বুইজ্জা এই কামডা ও কেমতে করল?
কিন্তু হাফেজমামা নির্বিকার। নিজেই ত্যানা দিয়ে মুসলমানি করা জায়গাটা প্যাঁচিয়ে বেঁধেছে। অপরিসীম মনোবলের অধিকারী ছেলে। পাঁচ সাতদিনে দিব্যি সুস্থ। কিসের অনিষ্ট! কিছুই হলো না।
নিজের মুসলমানির দিন হাফেজমামার ঘটনাটা আমার মনে পড়েছিল।
আমাদের তিনভাইয়ের মধ্যে বাদলের মুসলমানি হয়েছিল আগে। তখন সে বেশ ছোট। পেশাব করতে অসুবিধা হতো। সংসার আলী হাজাম দেখে বুজিকে বলল, মোসলমানি করাইয়া দেন। ভাল হইয়া যাইব।
এক বিকালে বাগানের দিকে একটা জলচৌকিতে বসিয়ে সংসার আলী হাজাম মোসলমানি করিয়ে দিল বাদলের। সমস্যাটা মিটে গেল।
বাদলের মুসলমানিতে কোনো উৎসব আনন্দ হয়নি। হয়েছিল আমার আর আজাদের মুসলমানিতে। আজাদ তখন কাজির পাগলা হাইস্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। আমি পড়ি থ্রিতে।
বিশাল আয়োজন হয়েছিল আমাদের মুসলমানিতে। ধুমধামের অন্ত নেই। সঙ্গে একটা দুর্ঘটনাও ঘটলো। দুপুরের পর পর ফিট হয়ে গেলেন বাবা। বুজি মা আর পুনুআম্মা ভাবলেন বাবা বোধহয় মারা গেছেন। আমরা মরা কান্না জুুুুড়ে দিলাম। মুসলমানির উৎসব আনন্দ ভুলে আমি ছটফট করছি আর কাঁদছি। চিৎকার করে কাঁদছি। বাবার কাছে যেতে চাইছি, লোকজনের ভিড়ে যেতে পারছি না।
বাবাকে আমি কী যে ভালবাসতাম!
কী যে টান বাবার জন্য আমার ছিল! বাবার মুখটা একপলক দেখার জন্য পাগল হয়ে থাকতাম। বাবার গলার আওয়াজ পেলে বুক ভরে যেত গভীর আনন্দে।
বাবাকে আমরা বাবা ডাকতাম না। ডাকতাম আব্বা।
আব্বা ডাকার পিছনে একটা ঘটনা আছে। তখন আমরা তিনটি মাত্র ভাইবোন জন্মেছি। আজাদ মণি আর আমি। আমার হয়তো এক দেড়বছর বয়স। মণির তিন সাড়েতিন। আজাদ পাঁচের ওপর। জিন্দাবাহার থার্ডলেনে থাকি। বাবা চাকরি করেন মিউনিসিপ্যালিটিতে। ছুটির দিনে বড়ছেলের হাত ধরে কোনো এক কলিগের বাসায় গেছেন। সেই বাসার ছেলেমেয়েরা বাবাকে আব্বা ডাকে। আব্বা ডাকটা বোধহয় তখনকার জন্য আধুনিক। বাসায় ফিরে মাকে বাবা বললেন, তোমার ছেলেমেয়েদেরকে আব্বা ডাক শিখাও। এখন বাবাকে সবাই আব্বা ডাকে।
মা আমাদেরকে বাবার পরিবর্তে আব্বা ডাকতে শিখালেন।
চার পাঁচ বছর বয়সেই আমি নির্বাসনে চলে এলাম মেদিনীমণ্ডল গ্রামে। নানীর কাছে। নানীকে ডাকি বুজি। আজাদ আমি, কখনো কখনো মণিও এসে থাকতো বুজির কাছে।
কিন্তু আমার মন পড়ে থাকতো আব্বার কাছে। মার কথা মনেই পড়তো না। মেদিনীমণ্ডলের একেকটা নির্জন দুপুরে নানাবাড়ির বাগানের দিকটায় তাকিয়ে আমার খুব আব্বার কথা মনে পড়তো। ছোটখাটো রোগা ধরনের মানুষ। মুখটা কী সুন্দর। গলার আওয়াজ মধুমাখা। মাথায় হাত বুলিয়ে কাছে টানলে মনে হতো এরচে’ বড় আনন্দ জীবনে আর কিছু হতে পারে না।
সুন্দর একটা গন্ধ ছিল আব্বার গায়ে।
