আস্তে করে বারেককে ডাকলাম। বারেক।
বারেক সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল। জ্বি।
তার মানে গরুর পানি খাওয়ার শব্দে বারেকেরও ঘুম ভেঙে গেছে।
শুনতে পাচ্ছ?
জ্বি পাইতেছি।
এত রাত্রে গরু এলো কোত্থেকে? কাদের বাড়ির গরু এসে বালতির পানি খেয়ে যাচ্ছে। গোবরের গন্ধও পাচ্ছি। আমরা কি উঠবো? দুজনে মিলে গরুটা তাড়াবো?
বারেক ভয়র্ত গলায় বলল, আপনের কি মাথা খারাপ হইছে? চুপচাপ শুইয়া থাকেন। কথাও বইলেন না।
কেন?
সকালবেলা ঘটনা আপনেরে বলবো।
আমাদের কথাবার্তার শব্দেই কী না কে জানে, হঠাৎ পানি খাওয়ার শব্দটা বন্ধ হলো, আর পানির বালতিটা যেন উল্টে পড়ল। গরুটাও যেন দৌড়ে চলে গেল। তার ভারী শরীরের দৌড়ে মৃদু একটা কাঁপন লাগল মাটিতে, পালঙ্কে শুয়েও সেটা টের পেলাম আমি। বাড়ির পাশ দিয়ে ট্রেন কিংবা ভারী ট্রাক চলে গেলে মাটি যেমন কাঁপে ঠিক তেমন করে কাঁপলো পালঙ্ক।
সকালবেলা আমাকে ডেকে তুললো বারেক। ওঠেন ওঠেন, মজার একটা কারবার দেখাই আপনেরে।
উঠলাম। বারেকের সঙ্গে দরজা খুলে বেরুলাম।
বারেক বলল, দেখেন, বালতির দিকে চাইয়া দেখেন।
ঘুম ভাঙা চোখে বালতির দিকে তাকালাম। তাকিয়ে বড় রকমের একটা ধাক্কা খেলাম। চোখ কচলে আবার তাকালাম। না, দৃশ্য বদলায়নি! দৃশ্য একই। বালতিভরা পানি ঠিকই আছে। এক ফোটাও কমেনি। বারেক যেভাবে রেখেছিল ঠিক সেইভাবে আছে বালতি, সেইভাবেই আছে পানি। মাঝরাতে গরুতে তাহলে খেল কী? এতক্ষণ ধরে পানি খাওয়ার শব্দ পেলাম, ওই নিয়ে বারেকের সঙ্গে কথা বলল। আমাদের কথাবার্তার শব্দে বালতি উল্টে দিয়ে ছুটে গেল গরুটা সেই শব্দও পেলাম। আর এখন দেখছি সবই ঠিক আছে। বালতি আছে বালতির জায়গায়, পানি ভরা আছে আগের মতোই। ব্যাপার কী?
আমি তারপর গোবর খুঁজলাম। গোবরের গন্ধ যে পেয়েছিলাম সেই বস্তুটাই বা উধাও হয়ে গেল কোথায়? কোনও চিহ্নই তো নেই।
কাল সন্ধ্যার সেই রহস্যময় হাসিটা হাসল বারেক। বুঝলেন কিছু?
ফ্যাল ফ্যাল করে বারেকের দিকে তাকালাম। মাথা নাড়লাম। না, কিছুই বুঝলাম না। সবই দেখি ঠিক আছে। মাঝরাতে অতক্ষণ ধরে গরুটায় তাহলে খেল কী? শব্দ পেলাম, গরুর গায়ের গন্ধ, গোবরের গন্ধ সবই পেলাম। দৌড়ে চলে যাওয়ার শব্দও পেলাম। আর এখন দেখি বালতিভরা পানি যেমন ছিল তেমনই আছে। গোবরের চিহ্নও নেই।
কোথা থেকে থাকবে? গরু বলে কোনও জিনিস তো আসে নাই।
তাহলে কী এসেছিল? বারেক, তুমি আমার সঙ্গে ফাজলামো করো না। গরুর পানি খাওয়ার শব্দ আমার চেনা। গা এবং গোবর দুটোর গন্ধই চেনা। বালতি উল্টে দৌড়ে চলে যাওয়ার শব্দ আমি পেয়েছি। তুমিও পেয়েছ। এত কিছুর পর বলছ গরু বলে কোনও জিনিস আসেনি। তাহলে কী এসেছিল? আমার মনে হয় তুমি কিছু একটা চালাকি করেছ।
বারেক বিস্মিত চোখে তাকাল। আমি কী চালাকী করবো?