তখনকার ঈদগুলো হতো শীতকালে। আমরা তখন সাতটি ভাইবোন। আমার পর বাদল আর পলি যমজ। ওরা জন্মে ছিল জিন্দাবাহারের বাসায়। সেবার খুব বন্যা হয়েছিল। জিন্দাবাহারের ওই গলির ভিতর পানি ঢুকে গিয়েছিল। বাড়ির নাম্বার সাত। থার্ডলেন। টইটম্বুর পানিতে মাচা বেঁধে থাকতে হয়েছিল। ওই অবস্থায় যমজ ছেলেমেয়ের বাবা হলেন আব্বা। ওই বাসায় আর একটা মাত্র ভাই হয়েছিল আমাদের। উষার পর। সেই ভাইটিকে আমি দেখিনি। আঠারো দিন বয়সে মারা যায়।
সবার ছোট আসমা জন্মেছিল গেণ্ডারিয়ায়।
গেণ্ডারিয়ার ডিস্টিলারি রোডের পশ্চিম দিকটায়, ধোলাই খালের কাছাকাছি একটা জায়গার নাম মুরগিটোলা। মুরগিটোলায় আফতাব মিয়া নামের এক ঢাকাইয়া ভদ্রলোকের আড়াই তিনকাঠার ওপর একতলা বাড়িতে আমরা তখন থাকি।
ততোদিনে আমার ঢাকার জীবন শুরু হয়ে গেছে।
অঘ্রাণ পৌষমাসের তীব্র শীতে তখন ঈদ হতো। ঈদের সময় ফ্যামিলি নিয়ে গ্রামে আসতেন বাবা। দুইছেলে পড়ে আছে গ্রামে। তাদেরকে নিয়ে, বুজি এবং পুনুআম্মাকে নিয়ে ঈদ করবেন। কেরানীর চাকরি করেন মিউনিসিপ্যালিটিতে। রুজি রোজগার ভালো। টাকা পয়সা খরচা করতেন অকাতরে।
সদরঘাট থেকে মুন্সিগঞ্জ হয়ে, কখনো চাঁদপুর হয়ে, মেঘনা পদ্মা পাড়ি দিয়ে লঞ্চ যায় লৌহজং মাওয়া তারপর ভাগ্যকূল। অমুক তারিখে বাড়ি আসবেন, চিঠি লিখে জানিয়েছেন আব্বা। তাঁর হাতের লেখা ছিল মুক্তার মতো। মাওয়ার ওদিককার সেহের আলী পিয়ন চিঠি দিয়ে গেছে বাড়িতে। ইনভেলাপের চিঠি না। পোস্টকার্ড। পুনুআম্মা শব্দ করে সেই চিঠি পড়ছেন, বুজি আমি আর আজাদ গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনছি।
তারপর শুরু হতো দিনগোনা। কবে আসবে সেই দিন? কবে? কবে হাজামবাড়ির ছেলেদের নিয়ে আমরা দুটিভাই গিয়ে দাঁড়াবো নদীরঘাটে। বিকেল ফুরিয়ে আসা আলোয় লৌহজংয়ের ওদিক থেকে প্রথমে দেখতে পাবো লঞ্চের ধোঁয়া, তারপর আস্তে ধীরে ভেসে উঠবে একটা লঞ্চ। ভটভট শব্দ করে এগিয়ে আসতে থাকবে মাওয়ার দিকে।
লঞ্চ দেখেই নদীর পাড় ধরে দৌড়াতে থাকবো আমি। যেন যতদূর এগিয়ে যেতে পারি। যেন যত আগে আব্বাকে দেখতে পাই আমার কোনো বোনের হাত ধরে লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে মোহন হাসি।
হাজামবাড়ির ছেলেরা ব্যাগ সুটকেস বহন করে আনতো। ছোটবোনগুলোর কেউ কেউ হাঁটতে পারতো না। মাওয়া তখন মেদিনীমণ্ডল থেকে অনেক দূরে। এক দেড়মাইল তো হবেই। এতটা পথ ছোট বাচ্চারা হাঁটবে কেমন করে!
কাউকে কাউকে কোলে করে আনতে হতো।
আব্বা বাড়ি এলে কী যে উৎসব শুরু হতো! ঈদের আগের সন্ধ্যায়ই যেন ঈদ শুরু হয়ে যেত। হয়তো খানিক আগে বারবাড়ির ওদিকটায় দাঁড়িয়ে, বিলের বাড়ির শিমুলগাছটির মাথার ওপর মিষ্টি কুমড়ার ফালির মতো চাঁদটা একটুখানি দেখা গেছে, তারপরই যেন শুরু হয়ে গেছে ঈদ।
কোনো কোনো বছর শীতের বিকেলে বিলের দিকে জমে ওঠা কুয়াশায় চাঁদ দেখা যেত না। দেশ গ্রামের মানুষ পড়ে যেত ধন্দে। কাল কি ঈদ হবে?
সে বছর আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য স্পঞ্জের স্যান্ডেল কিনে নিয়ে গেছেন আব্বা। আর কেরোলিনের হাফশার্ট। স্পঞ্জের স্যান্ডেল আর কেরোলিনের শার্ট তখন বিরাট ফ্যাশান। সঙ্গে আছে ইংলিশ প্যান্ট। আমার শার্টটা ছিল হালকা আকাশি রংয়ের। আজাদেরটা হালকা সবুজ। আগের রাতে উত্তেজনায় আমার ঘুম আসে না। কখন, কখন সকাল হবে, কখন গোসল করে স্পঞ্জের স্যান্ডেল আর কেরোলিনের শার্ট পরবো। কুয়াশার জন্য চাঁদ দেখা যায়নি। তাতে কি? ঈদ তো কাল হবেই।
গ্রামে তখন রেডিও নেই। ঈদের খবর শোনার কোনো উপায় নেই। ঊনত্রিশ রোজার পরই ঈদ হবে, নাকি রোজা হবে পুরা ত্রিশটা কে জানে! ‘খাইগ’ বাড়ির মাঠে প্রতিবছরের মতো ঈদের জামাত হবে এটা তো সবাই জানে।
আনন্দ উত্তেজনায় ‘বিয়াইন্না রাইতেই’ উঠে গেছি আমরা। বাইরে তখনো আলো ফোটেনি। কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে দেশগ্রাম। মা আম্মা আর বুজি কুপি হাতে চলে গেছেন ‘রান্ধন’ ঘরে। ক্ষির সেউই রাঁধতে বসবেন। রান্নাবান্নায় তাদেরকে সাহায্য করতে হাজামবাড়ি থেকে আসবে অজুফা। পারু নামে একটা যুবতী মেয়ে আছে বাড়িতে। কোন দিককার দূরসম্পর্কের আত্মীয় পারু আমি জানি না। সে থাকতো আমাদের বাড়িতে। কাজের মেয়ে হিসাবেই থাকতো।
আমরা ‘কেফিনে’ বসে, বারান্দা কিংবা ‘খাটালে’ বসে অপেক্ষা করছি কখন আলো ফুটবে, কখন ঘর থেকে বেরুবো। পুকুরঘাটে গিয়ে এই শীতে গোসল করবো। তারপর নতুন জামাকাপড় পরে ঈদ শুরু করে দেবো। ‘বম’ ফুটাবো।
‘বম’ মানে পটকা। লাল নীল নানা বর্ণের কাগজে জড়ানো গোল একটা জিনিস। কবুতরের ডিম সাইজের। মাওয়া কিংবা কাজির পাগলা বাজার থেকে কিনে আনা হয়েছে। আজাদ হচ্ছে এসবের ওস্তাদ। ছানা সেন্টুর সঙ্গে গিয়ে দুতিনদিন আগেই কিনে এনে রেখেছে। মাটিতে জোরে আছাড় মারলেই ফটাস করে শব্দ হয়।
মোমবাতি সাইজের একরকম ‘বম’ও আছে। মুখের কাছে একটা ‘সলতা’। ম্যাচের কাঠি জ্বেলে সলতায় আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে মারতে হয়। বোমার মতো শব্দ হবে। বিয়েবাড়ি ঈদ মুসলমানির উৎসবে খুব ‘বম ফুটানো’ হতো তখন।
আমি ছেলেবেলা থেকেই ভিতু টাইপের। মাটিতে আছড়ে মারা বম দুয়েকবার ফুটিয়েছি। কিন্তু ওই আগুন দিয়ে ধরানোটা কখনও ফুটাইনি। কেউ ফুটাচ্ছে দেখলেই ভয়ে মুখ শুকিয়ে যেত। দুকানে আঙুল দিতাম।
তখন হয়তো একটু একটু করে আলো ফুটছে। গাঢ় হয়ে জমে থাকা ‘খুয়া’ কাটতে শুরু করেছে। বাগানের দিকে ডাকাডাকি করছে কাউয়া শালিক, দইকুলি। হামিদমামা ননীমামারা বমটম ফুটাচ্ছে। হাজামবাড়ির ছেলেরা অনেকেই এসে পড়েছে। আইজ্জাদাও আছে তাদের সঙ্গে। ঈদ শুরু হয়ে গেছে।
আমরা লাফাতে লাফাতে ঘর থেকে বেরুলাম। হৈ চৈ বম ফুটাফুটি। কেউ কেউ গামছা বদনা হাতে চলে যাচ্ছে পুকুরঘাটে। পৌষ মাঘমাস। আর তখনকার দিনে শীতও পড়তো। দেশগ্রামের লোকে বলতো, ‘মাঘের শীত বাঘের গায়।’ তার মানে মাঘ মাসের শীতে বাঘও কাবু হয়ে যায়।
সেই শীত আমরা তোয়াক্কা করছি না। পুকুরঘাটে চলে যাচ্ছি।