নিশ্চয় আমার ঘুম ভাঙার আগে উঠে চাপকল থেকে বালতি ভরে পানি এনে রেখেছ, গোবর পরিষ্কার করে রেখেছ।
সেইটা কইরা আমার লাভ কী? দরজা খুইলা ঘর থেকে বাহির হইলে সেই আওয়াজ আপনে পাইতেন। চাপকল থেকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে কেন এত কষ্ট করে পানি আনতে যাবো আমি? অন্ধকারে গোবরই বা পরিষ্কার করবো কীভাবে? রাত্রে এই কাজগুলি সারবার কোনও দরকার নাই। দরকার থাকলে সকালবেলা সারবো। আমারে তো কেউ তাড়া দেয় নাই।
বারেকের কথায় যুক্তি আছে। ঠিকই তো। বারেক কেন অন্ধকার রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসব কাজ সারতে যাবে? কাজটা তো এমন কিছু জরুরি না।
বললাম, তাহলে ব্যাপারটা কী?
বারেক গম্ভীর গলায় আবার সেই কথাটা বলল। গরু বলে কোনও জিনিস আসে নাই।
তাহল কী এসেছিল?
আপনে বোঝেন নাই?
না।
এত সহজ জিনিসটা বুঝতাছেন না?
এবার গা কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। গলা কেমন শুকিয়ে এলো। ঢোক গিলে বারেকের দিকে তাকালাম।
বারেক বলল, যদি সত্য সত্যই গরু হইতো তাহলে আপনের কথায় আমি রাজি হইতাম। দুইজনে বাহির হইয়া গরুটা তখনই তাড়ায়া দিতাম। আমার হাতের কাছে ম্যাচ থাকে, হারিকেন থাকে। হারিকেন জ্বালাইয়া দুইজনে বাহির হইলে গরু তাড়ানো কঠিন কোনও কাজ ছিল না। আর একটা কথা হইল, এই বাড়িতে গরু নাই, গরু ঢুকবারও কোনও পথ নাই। বাড়ির চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। নানান পদের সবজির চাষ হয় বাড়িতে। গরু ছাগল ঢুকলে ক্ষেতের সবজি বিনাশ কইরা ফালাইবো। সামনের দিককার গেটটাও রাত্রে বন্ধ করি আমি নিজহাতে। তাহলে গরু আসবে কোথা থেকে?
শুকনো গলায় বললাম, তাহলে কী এসেছিল?
যে এসেছিল সে মাঝে মাঝেই আসে। কোনও রাতে আমি টের পাই, কোনও রাতে পাই না। তবে সে পানি খাইতে খুবই ভালবাসে। আর তিনাদের পানি খাওয়া আজব রকমের। পানি খাইবেন ঠিকই কিন্তু সেই পানি ফুরাইবো না। তিনার জন্য পানি আমি রোজ সন্ধ্যাবেলাই দরজার বাইরে রাইখা দেই। কোন রাত্রে তিনি আসবেন, কোন রাত্রে পানি খাবেন! যদি মুখের কাছে পানি না পান তাহলে আমার উপরে চেইতা যাইবেন। আমি একলা এইঘরে থাকি। যদি ঘরে ঢুইকা…। ঘরে ঢুকবার জন্য তিনাদের কোনও দরজা লাগে না। হাওয়ার সঙ্গে ঢুকবেন, হাওয়ার সঙ্গে বাহির হইবেন।
ভয়ার্ত গলায় বললাম, ঘটনাটা কি খালা জানেন? রহিমা বুয়া জানে?
না, কেউ জানে না। আমি কাউরে বলি না। বললে যদি আমার উপরে তিনি চেইতা যান? ভাইজান, আপনেও কেউরে বইলেন না।
উপন্যাসের শেষ পর্বটি লিখছি
বাংলাদেশের হাতেগোনা কয়েকজন খ্যাতিমান কথা-সাহিত্যিকের মধ্যে অন্যতম ইমদাদুল হক মিলন। আসন্ন ঈদ ও বইমেলায় এই সাহিত্যিকের একাধিক উপন্যাস ও গল্প প্রকাশিত হবে। সাম্প্রতিক ব্যস্ততা নিয়ে ইমদাদুল হক মিলন মুখোমুখি হয়েছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাহিদ হোসেন।