বড় পুকুরটা ভরা থাকতো কচুরিতে। লম্বা লম্বা, ঠাসা কচুরি। বেগুনী ফুলে চমৎকার দেখাতো। প্রত্যেক শরিকের নিজের সীমানায় একটা করে ঘাট। অল্প একটু জায়গার কচুরি সরিয়ে পুকুরের ভিতর দিকে চার পাঁচহাত পর্যন্ত হাত দেড়েক চওড়া একটা তক্তা ফেলা। আসলে একটা অসমাপ্ত সাঁকো। ওই ঘাটে বসে পুকুর থেকে লোটা বদনা ভরে পানি তুলে তুলে গোসল করা।
আল্লাহ রে! পানি যা ঠাণ্ডা।
পানির রং কাউয়ার চোখের মতন। তার ওপর ধোঁয়ার মতো ভাসছে কুয়াশা। প্রথম বদনা ঢালবার আগেই হি হি করে কাঁপতো সবাই। কোনো রকমে এক বদনা ঢেলে ফেলার পর একটু সয়ে আসতো শীত। তারপর তিনচার বদনা ঢেলে গোসল শেষ। নতুন জামাকাপড় পরার উত্তেজনায় বাঘের শীতও তোয়াক্কা করছি না।
হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে কোনো রকমে শরীর মোছা। মুছিয়ে দিচ্ছেন পুনুআম্মা। আমার সমস্ত তদারকি তাঁর। মা আমাকে কখনো ধরেও দেখেন না। মায়ের আদর সব পাই আমি পুনুআম্মার কাছে।
তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ধপধপে সাদা ইংলিশ প্যান্ট, আকাশি রংয়ের কেরোলিনের শার্ট, পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। মুহূর্তে রাজপুত্র হয়ে গেলাম আমি।
কিন্তু আব্বাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।
গনিমামাও সেবার বাড়িতে। গনিমামা হামিদমামা ননীমামা, গেল কোথায় সবাই! নামাজের সময় হয়ে এলো। ক্ষির সেউই খেয়ে খাইগ বাড়ির মাঠে যাব ঈদের নামাজ পড়তে। তারপর বাড়ি ফিরে এবাড়ি ওবাড়ি যাব। দুপুরবেলা মুরগির গোস, পোলাও খাবো। ক্ষির সেউইয়ের ওপর দিয়ে রাখা কিসমিস বেছে বেছে খাব।
আগের রাতে মুঠো মুঠো কিসমিস চিনেমাটির গামলা আকৃতির পেয়ালায় ভিজিয়ে রেখেছেন বুজি। খুরমাগুলো চিউলি চিউলি করে কেটে ভিজিয়ে রেখেছেন। ক্ষির সেউইর ওপর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সেই মহার্ঘ্য বস্তু। খেতে যে কী মজা!
আব্বাকে খুঁজতে আমিনুল মামাদের বাড়ির ওদিকটায় গেছি। বাড়ির পুবদিককার নামায় মিয়াদের সেই দুটো হিজলগাছ শীতে জবুথবু হয়ে আছে। দূরে হালটের লাগোয়া জাহিদ খাঁর সীমানায় দাঁড়ানো হিজলগাছটার তলায় দেখি বেশ একটা জটলা। আব্বাও আছেন সেখানে। কী কী বিষয়ে খুব কথাবার্তা তর্ক বিতর্ক চলছে। জাহিদ খাঁর ছেলেরা, মতলেব মামা মাতাব আলী মোতাহারদা ওহাবদা, লতিফখাঁ আমিন মুন্সি সাহেব। গনিমামা হামিদমামারাও আছেন। হাজামবাড়ির আবদুলদাকেও দেখলাম।
একসময় আমাদের বাড়ির দলটা ফিরে এলো আব্বার সঙ্গে। আমাকে দেখে আব্বা বললেন, আইজ ঈদ হইব না বাজান। ঈদ হইব কাইল।
আমি বিষণœ মুখে বাড়ি ফিরে এলাম। মুহূর্তে সারাবাড়ি জেনে গেল আজ ঈদ হচ্ছে না। কারণ গতকাল চাঁদ দেখা যায়নি।
কেরোলিনের শার্ট, সাদা হাফপ্যান্ট আর স্পঞ্জের স্যান্ডেল মন খারাপ করে খুলে রাখি আমি। কাল আবার পরবো।
কিন্তু আজ পরে ফেলেছি, ঈদের জামা পুরনো হয়ে গেল। এই মনোকষ্টে সারাদিন বিষণœ হয়ে থাকি।
ঈদের দুতিনদিন পর স্ত্রী কন্যাদেরকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন আব্বা।
নাকি মণিকেও রেখে গেলেন সেবার! আর রেখে গেলেন বাদলকে। জন্ম থেকেই বাদল খুব রোগা। পেটের অসুখ লেগেই আছে। বুজি খুব আদর করেন বাদলকে। বাদলকে তিনি রেখে দিলেন। মা একলা এতগুলো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে কেমন করে সামলাবেন!
বিক্রমপুরের ভাষায় ছোট ছেলেমেয়েকে বলে ‘এন্দা গেন্দা’।
এন্দা গেন্দার দল নিয়ে মা আর আব্বা চলে যাচ্ছেন ঢাকায়। যাওয়ার পথটা ভিন্ন। মাওয়া হয়ে যাওয়ার ঝামেলা অনেক। গোয়ালন্দ থেকে ভাগ্যকূল হয়ে লঞ্চ আসে দুপুরের পর। সেই লঞ্চে চড়লে ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে গভীর রাত। অতরাত্রে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে জিন্দাবাহার যাওয়া মুশকিল। যদিও সদরঘাট থেকে খুবই কাছে জিন্দাবাহার। পাটুয়াটুলির দক্ষিণ মুখ দিয়ে ঢুকে হাতের বাঁদিকে নোয়াববাড়ি। নোয়াববাড়ির মাঠের ভিতর দিয়ে বেশ কাছে জিন্দাবাহার থার্ডলেন। আটানা দশআনায় ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া যায়।
অতরাত্রে ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া মুশকিল। এজন্য অন্যপথে রওনা দিতেন আব্বা।
তখনকার দিনে শীতকালেও তালুকদার বাড়ির খাল, মানে সীতারামপুরের খাল ভরা পানি। বেলদাররা কেরায়া নৌকা বাইতো। হাজামবাড়ির মজিদ গিয়ে আগের সন্ধ্যায় নৌকা ঠিক করে রেখেছে। কোনো কোনো বছর হযরতদের বাড়ির লাগোয়া খালের বাঁশ কাঠের নড়বড়ে পুলটার তলায় এসেও ভোরের আলো ফুটে উঠবার আগ থেকেই নৌকা নিয়ে বসে থাকতো বেলদার মাঝি। বাড়ি থেকে চট করেই সেখানে গিয়ে নৌকায় উঠতো সবাই। ওদিকটায় পানি কম থাকলে যেতে হতো তালুকদার বাড়ির ঘাটে। সীতারামপুরের খালে।
ওখান থেকে কাজির পাগলা বাজার ডানহাতে রেখে নৌকা চলে যেত গোয়ালিমান্দ্রা হলদিয়ার খালে। ডানহাতে বেশ কিছুটা দূরে গোয়ালিমান্দ্রার হাট রেখে উত্তর দিকে চলতে থাকতো। উত্তর দিকে শ্রীনগর। শ্রীনগরের ঘাটে ভিড়ে থাকতো ঢাকার লঞ্চ। সেই লঞ্চে সকাল দশটা এগারোটার দিকে চড়লে বিকাল তিনটা চারটায় সৈয়দপুর ফতুল্লা হয়ে ঢাকা।
কত সুন্দর সুন্দর নামের জায়গায় যে ভিড়তো লঞ্চ। যাত্রী তুলতো, যাত্রী নামাতো। ষোলঘর, আলমপুর, রাজানগর, শেখরনগর। কুচিয়ামোড়া নামে একটা ঘাট ছিল। লোকে বলতো ‘কুইচ্চামারা’।
‘কুইচ্চা’ জিনিসটা হচ্ছে বাইন মাছের মতো একটা জীব। গাঢ় খয়েরি রংয়ের। তেলতেলে। বহুদিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল জায়গাটার নাম ‘কুইচ্চামারা’ হয়েছে বোধহয় ওই জীবটির নাম থেকে। এই এলাকায় বোধহয় ‘কুইচ্চা’ জন্মায় অকাতরে। লোকে সেগুলো বেধড়ক মারে বলে নাম হয়েছে ‘কুইচ্চামারা’।
ওই ঘাট থেকে লঞ্চের ডেকে উঠতো শুধু দুধ।
এলাকাটা ঘোষদের। লোহার চকচকে বিশাল পাত্র ভরা দুধ লঞ্চে তুলতো দুজন করে লোক। লোহার পাত্রটার দুদিকে শক্ত হ্যান্ডেল। দুজন দুদিক থেকে ধরে সেই দুধভর্তি ওজনদার পাত্র তুলতো। দুধের মধ্যে ফেলে রাখা হতো ছোবড়া ছাড়া কচুরি।
কেন যে কচুরি ফেলে রাখা হতো কাঁচা দুধে, সেই রহস্য আমার কোনোদিন জানা হয়নি।
ওই ঘাট থেকে প্রচুর ছানাও তোলা হতো লঞ্চে।
ছানা গিঁট দিয়ে বাঁধা থাকত ধোয়া কিংবা নতুন গামছায়। চার পাঁচসের করে ছানা হবে একেকটা গামছায়। পার থেকে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ছানার বোঝা নিয়ে লঞ্চে উঠতো, খালি গায়ের, লুঙ্গি কাছামারা কিছু লোক। থকথকে গামছা বাঁধা ছানা ধপ ধপ করে ফেলতো লঞ্চের ডেকে। ঢাকা পর্যন্ত দুধ ছানার কাঁচা গন্ধে ম ম করতো লঞ্চের ডেক।
ফতুল্লার আগে ছিল একটা ইটখোলা।
দূর থেকে ইটখোলার চিমনি দেখে বুঝে যেতাম, এই তো ঢাকায় এসে পড়েছি। ফতুল্লা মানেই তো ঢাকা।
ফতুল্লা থেকে ঢাকায় আসতে তখন ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। সেই একটা ঘণ্টা আর কাটতে চাইতো না।
চলে যাওয়ার দিন আব্বা আমাকে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে খুব আদর করতেন। গোপনে একআনা দুআনা পয়সা দিতেন। আব্বার সঙ্গে সীতারামপুর ঘাট পর্যন্ত যেতাম। নৌকা ছেড়ে দিতো। মা বোনদের জন্য না, আমার মন খারাপ হতো আব্বার জন্য। নৌকার পিছন দিককার গলুইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আব্বা তাকিয়ে আছেন আমার দিকে, খালপাড়ে দাঁড়ানো আমি তাকিয়ে আছি আব্বার দিকে। আব্বার চোখ ছলছল করছে, আর আমি নিঃশব্দে চোখ মুছছি। মা আছেন নৌকায়। তাঁর কোলে হয়তো তখন পর্যন্ত সবার ছোট সন্তানটি। তিনি কোলের সন্তান নিয়ে ব্যস্ত। আমার দিকে তাকাবার সময়ই নেই। আমিও তাকাচ্ছি না মায়ের দিকে।
তারপর থেকে সবকিছু ফাঁকা। বুজি পুনুআম্মা আজাদ মণি বাদল এতগুলো মানুষ বাড়িতে। বাঁধা কামলা আছে আলফু, কাজের মেয়ে আছে পারু, ফতির মাও আছে। তারপও আমি যেন একা। সম্পূর্ণ একা।
হাজামবাড়ির পুকুরটায় তেমন মাছ ছিল না। তারপরও ফাল্গুন চৈত্রমাসে ঘটা করে একদিন ঝাঁকিজাল পলো নিয়ে নামা হতো পুকুর। বেজায় মাছ ধরার নেশা ছিল আজাদের। তখনও সে ছোট। পলো ‘চাবাতে’ পারে না। সংসারে উপযুক্ত বয়সের পুরুষমানুষ মানে আলফু। আলফু অতি সরল, নির্বোধ টাইপের। তার গলার আওয়াজ আমি কোনোদিন শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তবে তামাক খেত প্রচুর। লুঙ্গি সব সময় কাছা মারা। শার্ট গেঞ্জি কোনোদিন পরতে দেখিনি। ‘নিমা’ নামের ফতুয়ার মতো নীল রংয়ের একটা জিনিস ছিল তার। দেশে, অর্থাৎ চরে যাওয়ার দিন সেটা সে পরত। কাঁধে লুঙ্গি দিয়ে বাঁধা ‘গাট্টি’। মাছ টাছ তেমন ধরতে পারতো না। ক্ষেতখোলা আর বাড়ির কাজ করতো।
হাজামবাড়ির পুকুরে সেবার মাছ ধরা হচ্ছে। দুপুরের দিকে জাল পলো নিয়ে নেমেছে লোকে। বড় ক্ষেতের কাজ সেরে এসে রান্ধনঘরের ‘ছেমায়’ বসে তামাক খাচ্ছে আলফু। রান্ধনঘর থেকে বুজি ডাকল, ও আলফু।
তামাক খেতে খেতে সাড়া দিল আলফু। উঁ।
আজাম বাড়ির পুকঐরে যাও।
ক্যা?
বাইত্তে মাছ নাই। পলো লইয়া যাও। চাবাইয়া দেহ কিছু পাওনি।
আইচ্ছা।
গভীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুরনো পলোটা হাতে নিয়ে আমিনুল মামাদের বাড়ির ওপর দিয়ে হাঁটা দিল আলফু। আমি গেলাম তার পিছু পিছু। অতিশয় বিরক্ত মুখে পুকুরে নামলো আলফু। পলো চাবাতে লাগল। ভঙ্গিটা এমন, যেন মালিক বলেছে বলে কাজটা করছে। মাছ পাওয়া না পাওয়ায় কিছু যায় আসে না।
মিয়াদের জোড়া হিজলতলায় দাঁড়িয়ে লোকজনের মাছ ধরা দেখছি আমি।
আশ্চর্য ব্যাপার, কেউ তেমন কিছু পেলো না, আলফু একটা মাঝারি সাইজের বোয়াল মাছ পেলো। দুই সোয়া দুইহাত লম্বা। বেশ মোটাতাজা বোয়াল। কিন্তু বিল পুকুরের বোয়ালের রং না মাছটার। বিল পুকুরের বোয়াল হয় হলুদ, এই মাছটা ধপধপে সাদা।
বাড়ি নিয়ে আসার পর মাছ নিয়ে নানা রকমের গুঞ্জন শুরু হলো। এটা কি আসল বোয়াল মাছ নাকি বোয়াল মাছের রূপে অন্যকিছু।
নানাবাড়ির বড় পুকুরটায় বিশাল বিশাল গজার মাছ ছিল। সেইসব গজার মাছ নিয়ে নানা ধরনের ভৌতিক গল্প ছিল। এক ধরনের গজার মাছ আছে যাদের কপালে নাকি সিঁদুরের ফোঁটা থাকে। সেগুলো নাকি মাছ না, মাছের রূপে ‘শকশো’। ওরকম গজার মাছ ভুলিয়ে ভালিয়ে মানুষকে পানিতে নামায়। মাছ ধরবার প্ররোচনা দেয়। তারপর পানিতে ডুবিয়ে মারে।
আলফুর ধরা বোয়াল মাছটাও তেমন কিছু কি না কে জানে।
বুজি বলল, আলফু, এই মাছ হালাইয়া দেও। এই মাছ আমরা খামু না।
আলফু বলল, আপনেরা কেউ না খাইলে আমি খামুনে।
না না তোমার খাওনও ঠিক হইব না।
ঠিক হইব আম্মা। কোনো অসুবিদা হইব না। আমরা গাঙপারের মানুষ। সাদা বোয়াল বহুত দেখছি, বহুত খাইছি। গাঙ্গের বোয়াল সাদা হয়। এইডা হইল গাঙ্গের বোয়াল। বাইষ্যাকালে গাঙ্গের পানির লগে গেরামে ঢুইক্কা গেছে। হাজামবাড়ির পুকুঐরে আটকা পড়ছিল।
আলফুর কথা পাত্তা দিলেন না বুজি। বললেন, না না এই মাছ খাওন ঠিক হইব না।
কইলাম তো আপনেরা খাইয়েন না। আমি খামুনে।
খাইলে খাও গিয়া। তয় মাছটা কোডবো কে? রানবো কে?
আমি নিজেই কুডুমনে, নিজেই রান্ধুমনে।
যা ইচ্ছা করো গা।
বাগানে বসে সেই মাছ নিজে কুটলো আলফু, নিজে রান্না করলো, আমরা অতি উৎসাহ নিয়ে দেখলাম। আট দশদিন ধরে সেই মাছ গরম করে আলফু আর খায়। মাছের স্বাদ নাকি অসাধারণ।
তারপর পাঁচ সাতদিনের জন্য দেশে গেল আলফু। আমাদের বড় ক্ষেতটা তখন চষা হচ্ছে। তারেক নামে একটা লোক আছে, হুমাদের বাড়ির পুবের ভিটায় ঘর। লোকে ডাকে তারিক্কা। একজোড়া হালের বলদ আছে তার, লাঙল আছে। রোজ দরে অন্যের জমি চষে দেয়। আমাদের ক্ষেত চাষ দিতে নেমে গেছে। চাষ দেয়া হলে মাটির বড় বড় চাকাগুলো শুকিয়ে পাথরের মতো হবে। ইটামুগুর দিয়ে সেই চাকা ভেঙে গুঁড়িয়ে তারপর ছড়াতে হবে ধান। ততোদিনে বৃৃষ্টি বাদলা শুরু হবে। বৃষ্টির পানি পেয়ে ধানচারা বেরুতে থাকবে মাটি ফুঁড়ে।
বুজিকে আলফু বলে গেল, পাঁচ সাতদিন পর ফিরে এসে ইটামুগুর নিয়ে ক্ষেতে নামবে। যথাসময়ে সব কাজ শেষ করবে।
পাঁচদিন গেল, দশদিন গেল। পনেরো দিন গেল, আলফু আর আসে না। আমাদের চষা ক্ষেত বড় বড় মাটির চাকা বুকে নিয়ে ফাল্গুন চৈত্রমাসের তীব্র রোদে উজবুকের মতো পড়ে আছে। আলফুর অপেক্ষায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। বুজি আর পুনুআম্মা সারাক্ষণ আলফুর চিন্তায় অস্থির। এবার কি ধানটা তাহলে বোনাই হবে না? নাকি অন্যলোক জোগাড় করে কাজ শুরু করে দেবে?
আলফু ফিরে এলো একুশ দিন পর। চেহারা সুরত একদম অন্যরকম। মুখটা শুকিয়ে এই এতটুক হয়ে গেছে। চোখ দুটো ইঞ্চিখানেক গর্তে। দৃষ্টি একেবারেই নির্বিকার। পাঁচটা কথা জিজ্ঞেস করলে হুঁ হাঁ করে একটার জবাব দেয়।
বহু চেষ্টায় জানা গেল বাড়ি যাওয়ার পর তার খুব জ্বর হয়েছিল। জ্বরে ভুগে এই দশা। এজন্য এতদিন আসতে পারেনি।
কথাবার্তা যেটুকু বলে তাতে কেমন একটা উ™£ান্ত ভাব। নাওয়া খাওয়ায় মন নেই। বারান্দায় শুয়ে সারারাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রাতে বোধহয় ঘুমায় না।
বুজি আর পুনুআম্মা আলফুকে নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে গেলেন।
পরদিন থেকে ইটামুগুর নিয়ে ক্ষেতে নামলো আলফু। বুজি আর পুনুআম্মাকে দেখি বড়ঘরের পশ্চিম কোনার ফজলি আমগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে বড়ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে আলফুকে দেখেন। পাঁচ সাত মিনিট কাজ করেই ক্ষেতের মাটিতে লেছড়ে পেছড়ে বসে পড়ে আলফু। ইটামুগুর ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশের দিকে হাত তুলে কী কী যেন বলে।
দিনে দিনে অস্বাভাবিক হতে লাগল লোকটা। খায় না, গোসল করে না। থম ধরে বসে থাকে। তার অতিপ্রিয় তামাকে আগের মতো মন নেই। আগে সারারাত ফোস ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো, এখন কদিন ধরে রাতভর করুণ মিহি সুরে গুণ গুণ করে কাঁদে। বুজি আর পুনুআম্মা কোনো কোনো রাতে উঠে জিজ্ঞেস করে, ও আলফু, কী হইছে? কান্দো ক্যান?
আলফু কথা বলে না।
তারপর আলফু একদিন উধাও হয়ে গেল। তার লুঙ্গি নিমা সব পড়ে আছে বারান্দায়, আলফু নেই। নেই তো নেইই। কোথায় উধাও হয়ে গেছে কে জানে।
সারাগ্রাম তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো আলফুকে। মইজ্জাদা আইজ্জাদা, রব হাইপ্পা এমনকি পারু আর ফতির মা পর্যন্ত এবাড়ি ওবাড়ি খুঁজল।
না আলফু কোথাও নেই।
একদিন গেল।
দুদিন গেল।
দিন যেতে লাগল, আলফু আর ফিরল না।
তার চরের বাড়িতে খবর পাঠানো হলো। না, আলফু সেখানেও যায়নি।
বুজি বলাবলি শুরু করলো, এইডা ওই সাদা বোয়াল মাছ খাওনের ফল। ওইডা তো মাছ আছিলো না। ওইডা আছিলো ‘শকশো’। আমি না করছি, তাও আলফু শকশো খাইছে। শকশো তো খাওন যায় না, তারা হইতাছে নিরাকার। বোয়াল মাছের রূপ ধইরা আলফুরে ভুলাইছে। আমরা দেখছি আলফু ওই মাছ খাইতাছে। আলফুও খাওনের সময় মাছের স্বাদ পাইছে। আসলে ভুল, সবই ভুল। ও শকশো খাইবো কী, শকশোতেই অরে খাইছে। কোন বিল বাউরে নিয়া মাইরা কেদা পানির ভিতরে গুইজ্জা রাখছে কে জানে!
সত্যি সত্যি এই জীবনে আলফুর আর কোনো হদিশ আমরা পাইনি। কোন রহস্যে উধাও হয়ে গিয়েছিল, কে জানে।
জীবনের প্রতিটা বাঁকে মানুষ প্রেমে পড়তে পারে
ইমদাদুল হক মিলন। জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক। প্রেমই তার উপন্যাসের মূল উপজীব্য। লিখেছেন ভিন্নধারার রচনাও। দীর্ঘদিন প্রেমের উপন্যাস লেখা এই লেখক এবার বিশ্লেষণ করেছেন প্রেম ভালোবাসার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জব্বার হোসেন ও রোকন উদ্দিন